
এগিয়ে যাচ্ছে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়
অধ্যাপক ড. মীজানুর রহমান
জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের যাত্রা দেশের অন্যান্য পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ব্যতিক্রমী। এর কারণ প্রায় সবক্ষেত্রেই সব পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপনের আগেই জমি অধিগ্রহণ করে সেখানে ভবন নির্মাণ তথা অবকাঠামোগত বিষয়াবলি নিশ্চিত করার পরই একাডেমিক কার্যক্রম শুরু হয়। কিন্তু এই ধারাবাহিকতা থেকে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় সম্পূর্ণ ভিন্ন। শিক্ষার্থীদের সংখ্যার দিক থেকে সবচেয়ে বড় ছিল জগন্নাথ কলেজ। এই কলেজকে ২০০৫ সালে বিশ্ববিদ্যালয়ে রূপান্তর করা হয়।
২০১৩ সালের ২০ মার্চ আমি জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ে উপাচার্য হিসেবে যোগদান করেছি। এসময়ের মধ্যে বিশ্ববিদ্যালয়ের উল্লেখযোগ্য অনেক কাজই সম্পন্ন হয়েছে। তিন বছর আগে উপাচার্য হিসেবে যোগদান করার পর আমি এই বিশ্ববিদ্যালয়ের সাংস্কৃতিক পরিবর্তনকে প্রধান সমস্যা হিসেবে গণ্য করি। কলেজ থেকে যখন বিশ্ববিদ্যালয়ে রূপান্তর করা হয়, তখন কেবল কলেজের পুরানো কিছু ভবন, আসবাব, বইপত্র, এর সঙ্গে কিছু শিক্ষার্থী-শিক্ষক আর কলেজ সংস্কৃতিই এখানে ছিল। বিশ্ববিদ্যালয় হওয়ার পরও কলেজের শিক্ষার্থী-শিক্ষক থাকার কারণে তাদের পঠন-পাঠন এবং সম্পর্কের ধারাবাহিকতায় এক ধরনের কলেজের ছোঁয়া ছিল। পরিপূর্ণ বিশ্ববিদ্যালয়ের একাডেমিক কার্যক্রমের মধ্যে যেসব বৈশিষ্ট্য পরিস্ফুটিত হয়, তার রূপান্তর প্রক্রিয়া শুরু হয় আমি যোগদানের আগে থেকেই, তবে গতি ছিল মন্থর। শিক্ষার্থী-শিক্ষক, বিশ্ববিদ্যালয় পরিবারের কর্মকর্তা-কর্মচারীসহ সকলের ঐকান্তিক প্রচেষ্টায় গত তিন বছরে সে অবস্থার অভূতপূর্ব উন্নতি সাধিত হয়েছে। সময়ের বিবর্তনে কলেজের সংস্কৃতি থেকে আস্তে আস্তে বিশ্ববিদ্যালয়ের সংস্কৃতিতে রূপান্তরিত হয়েছে। ২০০৫ সাল বা তার আগে থেকে যারা কলেজের শিক্ষক ছিলেন, তাদের কয়েকজন বর্তমানে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ে আছেন, তারা অকপটে স্বীকার করেন আমরা কলেজ থেকে বিশ্ববিদ্যালয়ে উত্তরণ করতে পেরেছি। সবচেয়ে বড় বিষয়, এই শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বিশ্ববিদ্যালয়ের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্যে পূরণের পথে ধাবিত হচ্ছে। উপাচার্য হিসেবে যোগদানের পর থেকে নতুন বিশ্ববিদ্যালয়কে গড়ে তোলার জন্য আমি সাধ্যমতো চেষ্টা করছি।
২. কলেজ এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে বড় পার্থক্য হচ্ছে, কলেজে কেবল জ্ঞান বিতরণ করে অর্থাৎ পাঠদান করা হয়। আর বিশ্ববিদ্যালয়ে কেবল জ্ঞান বিতরণ নয়, জ্ঞান অনুসন্ধান ও আহরণ করতে হয়। জ্ঞান আহরণের বিষয়টা একান্তই গবেষণার ওপর নির্ভরশীল। গবেষণা ছাড়া নতুন জ্ঞান সৃষ্টির কোনো সুযোগ নেই। গবেষণার কাজটা বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ। বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষণা একাডেমিক আদলে প্রচলিত। বর্তমানে এই জ্ঞান আহরণের কাজটি জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ে সমান তালে হচ্ছে। গবেষণা কর্মকা- বলতে যা বোঝায় তা আগে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ে ছিল না। গত তিন বছরে আমরা এইসব গবেষণা কর্মকা- ধীরে ধীরে দাঁড় করিয়েছি। এমফিল এবং পিএইচডি প্রোগ্রাম চালু করা হয়েছে। এইসব প্রোগ্রামের মাধ্যমে শিক্ষার্থীরা গবেষণা করছে এবং শিক্ষকরা তাদের তত্ত্বাবধায়কের দায়িত্বপালন করছেন। এভাবেই জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ে গবেষণা কর্মকা- চালু হয়। ইতোমধ্যে আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ে বিভিন্ন বিভাগে এমফিল এবং পিএইচডি প্রোগ্রামে প্রায় একশ শিক্ষার্থী কাজ করছেন। এর বাইরেও শিক্ষকদের ব্যক্তিগতভাবে পরিচালিত প্রকল্পে বিশ্ববিদ্যালয়ের ডেভেলপমেন্ট প্রোগ্রাম এবং বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন থেকে অর্থ বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। সেই গবেষণা কর্মকা-ের কয়েকটি ইতোমধ্যে সম্পন্ন হয়েছে এবং বাকিগুলো সমাপ্তির পথে রয়েছে। পাইপ লাইনে আরও কতকগুলো গবেষণা কর্ম পরিচালনার জন্য আমরা উদ্যোগ গ্রহণ করেছি। উচ্চশিক্ষা গ্রহণে শিক্ষকদের বাইরে যাচ্ছেন এবং ডিগ্রি নিয়ে ফিরে আসছেন, ফলে জগন্নাথের একাডেমিক পরিবেশ ক্রমান্বয়ে উন্নত হচ্ছে।
বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার মানোন্নয়ন নির্ভর করে শিক্ষার্থী এবং শিক্ষকদের মানের উপর। আমাদের সবচেয়ে বড় অর্জন হলো এই বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি প্রক্রিয়া সম্পূর্ণ ত্রুটিমুক্ত। ডিজিটাল পদ্ধতি অবলম্বনের মাধ্যমেই তা সম্ভব হয়েছে। দেশের সেরা মেধাবী শিক্ষার্থীদেরকে আমরা এই বিশ্ববিদ্যালয়ে পাচ্ছি। কারণ আমাদের ভর্তি পরীক্ষার মধ্যে ডিজিটাল জালিয়াতিসহ যে ত্রুটিবিচ্যুতিগুলো ছিল, সেগুলো বিভিন্নভাবে আমরা উত্তরণ ঘটিয়েছি। অনেকে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষাকে অনুকরণীয়ও বলেন। অনেক বিশ্ববিদ্যালয় আমাদের ভর্তি পরীক্ষার পদ্ধতি সম্পর্কে জানছে এবং শিখছে। জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষার পদ্ধতি খুবই কার্যকর তার প্রমাণ মিলছে। বিশ্ববিদ্যালয় থেকে কয়েকটি ব্যাচ বের হয়ে চাকরি করছে। বিসিএস পরীক্ষায় ভালো রেজাল্ট করে কর্মসংস্থান হয়েছে অনেকেরই। এদিক থেকেও ভালো অবস্থানে জগন্নাথ।
৩. একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য বড় বিষয়Ñ একাডেমিক ডেভেলপমেন্ট, শিক্ষকদের সংখ্যা সেটা ইতোমধ্যে কিছুটা হলেও পূরণ করতে পেরেছি। জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ে সবচেয়ে বড় সমস্যা ছিল শিক্ষকের সংখ্যা নিয়ে। তিন বছর আগে আমি যখন উপাচার্য হিসেবে যোগদান করি, তখন বিশ্ববিদ্যালয়ের কোনো কোনো বিভাগে দুইজন তিনজন শিক্ষকও ছিলেন। অনেক শিক্ষার্থী কিন্তু শিক্ষক চারজন। অন্যান্য পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের তুলনায় শিক্ষার্থী এবং শিক্ষকের অনুপাতটি একেবারেই অসামঞ্জস্যপূর্ণ ছিল। সেক্ষেত্রে আমরা এখন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকের সংখ্যা বাড়িয়েছি। এখন প্রায় ৫৭০ জনের মতো শিক্ষক রয়েছেন। তিন বছর আগে এ সংখ্যা ছিল ৩০০ জন।
আর একটি তাৎপর্যপূর্ণ ঘটনা সবচেয়ে মেধাবী এবং যোগ্যতাসম্পন্নরাই এখানে শিক্ষক হিসেবে আছেন। জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় এখন কম পরিচিত একটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান নয়। দিনদিন এ বিশ্ববিদ্যালয় দেশে পরিচিতি এবং সুনাম অর্জন করছে। সাধারণ বিশ্ববিদ্যালয় হিসেবে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় রাজধানীর বুকে দ্বিতীয় পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়। সেক্ষেত্রে শিক্ষক হওয়ার জন্য বা শিক্ষকতা করার জন্য পছন্দের তালিকায় প্রথম দুই তিনটির মধ্যে এখন জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় রয়েছে। আমাদের পদার্থবিজ্ঞান বিভাগে ১৮ জন শিক্ষকের মধ্যে নয়জনের পিএইচডি ডিগ্রি আছে। বাকি ছয়জন এখন পিএইচডি ডিগ্রি করছেন। এই একই অবস্থা রসায়ন বিভাগে বিরাজ করছে। অনেক বিভাগে পিএইচডি ডিগ্রিধারীরাই নতুন শিক্ষক হচ্ছেন। যারা নতুন তাদের রেজাল্ট ভালো। এতে তারা সহজে স্কলারশিপ পাচ্ছেন। প্রায় একশ জনের মতো শিক্ষক এখন আমেরিকা, অস্ট্রেলিয়া, কানাডা, ইউরোপ, কোরিয়া, জাপান এবং চীনে পিএইচডি ডিগ্রি অর্জন করছেন। অনেকে ডিগ্রি অর্জন করে ফিরে এসেছেন। কাজেই এখন শিক্ষার্থী এবং শিক্ষকের মধ্যে ভালো মিথষ্ক্রিয়া হচ্ছে এবং হবে। ভালো ডিগ্রিধারী শিক্ষক এবং মেধাবী শিক্ষার্থীÑ এই দুইটি বিষয়ে যখন সম্মিলন ঘটছে বা ঘটতে যাচ্ছে, তখন আমরা আশা করব নিঃসন্দেহে আমাদের শিক্ষার মান বাড়ছে। শিক্ষার মান নিয়ে যারা দ্বিধান্বিত বোধ করেন, এতে করে আমরা তাদেরকে আশ্বস্ত করতে পারব। সবদিক থেকে একাডেমিক মান ক্রমান্বয়ে অগ্রগতির দিকে ধাবিত হচ্ছে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের। যদিও দেশের প্রাচীন ও বৃহত্তম বিশ্ববিদ্যালয় হওয়ার সম্ভাবনা নেই; তবে একাডেমিক উৎকর্ষ বৃদ্ধি করলে এটি বড় বিশ্ববিদ্যালয় হতে পারে; জ্ঞান বিতরণ ও জ্ঞান আহরণের শ্রেষ্ঠ কেন্দ্র হিসেবে পরিণত করা যেতে পারে। বর্তমানে এই বিশ্ববিদ্যালয়ে ৩৮টি স্নাতক ও স্নাতকোত্তর কোর্স আছে।
লেখক: উপাচার্য, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়
সম্পাদনা: জব্বার হোসেন
