
‘নাই’-এর আলোর যাত্রা
আজ আমি হাঁটছি, অনেক্ষণ ধরে, অনেকখানি পথ ধরে, ‘নাই’কে সঙ্গে নিয়ে। পথটা থমথমে, গা ছমছমে। কিংবা এমনটা ভাবছি বলে বোধ হয় এমনটা মনে হচ্ছে। আসলে হয়তো এমনটা না। এ পথে মানুষজন নেই, এ পথের ধার জুড়ে গায়ে গা ঘেঁষা সব গাছের সারি। জারুল গাছ বোধ হয়, নাকি? আমি আবার গাছ চিনি না তেমন। সব গাছই একরকম মনে হয়। তা গাছ যে দুপাশ জুড়ে আছে, তা তো দেখতে পাচ্ছি, কি গাছ তা বোধ হয় বুঝতে পারছি না। কিন্তু কোনো গাছে, কোনো পাখি নেই। সাধারণত পাখির ডাকে নির্জনতার ছন্দপতন হয়। জারুল গাছ বা জারুল গাছের মতোন দেখতে গাছগুলোতে পাখি নেই। তাই নির্জনতা এখানে রাজা। আর প্রজার মতোন গাছগুলো রাজাকে ঘিরে দাঁড়িয়ে আছে।
এখানে মনে হয় আমিই একমাত্র আছি, আর ‘নাই’ও আছে বটে। পথটি আমার কাছে নতুন। কিন্তু হাঁটতে হাঁটতে ভুলেই গিয়েছিলাম যে পথটি আমার নয়। পথটি আসলে ‘নাই’র। আমার না।
‘নাই’ কিছুক্ষণ আগে এক ইটের স্তুপের সঙ্গে ধাক্কা খেয়ে উল্টে পড়ে গেছে। অল্পের উপর দিয়েই গেছে। কিন্তু ডান পায়ের গোড়ালিতে একটু মচকেছে। খুঁড়িয়ে হাঁটছে। এমন মায়া হলো, চোখের কোণের পানির ঝিলিক বলছে সে ব্যথা পেয়েছে। মুখে কিছু বলছে না যদিও।
বললাম, ‘কিরে একা বাড়ি যেতে পারবি?’
মুখে কিছু বলল না, কিন্তু মুখটা ভারি করে নিজের বালুর পায়ের দিকে তাকিয়ে রইলো।
বললাম চল, ‘তোকে তোর পথে এগিয়ে দিই।’
‘নাই’ আমার কথা শুনে ফোঁকলা দাঁতে হাসে। মুখে কিছু বলল না। সেই হাসির সম্মোহনী গুণে, আমি ‘নাই’ এর সঙ্গে তার পথে হাঁটা দিলাম। হাঁটতে হাঁটতে ‘নাই’ এর পথকে হঠাৎ নিজের পথ মনে হলো। আমি ‘নাই’ এর হাত ধরে নিই। কিন্তু পিছনে এমন এক দূরত্বে হাঁটছি, যে ও ব্যথা পায়ে আবার হোঁচট খেলে আমি ঠিক ধরে ফেলব। ‘নাই’ চলতে চলতে খানিকটা মাথা ঘুরিয়ে আমায় বলে, ‘আইজ মকবুল চাচা ব্যস্ত, নইলে উনি আমারে পৌঁছায় দিতেন।’
বুঝলাম ‘নাই’ তার প্রিয় বন্ধু মকবুল চাচার কথা বলছে, যে মকবুল চাচা ‘নাই’কে খুব ভালো পায়। আমার খুব ইচ্ছা করে ‘নাই’ এর বাদাম রাঙা খড়ের মতোন চুলগুলোয় একটু হাত বুলিয়ে দিই। তা না করে, আমি বলি, ‘কেন রে, আমি তোকে পৌঁছে দিতে পারি না নাকি?’
‘নাই’ তার স্বভাব মতোন কোনো উত্তর দেয় না।
খানিক দূরে, আলোকসজ্জা। উৎসব বুঝি ওখানে? বুঝি ওটা লোকালয়। ‘নাই’ এর বসতি। সবুজের রঙে প্রাণ আছে ওই বসতিতে, প্রাণের মাঝেও সবুজ আছে। ‘নাই’ এর হাসির মতোন সম্মোহনী এক আকর্ষণ আছে ওই বসতির।
‘নাই’ থামে, হাত উঁচিয়ে দেখায়, ‘ওই যে বাড়ি।’
কি অদ্ভুত, কথা শেষ না করেই, ‘নাই’ দৌড়াতে শুরু করে মৃদু পায়ে, তারপর খুব জোরে। ওর পায়ের ব্যথা বুঝি ভালো হয়ে গেল? ওর বালুর পায়ের ছন্দের দিকে তাকিয়ে থাকি। ও ছুটছে ওর লক্ষ্যে, যেখানে ওর বাস, যেখানে অনেক আলো আর সবুজ।
আমি দাঁড়িয়ে আছি। ‘নাই’ এর যাওয়ার দিকে তাকিয়ে থাকি। ‘নাই’ বুঝি আমায় ভুলে গেল। আমি অপেক্ষা করছি। ‘নাই’ কি একবার ফিরে তাকাবে? আমি অপেক্ষা করছি। এই পথ তো আমার নয়, ফিরে যাবার পথ তাই খুঁজে নিতে হবে আমায়। আমি অপেক্ষা করছি। ‘নাই’ এর পৌঁছে যাওয়ার অপেক্ষা। আমি আমার জায়গায় দাঁড়িয়ে, মুগ্ধ মনে, দুচোখ মেলে ‘নাই’ এর আলোর দিকে ছুটে যাবার গল্প দেখছি।
সম্পাদনা : আশিক রহমান
