
আমাদের অর্থনীতির মুখোমুখি বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান ও সাবেক মন্ত্রী নিতাই রায় চৌধুরী ক্ষমতায় টিকে থাকতেই গণতন্ত্রবিরোধী হয়ে উঠেছে সরকার
সাক্ষাৎকার নিয়েছেন দীপক চৌধুরী
সরকারের দুই মন্ত্রী কামরুল ইসলাম ও আ ক ম মোজাম্মেল হক সংবিধান রক্ষার শপথ ভেঙেছেন উল্লেখ করে বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান, সাবেক মন্ত্রী ও সিনিয়র আইনজীবী নিতাই রায় চৌধুরী বলেছেন, তারা আর মন্ত্রী থাকতে পারেন না। আইনজীবী হিসেবে আমি বলবÑ এটা নৈতিক প্রশ্ন। দেশের চলমান বিভিন্ন অবস্থা, বিরোধীদলদমন কৌশল, রাজনৈতিক সঙ্কট, জঙ্গিবাদ দমনের পদ্ধতিসহ সমসাময়িক বিভিন্ন বিষয় নিয়ে এ প্রতিবেদকের সঙ্গে আলোচনাকালে খোলাখুলি মতামত দেন তিনি।
আদালত অবমাননা মামলার পূর্ণাঙ্গ রায় গত বৃহস্পতিবার প্রকাশ হওয়ার পর সেই প্রশ্ন আবারও সামনে চলে এসেছে। গত ২৭ মার্চ আদালত অবমাননায় দোষী সাব্যস্ত করে দুই মন্ত্রীকে ৫০ হাজার টাকা করে জরিমানা করেন আপিল বিভাগ। জরিমানার পর তারা মন্ত্রী হিসেবে স্বপদে থাকতে পারেন কিনা, তখন সেই প্রশ্ন উঠেছিল। এক প্রশ্নের জবাবে নিতাই রায় বলেন, তারা (মন্ত্রীদ্বয়) আইন লঙ্ঘন করেছেন এবং সংবিধানের রক্ষণ, সমর্থন ও নিরাপত্তা বিধানে তাদের শপথ ভঙ্গ করেছেন। এখন শুনলাম, প্রধানমন্ত্রীর দিকে নাকি দলের কেউ কেউ তাকিয়ে আছেন। আমার জিজ্ঞাসাÑ প্রধানমন্ত্রী কী তবে আইনের ঊর্ধ্বে?
বিএনপির এই সিনিয়র নেতা অভিযোগ করেন, রাজনৈতিক প্রতিহিংসার বশবর্তী হয়ে বর্তমান সরকার জিয়া পরিবার এবং বিএনপিকে নিশ্চিহ্ন করে দিতে চায়। এর পরিণাম ভালো হবে না বলে নিতাই রায় চৌধুরী মনে করেন। সরকার দেশকে পুলিশি রাষ্ট্রে পরিণত করেছে। বিএনপির নেতা-কর্মীদের বিরুদ্ধে একটির পর একটি মামলা দিয়ে মামলার পাহাড় গড়ে তুলেছে। ক্ষমতায় টিকে থাকার জন্য স্বৈরাচার হয়ে উঠেছে এ সরকার।
নানাপ্রতিকূল পরিস্থিতির মধ্যেও সরকারের উন্নয়ন অব্যাহত। কিন্তু বিএনপি এ রকম উন্নয়ন চায় না বলে সরকারের মন্ত্রিরা বহুবার অভিযোগ করেছেনÑ এ সংক্রান্ত এক প্রশ্নের ব্যাপারে নিতাই রায় চৌধুরীর দৃষ্টি আকর্ষণ করা হলে তিনি বলেন, উন্নয়নের নামে দেশে লুটপাট চালানো হচ্ছে। সরকার একেকটা উন্নয়ন প্রকল্প নেয়, দুই মাস, ছয়মাস, একবছর পর ওই প্রকল্প ব্যয় দ্বিগুণ-তিনগুণ হয়ে যায়। যেমনÑ পদ্মা সেতুর প্রথম ব্যয় ধরা হয়েছিল ৮ হাজার কোটি টাকা, এরপর হলো ১৮ হাজার কোটি, এখন শুনেছি বেড়ে ৩৮ হাজার কোটি কোটি টাকা হয়েছে। যেকোনো উন্নয়ন প্রকল্পের তিনগুন বেশি অর্থ ব্যয় হয়। এতে দেশের জনগণের অর্থ চুরি করা হয়। তিনি বলেন, প্রকল্প ব্যয় বাড়ার কারণটা হলো, এখানে কমিশনের ব্যাপার আছে। ওই জিনিসটা পকেটে নেয়, হিসাব-কিতাব করে তারপর প্রকল্প ব্যয় ঠিক করা হয়। এভাবেই এ সরকার উন্নয়ন কাজ করছে। রামপালে বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণের সিদ্ধান্তকে গণবিরোধী আখ্যায়িত করে বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের সিনিয়র আইনজীবী নিতাই রায় চৌধুরী বলেন, এ বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপিত হলে সুন্দরবন ধ্বংস হবে। এখানে বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপন করার কথা নিয়ে এখন গোটাজাতি উদ্বিগ্ন। এটা হবে জাতির জন্য অপূরণীয় ক্ষতি। আমরা কোনো সময় একথা বলিনি বিদ্যুৎকেন্দ্র বন্ধ করতে হবে। বিদ্যুৎ লাগবে, আমাদের প্রয়োজন আছে। সেটা এমন জায়গায় হতে হবে, যেখানে পরিবেশ ও মানুষের ক্ষতি হবে না।
রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ বন্ধের দাবিতে জনগণকে সোচ্চার হওয়ারও আহ্বান জানিয়ে তিনি বলেন, এ সরকার স্বৈরাচারী বলেই জনমত বা দেশের স্বার্থ পরোয়া করছে না। বিদ্যুৎকেন্দ্র হলে সুন্দরবনের জীববৈচিত্র্য ধ্বংস হবে, প্রাকৃতিক পরিবেশ নষ্ট হবে, পানি দূষিত হবে। জিয়াউর রহমানের স্বাধীনতা পদক প্রত্যাহার সংক্রান্ত এক প্রশ্নের জবাবে এই বিএনপি নেতা বলেন, সরকারের মন্ত্রিসভা কমিটির এ সিদ্ধান্ত অনৈতিক, আত্মঘাতী ও দুর্ভাগ্যজনক। দেশে বহুদলীয় গণতন্ত্র ও মুক্তবাজার অর্থনীতির সূচনা করেছিলেন জিয়াউর রহমান। পদক প্রত্যাহার করে নিলে বিভাজনের রাজনীতি আরও উত্তপ্ত হবে, ভয়ঙ্কর হবে। আওয়ামী লীগের হীনমন্যতার পরিচয় বা নিচুমনের পরিচয় ফুটে ওঠে তাদের কাজকর্মে। স্বাধীনতা পদক প্রবর্তন করেছিলেন শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান। এখন তার স্বাধীনতার সম্মাননার পদক ছিনিয়ে নেওয়ার ষড়যন্ত্র করা হচ্ছে। জিয়াউর রহমান স্বাধীনতার ঘোষণা দিয়েছেন, সরাসরি যুদ্ধ করেছেন এটাই চিরসত্য। বর্তমান সরকারের বিভিন্ন সিদ্ধান্তের কঠোর সমালোচনা করে নিতাই রায় চৌধুরী বলেন, আওয়ামী লীগ কোনোকালেই গণতন্ত্র বিশ্বস করে না, ধারণও করে না। আর এ সরকার কতবড় স্বৈরাচার, কতবড় দুর্নীতিগ্রস্ত তা জনগণ জানে। বিএনপি জনগণের কথা বলে। আর এ দলকে জনগণ বিশ্বাসও করে। সুখ-শান্তি-ন্যায়বিচার-আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা ও গণতন্ত্রের ধারাকে সমুন্নত রেখেছে কেবল বিএনপি, আর কেউ নয়। জনগণ পছন্দ করে বলেই তারা বিএনপিকে ধ্বংস করতে চায়। আওয়ামী লীগ সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের সদস্যদের ওপর নির্যাতন করছে, দখলবাজি করছে। সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের পরিবারগুলো এখন অসহায়। আমি বলবÑ ধর্ম নিয়ে রাজনীতিও আওয়ামী লীগই করছে। হিন্দুদের বাড়ি দখল, প্রতিমা ভাংচুর, বাড়ি জমিও দখল করছে তারা। লুটপাট, হত্যা, গুম, সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে বিচার পায় না। সাক্ষী দিতে পারে না ভয়ে। তারা ন্যায়বিচার পাচ্ছে না, কারণÑ দখল আর চাঁদাবাজির সঙ্গে যুক্ত সন্ত্রাসীরা এ সরকারের আশ্রয়ে। আইনের শাসন না থাকলে যা হয়Ñ তাই হচ্ছে। এ দল কখনো গণতান্ত্রিক নয়। ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ যে রাজনীতি করছে, তাতে তারা দেশকে ধ্বংসের দিকে নিয়ে যাচ্ছে। বর্তমান সরকার আমলে বিনাবিচারে হত্যা, ক্রসফায়ার সংক্রান্ত বিষয়ে তিনি বলেন, দেশে আইন আছে, আদালত আছে, জিজ্ঞাসাবাদ করবে। আদালতে যা সাজা হবে, তা-ই হবে। বর্তমান সরকার তো কথায় কথায়, কিছুদিন পরপর জঙ্গি ধুয়া তোলে। তারা বলে থাকে অমুক জায়গায় জঙ্গি আছে, এতজন জঙ্গি পাওয়া গেছে। আমাদের আমলে সরকার শায়খ আবদুর রহমানসহ তাদের বড় বড় নেতাদের জীবিত অবস্থায় ধরেছে। জীবিত ধরার কারণ এটাই, তাদের কাছ থেকে সত্যিকার তথ্য বের করা।
নিতাই রায় চৌধুরী বলেন, অত্যাচার, নির্যাতন-নিপীড়নের বিরুদ্ধে সবাইকে রাজপথের গণ-আন্দোলনে শামিল হতে হবে। এই সরকার যতদিন থাকবে, অত্যাচার ও নির্যাতন তত বাড়বে। সাবেক এ মন্ত্রী আরো বলেন, এই সরকার ভোটারবিহীন নির্বাচনের সরকার। ক্ষমতায় টিকে থাকার জন্য সবরকম বেআইনি ও গণবিরোধী সিদ্ধান্ত নিচ্ছে, বাস্তবায়ন করছে। ভোটের আগে তারা বলেছেÑ সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতার জন্য তারা নির্বাচন করছেÑ আর এখন বলছে ২০১৯ সালের আগে আর নির্বাচন হবে না। দেশবাসী জানে, ৫ জানুয়ারির ভোটারবিহীন নির্বাচনের মাধ্যমে ক্ষমতা দখলকারী একটি অবৈধ সরকার এটি। যে সরকারের ১৫৪ জন এমপি অনির্বাচিত, সে সরকারের কোনো বৈধতা থাকে না। তিনি বলেন, পৃথিবীর ইতিহাসে সবচেয়ে জনসমর্থনহীন এ সরকার। সম্পাদনা: আশিক রহমান
