বিচার বিবেচনা না করে রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ গ্রহণযোগ্য হতে পারে না
কল্লোল মোস্তফা
রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্র নিয়ে আলোচনায় বাংলাদেশের অর্থনীতির একটি গুরত্বপূর্ণ বিষয় এখনও উপেক্ষিত রয়ে গেছেÑ চিংড়ি, কাকড়া উৎপাদন ও প্রক্রিয়াজাতকরণ শিল্পের উপর রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্রের সম্ভাব্য ক্ষতিকর প্রভাব। এ বিষয়ে আমাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছেন যিনি, তিনি চিংড়ি ও কাকড়া চাষাবাদ ও প্রক্রিয়াজাতকরণ শিল্পের একজন বিশেষজ্ঞ। যুক্তরাজ্য থেকে ফিস ও ফুড টেকনোলজি বিষয়ে পড়াশোনা করেছেন, দেশে বিভিন্ন ইনস্টিটিউটে এ বিষয়ে পড়াচ্ছেন এবং নিজেও ব্যবসায়িকভাবে এই শিল্পের সঙ্গে যুক্ত। শ্রীম্প ইন্ডাস্ট্রি ডেভেলপমেন্ট কমিটি, বাংলাদেশ ফ্রোজেন ফুডস এক্সপোটার্স এসোসিয়েশনের একজন সামনের সারির নেতা। ২০ আগস্ট শহীদ মিনারে রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্র বাতিলের দাবিতে যে সাংস্কৃতিক সমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়, সেখানে তিনি সংহতি জানাতে আসেন। সঙ্গে নিয়ে আসেন তার বক্তব্যের স্বপক্ষে একগাদা কাগজপত্র যার মধ্যে রয়েছেÑ বিশ্ব খাদ্যসংস্থা বা এফএও এর ফিসারিজ ও একুয়াকালচার টেকনিক্যাল পেপার, চিংড়ি ও কাকড়া চাষের অনুকূল পরিবেশ সংক্রান্ত কাগজপত্র, ফিসারিজ স্ট্যাটিসটিক্যাল রিপোর্ট, তার নিজ হাতে লেখা নোট ইত্যাদি।
তার বক্তব্য হলো, বাংলাদেশের গলদা ও বাগদা চিংড়ি উৎপাদনের প্রায় ৯০ শতাংশ খুলনা, রামপাল, বাগেরহাট, পাইকগাছা, সাতক্ষীরা অঞ্চলের। চিংড়ির জন্য প্রয়োজনীয় প্রাকৃতিক খাদ্য সুন্দরবন ও তৎসংলগ্ন স্থানেই উৎপাদিত হয়। সুন্দরবন অঞ্চল থেকে সংগৃহীত মা চিংড়ি ও পোনা চিংড়ির উপর বাণিজ্যিক চিংড়ি চাষাবাদ নির্ভরশীল। অন্যদিকে বাংলাদেশের মিষ্টি পানিতে ৪টি এবং নোনা পানিতে ১১ প্রজাতির মোট ১৫ প্রজাতির কাকড়া পাওয়া যায়। নোনা পানির ১১টি প্রজাতির প্রায় সবগুলোরই বসবাস সুন্দরবন অঞ্চলে এবং বনের পরিবেশে তৈরি খাদ্য খেয়ে বনকে ঘিরেই আশপাশে বসবাস করে। এদের মধ্যে বিশ্বখ্যাত শীল কাকড়া সুন্দরবনেই মেলে এবং এই স্পেসিসটাই মূলত বাংলাদেশ থেকে রপ্তানি হয়ে থাকে।
এই চিংড়ি এবং কাকড়ার প্রজনন, বংশবৃদ্ধি, বেড়ে ওঠা ইত্যাদির জন্য সুনির্দিষ্ট প্রাকৃতিক পরিবেশ প্রয়োজন যা সুন্দরবনে এখন পর্যন্ত রয়েছে বলেই এগুলো প্রাকৃতিকভাবে সুন্দরবন অঞ্চলে পাওয়া যায়Ñ যার উপর ভিত্তি করে এইসব চাষাবাদ ও শিল্প গড়ে উঠেছে। যেমনÑ কাকড়ার জন্য পানির তাপমাত্রা ২৫ থেকে ৩৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস, দ্রবীভূত অক্সিজেন ৫ এর বেশি, পিএইচ ৭.৫ থেকে ৯, হাইড্রোজেন সালফাইড ০.১ পিপিএম এর কম থাকতে হয়। আর চিংড়ির ক্ষেত্রে পানির তাপমাত্র ২৬ থেকে ৩৩ ডিগ্রি সেলসিয়াস, দ্রবীভূত অক্সিজেন ৩-১২, পিএইচ ৭.৫-৮.৭, পারদ ০.০০২৫ পিপিএম এর কম, ক্যাডমিয়াম ০.১৫ পিপিএম এর কম থাকতে হয়। এরকম আরও বহু প্যারামিটার রয়েছে।
সেই চিংড়ি ও কাকড়া বিশেষজ্ঞের প্রশ্ন হলো, রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্র থেকে স্বাভাবিকের চেয়ে ২ থেকে ৪ ডিগ্রি বেশি তাপমাত্রার পানি নির্গমন হলে এবং সেই পানিতে মারকারি/ক্যাডমিয়ামের মতো বিষাক্ত ভারি ধাতু থেকে গেলে সুন্দরবন অঞ্চলের মৎস বিশেষ করে চিংড়ি ও কাকড়া এবং এদের খাদ্য উপাদান যেমনÑ প্ল্যাংকটনের উপর কি ধরনের প্রভাব ফেলবে এটা কি কেউ যাচাই করে দেখেছে? উনার বক্তব্য হলো, ২০১৩-১৪ সালে বাংলাদেশ থেকে কাকড়া রপ্তানি হয় ৭ হাজার ৭০৭ মেট্রিক টন ও বৈদেশিক মুদ্রা আয় হয় ১৬৫ কোটি টাকা এবং চিংড়ি রপ্তানি হয় ৪ লক্ষ ৭৬ হাজার টন ও বৈদেশিক মুদ্রা আয় হয় ৪ হাজার ১১৮ কোটি টাকা যার উপর প্রায় ১ কোটি ১২ লক্ষ মানুষের জীবিকা প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে নির্ভরশীল। এরকম একটি গুরুত্বপূর্ণ ক্ষেত্রের উপর কয়লাভিত্তিক তাপ বিদ্যুৎকেন্দ্রের দীর্ঘমেয়াদি প্রভাব কি পড়বে তা যথাযথভাবে বিচার বিবেচনা না করে রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ গ্রহণযোগ্য হতে পারে না।
লেখক: প্রকৌশলী ও গবেষক