কেন গ্রাম পাঠাগার আন্দোলন?
প্রায়শই আমাদের একটি প্রশ্ন শুনতে হয়Ñ মানুষ কি এখন বই পড়ে? স্বভাবতই আমার উত্তর হয়, না। তাহলে পাঠাগার আন্দোলন করছেন কেন, মানুষ যদি বই না-ই পড়ে? যারা এ ধরনের প্রশ্ন করেন, তাদের কাছে বিনীত প্রশ্নÑ মানুষ কেন বই পড়বে? অজানাকে জানার জন্য, শেখার জন্য। ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি, সমাজের প্রতি তার যে দায় রয়েছে, তা বোঝার জন্য, বোধ সম্পন্ন মানুষ হওয়ার জন্যই বই পড়তে হবে। দায়বোধ জাগরণের জন্য বই পড়া জরুরিÑ সত্যিই কী তাই? অন্যকোনোভাবে কি সমাজের দায়িত্ব পালন করা যায় না? যায়। দায়িত্ববোধ জন্মাতে পারে না? পারে।
পড়ালেখার পাশাপাশি বিভিন্ন কাজে অংশগ্রহণ করা। যারা পড়ালেখা জানেন, তারা কৃষকদের পরামর্শক হতে পারেন, বৃক্ষরোপণ করতে পারেন, পাঠাগারও প্রতিষ্ঠা করা যেতে পারেÑ এমন অনেক কাজ রয়েছে যা পরিবার ও সমাজের কল্যাণ হয়, তেমন কর্মকা-ে নিজেকে যুক্ত করা। দায়িত্ব নেওয়া। জনহিতকর কর্মকা-ে যুক্ত হলে, সম্পৃক্ত হলে দায়িত্ববোধ সম্পর্কে মানুষ ধারণা লাভ করে। দায়িত্ব নিতে শিখে। দায়িত্ববান হয়ে ওঠে।
আশি-নব্বইয়ের দশক পর্যন্ত মানুষ অনেক বেশি বই পড়ত। গ্রামের পাড়ায় পাড়ায় পাঠাগার ছিল। শহরও কি ব্যতিক্রম ছিল? ছিল না। জমজমাট ছিল পাঠাগার কেন্দ্রিক সাহিত্য আসরগুলোও। ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনের সময় ছেলেমেয়েরা শরীরের ফিটনেস বাড়ানোর জন্য পাড়ায় পাড়ায় গড়ে তুলত ব্যায়ামাগার, একই সঙ্গে মন আর মস্তিষ্কের সক্ষমতা বৃদ্ধির জন্য গড়ে তুলত পাঠাগার। আগে সমাজ গঠনে এসব পাঠাগারের ছিল প্রচ- প্রভাব। তাহলে আজকে পাঠাগারগুলো কেন পারছে না পাঠক ধরে রাখতে বা পাঠক তৈরি করতে? দায় কি শুধু আকাশ সংস্কৃতির? এর উত্তর পেতে হলে অনেক প্রশ্নই সামনে চলে আসবে। আগে মানুষ কেন বই পড়ত, এখনই বা কেন একরকম বইবিমুখ?
বই পড়ার প্রতি আগে মানুষের আগ্রহের কিছু কারণ মোটামুটি এ রকমÑ ১. বই বিনোদনের একমাত্র মাধ্যম: উঠতি মধ্যবিত্ত বাঙালির বিনোদনের তেমন কিছু ছিল না। কোনো কোনো গ্রামে দু’একটি পরিবারে রেডিও, টেলিভিশন থাকত সবেধন নীলমণির মতো। সপ্তাহের বিশেষ দিনে হয়তো দেখা হতো, তাও মাত্র কয়েক ঘণ্টা ব্যাপার ছিল। বিদুৎ ব্যবস্থাও ভালো ছিল না। ফলে বিনোদনের জন্য সদ্য শিক্ষিত হয়ে ওঠা পরিবারের সদস্যদের বই ছাড়া অন্যকোনো সুযোগ ছিল না বললেই চলে। ২. হৃদয় আদানপ্রদানে বই: হৃদয়ের লেনদেন বা মনের মানুষের সঙ্গে যোগাযোগ করার জন্য এখনকার মতো মুঠোফোন, ফেসবুক, ভিডিও চ্যাটিং ব্যবস্থা তখন ছিল না। চিঠিই ছিল একমাত্র মাধ্যম। চিঠিতে মনের ভাবপ্রকাশের জন্য প্রয়োজন জ্ঞান, বিভিন্ন বিষয়ে জানা, তা না হলে উপযুক্ত, বাক্য চয়নে হৃদয়ের কথা বলা কঠিন ব্যাপার। আর যাই হোকÑ প্রিয় মানুষকে তো সন্তুষ্ট করতে হবে। ৩. রাজনৈতিক নেতাদের বইপ্রেম: বেয়াদবি করে বা কারও মাথা ফাটিয়ে বড় ভাইয়ের দৃষ্টি আকর্ষণ করে নেতা হওয়ার এখনকার যে রীতি ওই সময় তা ছিল না। তখন বই পড়েই তাকে যোগ্য হতে হতো। রাজনীতির হাতেখড়ি হতো তখন কারাগার। কারণ তখনকার দিনে বড় বড় নেতাদের ঘড়বাড়িই ছিল কারাগার। কখনো কোনো কর্মী-সমর্থক কারাগারে পেলে হাতে-কলমে অনেক কিছু শেখাতেন পড়ালেখা জানা নেতারা। ফলে বই পড়ার একটা ক্ষুধা সারাজীবনভর তার লেগেই থাকত। ৪. বইয়ে আভিজাত্য প্রকাশ: দেখা গেলÑ একসঙ্গে অনেকদিন পর বন্ধুরা আড্ডা দিচ্ছে। বই তখন প্রায় প্রাসঙ্গিক। বই নিয়ে কেউ না কেউ আলোচনা তুলবেই। ওই আলোচনায় অংশ নিতে হলে কিছু না কিছু জানতে হয়। জানতে হলে পড়তে হবে। তা না হলে জাত যাওয়ার সম্ভবনা প্রবল! কিন্তু এখন আভিজ্য প্রকাশের বড় মাধ্যম হচ্ছেÑ নতুন মডেলের মুঠোফোন, নতুন নতুন জিজাইনের পোশাক ইত্যাদি। বইয়ের পাঠক তৈরি হওয়ার সেই পরিবে-পরিস্থিতি এখন নেই বললেই চলে। ফল, পাঠকের সংখ্যাও দিনদিন কমে যাচ্ছে। এখন যারা বই পড়ছেন অনেকটা বংশগত কারণে, বই পড়ার পারিবারিক ঐতিহ্য রয়েছে বলেই হয়তো বই পড়ছেন। এই সংখ্যাও খুব কম।
বিশ্ব এখন হাতের মুঠোয়। যখন যে তথ্যের প্রয়োজন পড়ে তা নিমিষের মধ্যেই সংগ্রহ করা যায়। এই অবস্থায় বই পড়তে বলা অনেকটা গঙ্গার জলকে ঘুড়িয়ে হিমালয়ের দিকে প্রবাহিত করার মতো। তাহলে কী বই পড়ার প্রয়োজনীয়তা ফুরিয়ে গেছে, ফুরিয়ে গেছে পাঠাগার স্থাপন করার আন্দোলন? ফুরায়নি তবে তা অন্য ব্যাখ্যায়। প্রচলিত পাঠাগার যে ধারণায় প্রতিষ্ঠিত, তার পরিবর্তন আনতে হবে। আনতে হবে দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তনও।
বই মানুষ কেন পড়ে? বই পড়ে তার ভিতরে শুভবোধকে জাগিয়ে তোলার জন্য। ভালো ও মন্দের তফাৎ বোঝার জন্য, সে যে প্রকৃতির একটা অংশ সেটা বোঝার জন্য। মোটকথা আমার আমিকে চেনার জন্য। হ্যাঁ, এসবের জন্য বই হয়তো একটা মাধ্যম হতে পারে কিন্তু একমাত্র মাধ্যম তা বলছি না।
শুভবোধ জাগানোর জন্য আরও নানা মাধ্যম আছে। পাঠাগারকে স্থাপনের সময় সেদিকেও খেয়াল রাখতে হবে। সমাজের চাহিদা, প্রয়োজন ইত্যাদি মাথায় রেখে তার কার্যক্রম হাতে নিতে হবে, বাস্তবায়নের জন্য নিতে হবে টেকসই স্থানীয় প্রযুক্তি।
সম্পাদনা: আশিক রহমান