
ফারাক্কার কতগুলো দরজা খোলা হয়েছিল?
ফারাক্কার সবগুলো কপাট খুলে পানি ছেড়ে দেওয়া নিয়ে বাংলা ট্রিবিউন একটা জটিল ধাঁধার সৃষ্টি করেছে, তারা শিরোনামে বলেছেন, ‘ফারাক্কার গেট খোলা নিয়ে অপপ্রচারে বাংলাদেশ বিরক্ত’। তাদের সংবাদে যা বলা হচ্ছে, তথ্যগুলোকে সাজিয়ে গুছিয়ে নিয়ে দেখা গেল তারা মোটামুটি এমনটি বলতে চাচ্ছেনÑ
১. ‘এই বিভ্রান্তির সূত্রপাত ২৩ আগস্ট, মঙ্গলবার। সেদিন ‘দ্য হিন্দু’-সহ ভারতের বেশকিছু সংবাদমাধ্যমে এই মর্মে খবর প্রকাশিত হয়, বিহার ও উত্তরপ্রদেশে বন্যা পরিস্থিতি সামাল দিতে ভারত সরকার ফারাক্কা বাঁধের সবগুলো গেট খুলে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। ভারতের জলসম্পদ মন্ত্রণালয়ের সচিব শশী শেখরকে উদ্ধৃত করে আরও বলা হয়, ফারাক্কার সব গেট খুলে দিলে বিহারের পরিস্থিতির বেশকিছুটা উন্নতি হবে বলেও তারা আশা করছেন। পরে বাংলাদেশের বেশকিছু মিডিয়াতে সেই একই খবর ‘লিফট’ করে পুনঃপ্রকাশ হয়। একাধিক আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমেও এই খবর প্রকাশ করে বলা হয় ‘ফারাক্কার সব গেট খুলে দেওয়ার ফলে বাংলাদেশে বন্যার আশঙ্কা দেখা দিতে পারে।’
২. বাংলা ট্রিবিউনকে বলেছেন দিল্লির বাংলাদেশ দূতাবাসের একটি উচ্চপদস্থ সূত্র। ‘আমাদের খটকার শুরু ওখান থেকেই। খটকার কারণ হলো, এই বর্ষার মৌসুমে ফারাক্কার সবগুলো গেট এমনিতেই খোলা থাকে, নতুন করে খোলার কিছু নেই। তাই যখন বলা হচ্ছেÑ ভারত ফারাক্কার সবগুলো গেট খুলে দেওয়ার নির্দেশ দিয়েছে, তাই আমরা অবাক না হয়ে পারিনি। কিন্তু দিল্লির বাংলাদেশ দূতাবাস সূত্রে বাংলা ট্রিবিউনকে জানানো হয়েছে, বর্ষার পিক সিজনে ফারাক্কার সবগুলো গেট অর্থাৎ ১০৪টিই যে খোলা থাকে এটা আমরা দায়িত্ব নিয়ে বলতে পারি। এটা একটা নিয়মিত রুটিন ব্যাপার, ফলে এখানে পরামর্শ করা বা নোটিশ দেওয়ারও প্রশ্ন আসে না। তা সত্ত্বেও এই খবর বেরোনোর পর আমরা ঢাকাতে খোঁজ নিয়েছি, তারাও বলেছেন দিল্লির সঙ্গে তাদের এ নিয়ে কোনো আলোচনাই হয়নি।’
বাংলা ট্রিবিউন যে বিষয়টি খেয়াল করতে ব্যর্থ হয়েছে, ৩. ‘অথচ দেখুন, তর্কের খাতিরে যদি ধরেও নিই ২৩/২৪ আগস্ট নাগাদ ফারাক্কার সব গেট খুলে দেওয়া হয়েছে, তারপরও তো প্রায় দশদিন হতে চলল। পদ্মায় বাড়তি পানির স্রোতে রাজশাহী বা অন্য কোথাও কি বন্যা হয়েছে বলে খবর এসেছে? পাল্টা প্রশ্ন ছুড়ে দিচ্ছেন বাংলাদেশের কর্মকর্তারা।’
বাংলাদেশের কর্মকর্তার এই অদ্ভুদ মন্তব্যের জবাবে বাংলা ট্রিবিউনের সংবাদদাতা কি ভেবেছেন, তা আমরা আর জানতে পারিনি। ফারাক্কায় আকস্মিক পানি বৃদ্ধির ফলে বাংলাদেশে পদ্মার পানি বৃদ্ধিতে বন্যা কি হয়নি! রাজশাহীর অনেক এলাকা ও কুষ্টিয়াতে বন্যা হয়নি? ফেরি চলাচল বিপর্যস্ত হচ্ছে না?
দিল্লির বাংলাদেশ দূতাবাসের উচ্চপদস্থ সূত্র যে খটকার কথা জানিয়ে আমাদের আশ্বস্ত করার চেষ্টা করলেন, তা কি আরও বড় খটকার সৃষ্টি করে না? কেননা, বাংলা ট্রিবিউনে পাওয়া ব্যাখ্যা অনুসারে সবগুলো কপাট খুলে দেওয়ার গুজবটার জন্ম নাকি স্রেফ এভাবেÑ ‘পরদিনই বিহারের চিফ সেক্রেটারি (মুখ্যসচিব) আনজানি কুমার সিং দিল্লিতে ফোন করেন জলসম্পদ মন্ত্রণালয়ের সচিব শশী শেখরকে। শশী শেখর তাকে বলেন, ‘চিন্তা করবেন না, আমরা ফারাক্কার সব গেট খুলে দিতে বলেছিÑ তাতে গঙ্গা দিয়ে অতিরিক্ত জল বেরিয়ে গিয়ে বিহারে বন্যার পানি কমে আসবে।’
নতুন খটকা এক. অর্থাৎ, এখানে বলতে চাওয়া হচ্ছে, এই পুরো খবরটার জন্ম হলো বিহারের মুখ্যসচিবকে খুশি করার জন্য কেন্দ্রীয় সচিব শশী শেখর এই ধাপ্পাটা থেকে, আসলে নাকি ফারাক্কার সবগুলো কপাট এমনিতেই বর্ষাকালে খোলা থাকে। এখন পাঠক, আপনিই বুঝে নেন, শশী শেখর বিহারের মুখ্যসচিবকে মিথ্যা আশ্বাস দিয়েছেন, নাকি আমাদের দূতাবাসের জবাবদিহিতাহীন কর্তারা জনগণকে মিথ্যা বলছেন? এমন মিথ্যা ধরা পড়লে ভারতে শশী শেখরের চাকরি আস্ত থাকবে না, কিন্তু এমন মিথ্যা বলে আমাদের দেশে দিব্যি পার পাওয়া যায়। কাকে বিশ্বাস করবেন, সে ভার, পাঠক আপনারই।
নতুন খটকা দুই. সন্দেহ আরও ঘনীভূত হবে, যখন আমরা একই খবরে জানতে পারবÑ ভারতের জলসম্পদ মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র সমীর সিনহাকে উদ্ধৃত করে বিবিসি জানায়, ‘বর্ষায় সাধারণত ফারাক্কার ১০৪টি গেটের মধ্যে সত্তর-আশিটা গেট খোলা থাকে। কিন্তু বিহারের বন্যা পরিস্থিতি সামাল দিতে ভারত ১০০টির মতো গেট খুলে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে আর সেটা বাংলাদেশ সরকারের সঙ্গে পরামর্শ করে, তাদের আগাম নোটিশ দিয়েই করা হয়েছে বলেও দাবি করা হয়।’ দেখা যাচ্ছে, আরও একজন শীর্ষস্থানীয় ভারতীয় কর্মকর্তা বিবিসিকেও একই কথা বলেছেন। অর্থাৎ দুইজন ভিন্ন ভিন্ন দায়িত্বশীল ব্যক্তি একই মিথ্যা বলছেন, সত্যি বলছেন কেবল ভারতস্থ বাংলাদেশের দূতাবাসের কর্মকর্তা।
অর্থাৎ সম্ভাবনা আছে, বাংলাদেশের ওপর দিয়ে বয়ে চলা এই বিপুল অপ্রত্যাশিত পানি যে ক্ষোভ জন্ম দিলো, সেই ঘটনাটার জন্মটাকেই আড়াল করার চেষ্টা করছেন বাংলাদেশের কর্তারা, ভারতের হয়ে। দু-দুটো সূত্রে ভারতীয় কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, বর্ষাকালেও সবগুলো কপাট খোলা থাকে না, সত্তর কি আশিটা খোলা থাকে। ওদিকে বাংলাদেশের কর্মকর্তারা সেই প্রথম থেকে বিস্ময় প্রকাশ করেই আসছেন, কারণ তারা খোঁজ না নিয়েই নিশ্চিত, বর্ষাকালে এমনিতেই ফারাক্কার সবগুলো কপাট খোলা থাকে। এই সুযোগে ফারাক্কার বিষয়টি পুনর্বিবেচনা করার তৎপরতার বদলে বাংলাদেশে ভারতের ভাবমূর্তি রক্ষাই তাদের প্রধান কাজ হয়ে দাঁড়াল। ফারাক্কার অস্তিত্ব না থাকলে একই পরিমাণ পানি তেমন কোনো সমস্যাই সৃষ্টি করত না। প্রতিবেশবিদ বন্ধু আবুল হাসান রুবেল সোজা দেখিয়ে দিয়েছেন, ফারাক্কার ফলে বাংলাদেশে পদ্মা ও তার শাখা নদীগুলোর পানি ধারণক্ষমতা এত হ্রাস পেয়েছে যে স্বাভাবিক পানির প্রবাহেই এখন বন্যার সৃষ্টি হচ্ছে। অথচ প্রচার প্রচারণার ধরন দেখে মনে হওয়া স্বাভাবিক, ফারাক্কার বাঁধ পুরোটা খুলে দেওয়ার এই সংবাদটি ভুল, ভুল কুষ্টিয়ার বন্যা, ভুল নানান স্থানে পদ্মার ভাঙন। ভুল রাজশাহীর বিপন্ন হবার সংবাদ। ভুল বোঝাবুঝি নিরসনই দেশের কর্তাদের একমাত্র কাজ।
সম্ভবত, সংশ্লিষ্ট সাংবাদিকেরও দায়িত্ব ছিল এই কর্মকর্তাকে এই মন্তব্যের উত্তরে পানিকর্তাদের পানির হালহকিকত অবহিত করে আবারও প্রশ্নটা করা। পদ্মা, কুষ্টিয়া, রাজশাহী, ফারাক্কা, পানি বৃদ্ধি এই মাত্র কটা শব্দ দিয়ে গুগলে অনুসন্ধান করলে, পাঠক আপনিও অবস্থা সম্পর্কে কিছুটা জানতে পারবেন সহজেই। যাদের বাড়ি ওইসব এলাকায়, তাদের তো আর কোনো বাড়তি অনুসন্ধানের দরকারই পড়বে না।
সম্পাদনা : আশিক রহমান
