আমাদের অর্থনীতি কার্যালয়ের বৈঠকে দৈনিক আজাদী সম্পাদক পাঠকের ভালবাসা না পেলে ৫৬ বছর টিকে থাকা সম্ভব হতো না
নাশরাত আর্শিয়ানা চৌধুরী: দল ও মতের ক্ষেত্রে দৈনিক আজাদী অনুসরণ করেছে নিরপেক্ষ ভূমিকা। আর এজন্যই দলমত নির্বিশেষে পাঠকপ্রিয়তা পেয়েছে আজাদী। সেই পাঠক সমাজই আজাদীকে বাঁচিয়ে রেখেছে। পাঠকের কাছে আজাদীর ঋণ চিরদিনের। আমি চট্টগ্রামবাসীকে একটি সংবাদপত্র দিতে চেষ্টা করেছি। বিনিময়ে আমি দিয়েছি আমার যৌবন, আমার জীবন। কথাগুলো বলেছেন চট্টগ্রাম থেকে প্রকাশিত বহুল প্রচারিত দৈনিক আজাদীর সম্পাদক আব্দুল মালেক।
তিনি গতকাল মঙ্গলবার সকালে আমাদের অর্থনীতির কার্যালয়ে সিনিয়র সাংবাদিকদের সঙ্গে এক বৈঠকে মিলিত হন। সেখানে তুলে ধরেন আজাদীর ৫৬ বছরের সাফল্য ও এর সঙ্গে জড়িয়ে থাকা নানা স্মৃতিকথা। এ সময় আমাদের অর্থনীতির সম্পাদক ও প্রকাশক নাঈমুল ইসলাম খান এবং ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক নাসিমা খান মন্টি উপস্থিত ছিলেন।
আব্দুল মালেক বলেন, গত শতাব্দীর ৩০-এর দশকে পশ্চাৎপদ মুসলিম সমাজকে শিক্ষার মাধ্যমে এগিয়ে নেওয়ার জন্য আমার বাবা আব্দুল খালেক ইঞ্জিনিয়ার নিজের পেশা ছেড়ে লাইব্রেরি ও প্রেস করেছিলেন। ’৫২-র ভাষা আন্দোলনে কবি মাহবুব উল আলম চৌধুরী রচিত একুশের প্রথম কবিতা ‘কাঁদতে আসিনি ফাঁসির দাবি নিয়ে এসেছি’ তিনি ছেপেছিলেন অসীম সাহসিকতার সঙ্গে। সে সময়ের স্মৃতি তুলে ধরে তিনি বলেন, কবিতা প্রকাশের অপরাধে আব্দুল খালেক ইঞ্জিনিয়ারকে পুলিশ গ্রেফতার করতে এলে প্রেস ম্যানেজার দবির আহমদ চৌধুরী নিজ কাঁধে তা ছাপার দায়িত্ব তুলে নেন। গ্রেফতার করা হয় দবিরকে। পরে তিনি জামিন লাভ করেছিলেন।
আব্দুল মালেক বলেন, আজাদীর আত্মপ্রকাশের আগে কোহিনুর নামে একটি সাপ্তাহিক প্রকাশ করেছিলেন বাবা। পত্রিকা প্রকাশের দুই বছরের মাথায় ২৫ সেপ্টেম্বর, ১৯৬২ তিনি মারা যান।
তিনি বলেন, আমার পরম আনন্দের বিষয়Ñ আজাদী স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম দৈনিক। ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর বাংলাদেশের বিজয়ের পর ১৭ ডিসেম্বর আজাদী প্রকাশিত হয়েছিল।
গ্রাহক ও পাঠকদের প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে তিনি বলেন, আমাদের পাঠকদের শতকরা ৯০ ভাগই মাসিক গ্রাহক। চট্টগ্রামবাসীর কাছ থেকে আমরা যদি ভালবাসা আর সমর্থন না পেতাম তাহলে আমাদের এত বছর টিকে থাকা সম্ভব হত না। যেকোনো পত্রিকার মেরুদ- হলো এর পাঠক।
তিনি স্মৃতিচারণ করে বলেন, আজাদী প্রকাশের প্রথম দিন আমি আর আমার ভাগ্নে প্রয়াত আলী রেজা সাইকেলে করে আমাদের আতœীয়-স্বজন, বন্ধু-বান্ধবদের বাড়ি বাড়ি গিয়ে কাগজ বিলি করেছিলাম। এ কাজ আমরা এক মাস অব্যাহত রেখেছি। আমি প্রায় চল্লিশ বছর ভোর ৪-৮টায় হকার ভাইদের হাতে কাগজ তুলে দিয়েছি। আজাদী প্রতিদিন শহর এলাকায় শতভাগ নগদ টাকায় বিক্রি হয়। এর বিক্রয় খাতে কোনো বাকির খাতা নেই। তা কী করে সম্ভব হলো? এ প্রসঙ্গে বলেন, ষাটের দশকে যখন কাগজ বের হয় তখন কোনো হকার ছিল না। বাবা প্রতিদিন পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ আন্দরকিল্লা জামে মসজিদে পড়তেন। আসার সময় ভিক্ষুক নিয়ে ফিরতেন। তাদের কাগজ দিয়ে বলতেনÑ তুমি যা নেবে বিক্রি করে পয়সা দিয়ে যাবে। একটা কাগজ ছিল দুই আনা। দশটা কাগজ নিলে ১ টাকা চার আনা হত। পরদিন বাকিতে কাগজ দিতেন আগের দিনের টাকাও তার কাছে রেখে দিতেন। বলতেন, আমার টাকা তোমার কাছে রাখলাম। এভাবে পাঁচ টাকা হলে বলতেনÑ আমার পাঁচ টাকা তোমার মূলধন হিসাবে রইল। কাল থেকে ক্যাশ দিয়ে কাগজ কিনবে। সেই থেকে শুরু। পরে তারা ক্যাশ টাকা দিয়ে কাগজ কিনতেন। বাবা ভিক্ষুকের হাতকে এভাবে কর্মীর হাত তৈরি করেছিলেন।
আজাদীর এগিয়ে যাওয়ার কারণ সম্পর্কে তিনি বলেন, সঠিক সময়ে সঠিক সিদ্ধান্ত। সময়ের সঙ্গে এগিয়ে চলা। মুদ্রণ শিল্পে যত নতুন পদ্ধতি চালু হয়েছে এর সঙ্গে আমরা ছিলাম। এখনো অত্যাধুনিক মেশিন ব্যবহার করছি, যা চট্টগ্রামের অন্য কোনো কাগজের নেই।
তিনি বলেন, ১৯৬১ সালে ঘূর্ণিঝড়ের পর ৫/৬ দিন বিদ্যুৎ ছিল না। তখন হাতে মেশিনের চাকা ঘুরিয়ে কাগজ বের করেছি। আমরা চেষ্টা করেছি সবসময় পাঠকের পাশে থাকতে। তিনি আজাদীকে সফল করার পিছনে তার ও এর সঙ্গে সংশ্লিষ্টদের অক্লান্ত পরিশ্রম, নিষ্ঠার উদাহরণ তুলে ধরেন। সেই সঙ্গে স্ত্রী ও সন্তানদের প্রতিও তাকে সহযোগিতা করার জন্য ধন্যবাদ জানান। সম্পাদনা: হাসিবুল ফারুক চৌধুরী