টাকা পাচার যৌথভাবে ঠেকাবে এনবিআর-বাংলাদেশ ব্যাংক
হাসান আরিফ: দেশ থেকে টাকা পাচার বন্ধে একসঙ্গে কাজ করবে বাংলাদেশ ব্যাংক ও জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর)। এ লক্ষ্যে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের বাংলাদেশ ফিন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিট (বিএফআইইউ) ও এনবিআরের ট্রান্সফার প্রাইসিং সেল যৌথভাবে কাজ করবে।
সূত্র জানায়, সম্প্রতি অর্থপাচার নিয়ে ইন্টারন্যাশনাল মনিটরিং ফান্ডের (আইএমএফ) কারিগরি সহায়তা মিশন কেন্দ্রীয় ব্যাংক ও এনবিআরের সঙ্গে বৈঠক করে। বৈঠকে উঠে আসে দেশ থেকে অর্থপাচার বন্ধে এ দুটি প্রতিষ্ঠান যৌথভাবে কাজ করলে অর্থপাচার কমানো সম্ভব হবে। সংশ্লিষ্টরাও বলছেন, এ দুটি প্রতিষ্ঠান যৌথভাবে কাজ করলে অর্থপাচার অনেকাংশেই কমানো সম্ভব হবে। তাই এ সিদ্ধান্তকে ইতিবাচক হিসেবেই দেখছেন তারা।
টাকা পাচার নিয়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের বাংলাদেশ ফিন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিট (বিএফআইইউ) কাজ করে। আর দেশে বহুজাতিক কোম্পানিগুলোর বিরুদ্ধে কর ফাঁকির অভিযোগ ওঠায় তা প্রতিরোধে ট্রান্সফার প্রাইসিং সেল গঠনের উদ্যোগ নেয় এনবিআর। ২০১২-১৩ অর্থবছরের বাজেটে অর্থমন্ত্রী এ সেল গঠনের ঘোষণা দিলেও ২০১৫ সালে সাত সদস্যের একটি কমিটি গঠনের মাধ্যমে কার্যক্রম শুরু করে এনবিআর। এ কমিটি দক্ষিণ কোরিয়া, থাইল্যান্ড, ভিয়েতনামসহ কয়েকটি দেশ ঘুরে ট্রান্সফার প্রাইসিং রোধে অভিজ্ঞতা নিয়েছে। অভিজ্ঞতার আলোকে আইন প্রণয়ন ও বিধিবিধানও প্রস্তুত করা হয়েছে।
জানা গেছে, ১০ বছরে বাংলাদেশ থেকে পাচার হয়েছে ৫ হাজার ৫৮৭ কোটি ৬০ লাখ ডলার। টাকার অঙ্কে যা ৪ লাখ ৪১ হাজার ৪২০ কোটি টাকা। স্বল্পোন্নত দেশগুলোর (এলডিসি) মধ্যে অর্থপাচার সবচেয়ে বেশি হয়েছে বাংলাদেশ থেকেই।
জিএফআইয়ের প্রতিবেদনে বাংলাদেশ থেকে অর্থপাচারের তথ্য রয়েছে ২০০৪ সাল থেকে ২০১৩ সাল পর্যন্ত। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি অর্থপাচার হয়েছে ২০১২ ও ২০১৩ সালে। এর মধ্যে ২০১৩ সাল ছিল নির্বাচনের আগের বছর। এ সময়ে অর্থ পাচারের পরিমাণ ছিল ৯৬৬ কোটি ৬০ লাখ ডলার এবং ২০১২ সালে পাচার হয়েছে ৭২২ কোটি ৫০ লাখ ডলার। এ ছাড়া ২০০৪ সালে পাচার হয় ৩৩৪ কোটি ৭০ লাখ ডলার, ২০০৫ সালে ৪২৬ কোটি ২০ লাখ ডলার, ২০০৬ সালে ৩৩৭ কোটি ৮০ লাখ ডলার, ২০০৭ সালে ৪০৯ কোটি ৮০ লাখ ডলার, ২০০৮ সালে ৬৪৪ কোটি ৩০ লাখ ডলার, ২০০৯ সালে ৬১২ কোটি ৭০ লাখ ডলার, ২০১০ সালে ৫৪০ কোটি ৯০ লাখ ডলার এবং ২০১১ সালে পাচার হয় ৫৯২ কোটি ১০ লাখ ডলার।
সিপিডির হিসাবে, ২০১৩ সালে পাচার হওয়া অর্থ দেশের শিক্ষা বাজেটের তুলনায় ৩ দশমিক ৬ গুণ বেশি, আর স্বাস্থ্য বাজেটের তুলনায় বেশি ৮ দশমিক ২ গুণ। পাচার হওয়া ওই অর্থের ২৫ শতাংশ হারে যদি কর পাওয়া যেত, তাহলে স্বাস্থ্য বাজেট তিন গুণ এবং শিক্ষা বাজেট দ্বিগুণ করা সম্ভব হতো। সিপিডি তুলনা করে আরও দেখিয়েছে, ওই সময়ে পাচার হওয়া অর্থ বাংলাদেশের মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) সাড়ে ৫ শতাংশ এবং ওই সময়ে বাংলাদেশের পাওয়া মোট বৈদেশিক সাহায্যের ৩৪০ শতাংশের সমান।
জিএফআইয়ের গবেষণা অনুযায়ী, মোট পাচার হওয়া অর্থের ৮৫ থেকে ৯০ শতাংশই হয় আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের আড়ালে। বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই আমদানি করা পণ্যের দাম বেশি দেখিয়ে অর্থ বাইরে পাচার করা হয়। সিপিডি এ বিষয়ে গবেষণা করে বাণিজ্যের ক্ষেত্রে এ ধরনের কিছু উদাহরণ দিয়েছে। যেমন, ২০১৪ সালের মার্চে সাড়ে ৫৪ শতাংশ আমদানি বৃদ্ধি পেয়েছিল, যা একটি রেকর্ড। এ সময়ে কেবল পুঁজি যন্ত্রপাতি আমদানি হয়েছে ৭৩ কোটি ডলারের, যা আগের বছরের একই সময়ের তুলনায় পাঁচ গুণ বেশি। আবার এ সময়ে ফ্রান্স থেকে কেবল ক্রেন (পণ্য ওঠানো-নামানোর যন্ত্র) আনা হয়েছে ৪৩ কোটি ৩০ লাখ ডলারের। পুঁজি যন্ত্রপাতি হিসেবে এর শুল্ক মাত্র ২ শতাংশ। ২০১৫ সালেও পুঁজি যন্ত্রপাতির দাম বেশি দেখানো হয়েছে।
সিপিডির দেওয়া আরেকটি উদাহরণ হচ্ছে- ২০১৩-১৫ সময়ের মধ্যে বাংলাদেশে যত চাল বিদেশ থেকে আনা হয়েছে, তার আমদানি মূল্য ছিল টনপ্রতি ৮০০ থেকে ১ হাজার ডলার। অথচ এ সময়ে আন্তর্জাতিক বাজারে চালের গড় মূল্য ছিল টনপ্রতি প্রায় ৫০০ ডলার। সম্পাদনা: মোরশেদ