জিয়ার নামে হল কেন?
কিছুটা দেরিতে হলেও উচ্চ আদালতের রায় কার্যকর করতে জিয়াউর রহমানের স্বাধীনতা পুরস্কার প্রত্যাহারের সিদ্ধান্ত নিয়েছে মন্ত্রিসভা কমিটি। উচ্চ আদালত জিয়াউর রহমানের রাষ্ট্রক্ষমতা দখলকে অবৈধ ঘোষণা করায় তাকে দেওয়া স্বাধীনতা পদক প্রত্যাহারের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। বেশকিছু গণমাধ্যম জানাচ্ছে, মন্ত্রিসভা কমিটি জিয়াউর রহমানের স্বাধীনতা পুরস্কার প্রত্যাহারের ক্ষেত্রে হাইকোর্টের রায়কে অগ্রাধিকার দিয়েছে। ওই রায়ে বলা হয়েছিল, ‘১৯৭৫-এর নভেম্বর থেকে ১৯৭৯ সালের মার্চ পর্যন্ত সংসদ ছাড়াই বাংলাদেশে সরকার চলেছে। একনায়কতন্ত্র হিসেবে দেশ চালিয়েছে সরকার, যেখানে ছিল না কোনো গণতন্ত্রের ছোঁয়া।’ রায়ে আরও বলা হয়, ‘সংবিধান লঙ্ঘন করে অবৈধভাবে ক্ষমতা দখলকারীদের শাস্তি পাওয়া উচিত, যেন মানুষ সংবিধান লঙ্ঘনের ক্ষেত্রে ভয় পায়।’ যেহেতু জিয়াউর রহমানের রাষ্ট্রপতি হিসেবে ক্ষমতা আরোহণকে হাইকোর্ট, সুপ্রিম কোর্ট ও অ্যাপিলেট ডিভিশন অবৈধ ঘোষণা করেছেন এবং শাস্তিযোগ্য অপরাধ হিসেবে আমলে নিয়েছে মন্ত্রিসভা কমিটি, অবৈধ স্বৈরশাসকদের নামে কোনো স্থাপনা বা প্রতিষ্ঠানের নাম থাকা উচিত নয়Ñ আদালতের এমন রায়ের পরিপ্রেক্ষিতে জিয়া আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের নাম বদল করে সিলেট অঞ্চলে ইসলাম প্রচারকারী সুফিসাধক হযরত শাহজালাল (রহ.) আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর নামকরণ করা হয়েছে। সেটি ২০১০ সালের কথা।
অথচ প্রাচ্যের বাতিঘর হিসেবে খ্যাত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আজও রয়ে গেছে জিয়াউর রহমান হল। একশ বছর ছুঁই ছুঁই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ব্রিটিশ, পাকিস্তান ও বাংলাদেশ যুগের সাক্ষী। যৌবনকালে ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনে ভূমিকা রেখেছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। এরপর ’৫২-এর ভাষা আন্দোলন, ’৬৬-র শিক্ষা আন্দোলন, ’৬৯-র গণঅভ্যুত্থান, ’৭১-র মহান মুক্তিযুদ্ধ, ’৯০-র স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনে ছাত্র-শিক্ষকদের আত্মত্যাগ ও বলিষ্ঠ ভূমিকা ছিল। সর্বশেষ ২০০৭ সালে ১/১১ সরকারের বিরুদ্ধে আন্দোলনে সামনে থেকে নেতৃত্ব দিয়েছিল এই বিশ্ববিদ্যালয়। পাল্টে গেছে সেইসব চিত্র! ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ৯৫তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর স্মারকগ্রন্থে জিয়াউর রহমান হলের বর্ণনায় লেখা হয়েছে, জিয়াউর রহমান বাংলাদেশের প্রথম রাষ্ট্রপতি! স্মারকগ্রন্থের ১৯ নম্বর পৃষ্ঠায়, ‘স্মৃতি অম্লান’ শিরোনামে লেখা বিশ্ববিদ্যালয়ের হলগুলোর বিবরণীর জিয়াউর রহমান হলের অংশে লেখা হয়, জিয়াউর রহমান বাংলাদেশের প্রথম রাষ্ট্রপতি, সাবেক সেনাপ্রধান এবং একজন মুক্তিযোদ্ধা। এছাড়া স্মারকগ্রন্থের ১৩ নং পৃষ্ঠায় জগন্নাথ হলের বর্ণনায় লেখা হয়েছে, বিশ্ববিদ্যালয়ের সংখ্যালঘু তথা হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রিস্টান সম্প্রদায় এবং উপজাতি ছাত্রদের জন্য এই হল প্রতিষ্ঠিত। এটি লিখেছিলেন ভারপ্রাপ্ত রেজিস্ট্রার সৈয়দ রেজাউর রহমান। জাতির জনকের প্রতি তার বিদ্বেষের প্রমাণ রেখেছেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান হলের পরিচিতি প্রদানের মাধ্যমে। রেজাউর লিখেছেন, ‘শেখ মুজিবুর রহমান বাংলাদেশের অন্যতম প্রধান রাজনৈতিক নেতা যিনি পূর্ব পাকিস্তান থেকে বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার সংগ্রামে অন্যতম পুরোধা ব্যক্তিত্ব এবং বাংলাদেশের জাতির জনক হিসেবে বিবেচিত।’
রেজাউরের জামায়াতপ্রীতির কথা সর্বজনবিদিত। বিএনপি-জামায়াত জোট ক্ষমতায় থাকাকালে উপাচার্য অধ্যাপক এস এম এ ফায়েজ, রেজাউরকে ভারপ্রাপ্ত রেজিস্ট্রার পদে নিয়োগ দেন। ২০০৮ সালে বর্তমান উপাচার্য দায়িত্ব গ্রহণের পরও তিনি ভারপ্রাপ্ত রেজিস্ট্রার হিসেবে বহালতবিয়তে ছিলেন। আন্দোলনের মুখে পদ থেকে সরিয়ে দেওয়া হয় রেজাউরকে। এটি একটি ‘আই ওয়াশ’ তা বুঝতে বোদ্ধা হওয়ার প্রয়োজন নেই।
জিয়াউর রহমানের মরণোত্তর স্বাধীনতা পদক বাতিলের সিদ্ধান্তটি সময়োচিত। এজন্য সরকার সাধুবাদ পেতে পারে এতে কোনো সন্দেহ নেই। কিন্তু ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে জিয়ার নামে হল থাকবে কিনা সে সিদ্ধান্ত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালকে নিতেই হবে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় স্বায়ত্তশাসিত হওয়ায় সরকারের হস্তক্ষেপের সুযোগ অনেকটা কম বললেই চলে। কিন্তু দিন শেষে প্রশ্ন জাগে, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কি পারবে?
মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস বিকৃতকারী ও স্বাধীনতার প্রতি চরম বিদ্বেষী রেজাউরকে পদ থেকে সরিয়ে দেওয়া হলেও চাকরিতে বহাল রয়েছেন। অথচ আইনের হাতে সোপর্দ করা হলো না তাকে। ঘটনা তদন্তে সিন্ডিকেট যে কমিটি গঠন করেছিল ঘটনার পর দুই মাসের বেশি পার হলেও এখনও কার্যত শুরু করেনি তারা। এসব কিসের ঈঙ্গিত বহন করে? নাকি শর্ষের ভেতরই লুকিয়ে আছে ভূত? এটাতো সত্য, শর্ষের ভেতর ভূত থাকলে ভূত তাড়ানো শুধু অসম্ভবই নয়, হাস্যকরও বটে।
সম্পাদনা: আশিক রহমান