
জগন্নাথের শিক্ষার্থীরা ভবিষ্যতের জন্য আন্দোলন করছে
জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা যে আন্দোলনটি করছে, তার অনন্য দিকটি হচ্ছে, এরা কেউ নিজেদের জন্য এ সংগ্রামটি করছে না। কালই যদি ছাত্রাবাস নির্মাণের কাজটা শুরু হয়, এরা কেউ তা ভোগ করবে না। তাহলে কেন দিনের পর দিন ছাত্রলীগের পিটুনি খেয়ে, কর্তৃপক্ষের দাবড়ানি খেয়ে, পুলিশের লাঠির বাড়ি আর কাদানে গ্যাস হজম করে তারা এই আন্দোলনটি করছে?
এইখানে মানবচরিত্রের একটা দারুণ আশাবাদের দিক আছে। ঢাকা শহরে নোংরা, ঘিঞ্জি, অস্বাস্থ্যকর, ব্যয়বহুল এবং অপমানকর মেস জীবনের যন্ত্রণা তারা সয়েছেন। সয়েছেন প্রতিদিন বাসে ঝুলে দীর্ঘ ক্লান্তিকর সময় ক্ষেপণের ভ্রমণের অভিজ্ঞতা। সয়েছেন জঙ্গি দমনের নামে ভাড়া বাসাতেও তাদের ওপর হাঙ্গামার উৎপাত। গৃহস্থবাড়ির দ্বিগুন তিনগুন বেশি টাকা দিয়ে থেকেছেন, খাবারের নেই ঠিক-ঠিকানা। কিন্তু এই বিশ্ববিদ্যালয়ে তাদের পরে যারা আসবেন, তাদেরও জন্য একই পরিণতি মেনে নিতে পারেননি। তাই তারা আন্দোলনে নেমেছেন। তাদের এই দরদ প্রতিষ্ঠানটির যারা আত্মা, সেই শিক্ষার্থীদের জন্য। তাদের এই আন্দোলনকে যারা থামাতে চান, তারা প্রতিষ্ঠানটির কর্তৃপক্ষ।
তাদের ক্ষোভ আর যন্ত্রণা যে আন্দোলন আকারে থেকে থেকে জেগে ওঠে, তা কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয় নামের প্রতিষ্ঠানটিকে বিশ্ববিদ্যালয়ের চেহারা দেওয়ারই আন্দোলন। আবাসিক সুবিধা ছাড়া কিভাবে বিশ্ববিদ্যালয় হয়? গবেষণা, পাঠাগার এইসব ছাড়া কিভাবে বিশ্ববিদ্যালয় কার্যকর হয়? মনে আছে, জগন্নাথের ছাত্র দিদার মাস্তুয়ালরা যখন পড়াশোনার শেষ পর্যায়ে, ২০০৯ সালে মেসে থাকব না, ছাত্রাবাস ছাড়া ফিরব না এইসব দাবি নিয়ে আন্দোলন শুরু করল, কি ব্যাপক নির্যাতন তাদের ওপর হয়েছিল।
এই আন্দোলনগুলো থেকে আর একটা বিষয় স্পষ্ট হয়। কেন ছাত্র সংসদ নির্বাচন হয় না। কারণটা তো খুব সোজা, ছাত্র সংসদ নির্বাচন হলে শিক্ষার্থীদের এ দাবির পক্ষের সংগঠকরাই অনায়াসে জিতে আসবেন। ছাত্ররা প্রাণ খুলে কথা বলবেন সুন্দরবন নিয়ে, অর্থনীতির লুটপাট নিয়ে। অথচ নির্বাচনটা না দিলে দিব্যি দখলে রাখা যায়, ছাত্রদের বশে রাখা যায়Ñ দল আর লীগ যারই আমল হোক।
বর্তমান আন্দোলনের দাবি কোনো অনুনয় বিনয়ের দাবি নয়। শিক্ষার্থীদের ন্যায্য পাওনার দাবি। তাদের জন্য ছাত্রাবাস দিতে হবে। তারা সমাধানও দেখিয়ে দিয়েছেÑ কেন্দ্রীয় কারাগারের পরিত্যক্ত স্থানেই অনায়াসে দুটো সুউচ্চ দালানে নারী আর পুরুষ শিক্ষার্থীদের জন্য দুটো ছাত্রাবাস নির্মাণ করা যায়। ৩৬ একর, মানে একশ বিঘারও বেশি জায়গাজুড়ে থাকা বাকি স্থানটাতে উদ্যান, খেলার মাঠ, বাগান, জাদুঘর নির্মাণ করা যেতে পারে। যারা এই দাবির বিরোধিতা করছেন, তাদের মাঝে নিশ্চয়ই কেউ কেউ আন্তরিকভাবেই পুরো স্থানটিই খোলা পরিসর হিসেবে চাচ্ছেন। কিন্তু বাস্তবে আশঙ্কার দিকটি হচ্ছে, পুরনো ঢাকার দখলদাররা এই জায়গাও গিলে খেতে তৎপর। তাদের সামনে বাধা হিসেবে এসেছে এখানে ছাত্রাবাস করার প্রস্তাবÑ সেক্ষেত্রে বাকি এলাকাগুলোও তারা আর সহজে দখল করতে পারবে না। আমার মনে হয়, খোলা পরিসর হিসেবে এই স্থানটিকে রক্ষার সবচেয়ে বড় নিশ্চয়তা হতে পারে সেখানকার অন্তত একটা অংশে ছাত্রাবাস নির্মাণ এবং বাকি স্থানটাকে স্থানীয়দের ব্যবহার করতে পারার শর্তে বিশ্ববিদ্যালয়েরই তদারকিতে প্রদান।
পরিত্যক্ত কেন্দ্রীয় জেলখানাতে অন্যকোনো স্থাপনা, যেমনÑ বাজার, দোকানপাট, বিপনীবিতান বা আবাসন বানাবার বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতে হবে। এবং সেই কাজটাও জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের এই আন্দোলনের একটা অন্যতম দাবি।
আবু তাহের বকুল নামের পুরনো ঢাকাবাসী একজন অভিভাবকের কথা শুনে খুব ভালো লাগল। তিনি জগন্নাথের সাবেক শিক্ষার্থী, জোর দিয়ে বললেন, খুব সামান্য কিছু মানুষ জগন্নাথের শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের বিরোধিতা করছেন। কেননা জগন্নাথ পুরনো ঢাকার গর্ব, সেখানকার অনেক শিক্ষিত মানুষই এই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানেই পড়াশোনা করেছেন। তাদের দাবির প্রতি তাদের পূর্ণ সহানুভূতি আছে। কেবল আওয়ামী লীগের নেতাদের চাপেই তারা মুখ খুলতে পারছেন না।
জগন্নাথের শিক্ষার্থীরাও ইতিহাসে লিখে রাখার মতো একটা তৎপরতা শুরু করেছেন। তারা পুরনো ঢাকার বাড়ি বাড়ি যাচ্ছেন, যাচ্ছেন দোকানে দোকানে। কথা বলছেন তাদের সঙ্গে, আলোচনা করছেন কেন তাদের দাবির সঙ্গে পুরনো ঢাকাবাসীর দাবির কোনো তফাত নেই। ছাত্রাবাস হলে যে সন্ত্রাসী তৎপতরতার ভয় দেখানো হচ্ছে, পুরনো ঢাকা আসলে সেই সন্ত্রাসী দখলের রাজত্বে এমনিতেই আছে। কিন্তু যদি গণতান্ত্রিক নির্বাচনের ভিত্তিতে ছাত্র সংসদ হয়, হয় নিয়মিত সাংস্কৃতিক কার্যক্রম, এমন কয়েকটি ছাত্রাবাস পুরনো ঢাকাকে করে তুলবে একটা শিক্ষা নগরী, সংস্কৃতির কেন্দ্র।
