সুন্দরবন জাগিয়ে দিক গোটা জাতিকে
ফিরোজ আহমেদ
নেপোলিয়ন পরাজিত হয়েছিলেন, অত অত্যাধুনিক সেনাবাহিনী নিয়েও মান্ধাতার রাশিয়ার জনগণকে তিনি বশ করতে পারেননি। জার পালিয়ে বাঁচছিলেন, ওদিকে জনগণই বাঁচিয়েছিল রাশিয়াকে।
কিন্তু বিষয় শুধু এটুকুই নয়। নেপোলিয়নের বিরুদ্ধে সংগ্রামটাকে কেন্দ্র করে রুশ দেশে যে জাগরণ ঘটিয়েছিল, সেটাই রাশিয়াকে আর মান্ধাতার আমলে থাকতে দেয়নি। নব জাগরণের ঢেউ, ভাষার শক্তিতে, সাহিত্যের শক্তিতে, কৃষকের শক্তিতে, দর্শনের শক্তিতে, জ্ঞান-বিজ্ঞানের শক্তিতে জাতীয় মুক্তি আর বিকাশের, এবং এই সবকিছু করতে গিয়ে আত্মানুসন্ধানের একটা প্লাবন দেশজুড়ে নিয়ে এসেছিল। তরুণদের একটা অংশ নিজের দেশকে খোঁজা শুরু করেছিল। তাদের সেই চেষ্টা বৃথা যায়নি। এরই খানিকটা উঠে এসেছে তলস্তয়ের যুদ্ধ আর শান্তি নামের উপন্যাসটাতে। শুধু রাশিয়া না, ভিতরের বা বাইরের শত্রুর হাতে অস্তিত্ব বিনাশী, মর্যাদা বিনাশী এমন আঘাতের মুখোমুখি হয়ে বহু জাতি জেগে উঠেছে আত্মশক্তিতে। সুন্দরবনও রক্ষা পাবে, তার সন্তানেরাই তাকে রক্ষা করবে।
সুন্দরবন রক্ষার চেয়েও বড় অর্জন হবে এই রক্ষার সংগ্রামকে কেন্দ্র করে যদি নতুন একদল তরুণ জেগে ওঠে। ফরমায়েসি বাধাধরা শিক্ষা বাদ দিয়ে অর্থনীতির আলোচনাকে সে মানুষের স্বার্থের সঙ্গে মিলিয়ে দেখবে, প্রতিবেশবিদ্যার আলাপকে কাজে লাগাবে মানুষের বাস্তুভিটা, কৃষিজমি, প্রাণপ্রকৃতি নদী রক্ষার আন্দোলনকে যুক্তি জোগাতে। প্রযুক্তিবিদরা বিকল্প উন্নয়নের রূপরেখা হাজির করবেন, সমাজবিজ্ঞানীরা এগিয়ে আসবেন নতুন নতুন অনুসন্ধানে, কিভাবে অগণতান্ত্রিক আর স্বৈরতান্ত্রিক আইন সংবিধান চাপিয়ে দেওয়া হয়েছে জনগণের ওপর, সেই অনুসন্ধান শুরু করবেন নবীন আইনবিদরা। ইতিহাসবিদরা আবারও ইতিহাস সন্ধানের কাজে হাত লাগাবেন, আসবে নতুন রাজনীতি, নতুন সংগঠন ও নেতৃত্ব। নতুন সংস্কৃতি আর শিল্পচর্চার জোয়ারও আসবে, এক অভিঘাত থেকে নাটক-কবিতা-গান-উপন্যাসের অগুনিত নতুন সূত্র খুলে যাবে। জীবন ও প্রকৃতির সঙ্গে ঘনিষ্ঠতার পথেই জ্ঞান নব নব বিকাশের হাতিয়ার হবে। অজস্র তর্ক আর দ্বন্দ্বও হবে, কেননা সৃজনশীলতার সেই বিপ্লবে অজস্র নতুন আর প্রতিস্পর্ধী চিন্তারও জন্ম হবে।
এমনকি সৌন্দর্যবোধেরও সামাজিক প্রেক্ষিত আছে। বস্তুত সাহিত্য হলো তাই, যা মানুষকে ভাষা জোগায়, সংগ্রামে, চিন্তায়, সঙ্কটে, প্রেমে, প্রচারণায়, দ্বিধায় তা তার মনের অভিব্যক্তি প্রকাশ করে। এই মানবীয় মূহূর্তগুলোতে সে কবিতা যে উপন্যাস কোনো চিন্তা গঠন করবে না, প্রকাশের বাহন হবে না, সেও হয়তো বহুদিনের জন্য আড়ালে চলে যাবে। নিষ্কর্মার সাহিত্য সমঝদারি আর জীবনের অর্থ খুঁজতে বাইরে আসা তরুণের সাহিত্য তো কোনোকালে এক ছিল না। ঝঞ্ঝার পথে মানুষ নন্দনতত্ত্বেও নতুন ব্যাকরণ তৈরি করে নেয়। নতুন এই প্লাবনটা যদি আসে, সুন্দরবন শুধু নয়, গোটা জাতিই পুনর্গঠিত হতে পারবে এই সম্ভাবনাময় সংগ্রামকে কেন্দ্র করে। সুন্দরবন জাগিয়ে দিক গোটা জাতিকে।
লেখক: কেন্দ্রীয় সদস্য, গণসংহতি আন্দোলন। সাবেক সভাপতি, বাংলাদেশ ছাত্র ফেডারেশন