এসপি বাবুল আক্তারকে চাকরি থেকে অব্যাহতি
আজাদ হোসেন সুমন: বহুল আলোচিত পুলিশ সুপার বাবুল আক্তারের চাকরি আর নেই। তাকে মঙ্গলবার অব্যাহতি দিয়েছে বলে পুলিশ সদর দফতরের একটি দায়িত্বশীল সূত্র নিশ্চিত করেছে। এ ব্যাপারে ইতোমধ্যে সরকারি প্রজ্ঞাপনও জারি করা হয়েছে। সুতরাং বাবুল এখন আর পুলিশবাহিনীর কেউ নন।
‘স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের উপসচিব ইলিয়াস হোসেন স্বাক্ষরিত প্রজ্ঞাপনে বলা হয়, ২৪তম বিসিএস ক্যাডারে যোগদানকৃত মো. বাবুল আক্তার (বিপি- ৭৫০৫১০৯০২৯) অতিরিক্ত উপপুলিশ কমিশনার সিএমপি (বর্তমানে পুলিশ সুপার পদে পদোন্নতি এবং পুলিশ সদর দফতরে সংযুক্ত)-কে তার আবেদনের প্রেক্ষিতে চাকরি হতে (পুলিশ ক্যাডার) অব্যাহতি প্রদান করা হলো।’
মিতু হত্যা ও এসপি বাবুল বেশকিছুদিন ধরে আলোচনার কেন্দ্র বিন্দুতে ছিল। কারণ স্ত্রী মিতু হত্যার বিষয়টি নিয়ে একদিকে যেমন চাঞ্চল্যের সৃষ্টি; তেমনি বাবুলের অবস্থান এবং চাকরি থেকে স্বেচ্ছায় পদত্যাগপত্র দেওয়া এবং পরে তা অস্বীকৃতি জানিয়ে চাকরি বহাল রাখার আবেদন জনমনে নানা প্রশ্নের জন্ম দেয়। গত ৫ জুন চট্টগ্রামে নৃশংসভাবে খুন হন বাবুল আক্তারের স্ত্রী মাহমুদা খানম মিতু। ৬ জুন বাবুল পুলিশ সদরদফতরে সংযুক্ত হওয়ার কথা থাকায় বাবুল তখন বনশ্রীস্থ শ্বশুরের বাসায় অবস্থান করছিলেন।
ইতোমধ্যে মিতু হত্যামামলায় চট্টগ্রামে বাবুলের ২ সোর্সকে গ্রেফতার করা হয়। পরে ২৫ জুন বনশ্রীর বাসা থেকে বাবুল আক্তারকে ডেকে নিয়ে ১৫ ঘণ্টা জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়। সেদিনই রহস্যজনক কারণে বাবুল আক্তার পদত্যাগ করেন। অবশ্য বিষয়টি নিয়ে একাধিক মিডিয়ায় সংবাদ প্রকাশিত হয়েছে যে, বাবুল আক্তারই তার স্ত্রী মিতু হত্যায় একজন সন্দেহভাজন। ফলে তাকে বলা হয়েছে জেলে যেতে হবে নইলে ডিপার্টমেন্ট ছাড়তে হবে। বাবুল আক্তার শর্ত মেনে নিয়ে পদত্যাগপত্রে সই করেন বলে জানান।
অসমর্থিত পুলিশের একাধিক সূত্র বিভিন্ন সময় এ প্রতিবেদককে বলেছে, আসলে ডিপার্টমেন্টের ভাবমূর্তি বিবেচনায় এমন করা হয়েছে। তাদের ইংগিত ছিল স্ত্রী হত্যায় বাবুলের হাত রয়েছে। কিন্তু অফিসিয়ালি তদন্তকারী কর্মকর্তারা বা পুলিশ বাহিনীর পক্ষ থেকে কখনো বলা হয়নি যে, বাবুল আক্তার স্ত্রী হত্যায় জড়িত। অভিযোগ ওঠে, বাবুলের সোর্স মুছা মিতু হত্যার পরিকল্পনাকারী। সংগত কারণেই প্রশ্ন উঠে, মুছার মতো একজন সাধারণ সোর্সের বাবুল বা তার স্ত্রীর এমন কোনো দেন দরবার নেই যে, সে মিতুকে খুন করার পরিকল্পনা করবে। মুছাকে হত্যার নির্দেশদাতা তবে কে? এ প্রশ্নের জবাবও পুলিশের পক্ষ থেকে এখনো পরিষ্কার করা হয়নি।
মুছাকে আজও ধরতে পারেনি পুলিশ; এটা পুলিশের পক্ষ থেকে বলা হলেও মুছার স্ত্রী বরাবরই দাবি করছে পুলিশ মুছাকে ধরে নিয়ে গেছে তার এক আত্মীয়র বাসা থেকে। এর আগে পুলিশের সঙ্গে বন্দুকযুদ্ধে মিতু হত্যাকা-ের অন্য দুই আসামি মারা যায়। গ্রেফতারকৃত চারজনের মধ্যে ২ জন আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দী দিয়েছে। জবানবন্দীতে তারা মিতু হত্যার আদ্যোপান্ত বর্ণনা দেয়। এমনকি, মুছা ভোলা নামে এক চিহ্নিত সন্ত্রাসীর কাছ থেকে অস্ত্র এনে মিতুকে হত্যা করে সবকিছুই প্রকাশ পায়। কিন্তু অন্তরালে রয়ে যায় হত্যার কারণ ও নির্দেশদাতা।
জল্পনা-কল্পনার একপর্যায়ে সম্প্রতি বাবুল আক্তার স্বেচ্ছায় পদত্যাগ করিনি দাবি করে চাকরি ফিরে পাওয়ার আবেদন জানালে বিষয়টি পুনরায় আলোচনার কেন্দ্রে চলে আসে। অবশ্য পুলিশ সদর দফতরের একাধিক সূত্র বলেছে, বাবুল আক্তার স্বেচ্ছায় পদত্যাগে করে এখন নানা ফন্দি আঁটছে। এ বিষয়ে পুলিশের বিভিন্ন সভা সমাবেশে সাংবাদিকরা এ বিষয়ে আইজিপিকে প্রশ্ন করে বসেন, বাবুল আক্তার বলছেন তিনি স্বেচ্ছায় পদত্যাগ করেননি। জবাবে আইজিপি বলেছেন, একজন পুলিশ সুপারকে জোর করে পদত্যাগপত্রে সই নেওয়া হবেÑ দেশ এতটা মগের মুল্লুক হয়নি এখনো। পুলিশ এবং বাবুল যখন পরস্পরবিরোধী অবস্থানেÑ এ নিয়ে গত ৩-৪ দিন ধরে পুলিশ প্রশাসনে বিব্রতকর অবস্থা সৃষ্টি হচ্ছিল। অবশ্য এর অবসান আগেই হতো রাষ্ট্রপতি দেশে ছিলেন না। গত রোববার দেশে ফিরেন তিনি। গতকাল বাবুলের অব্যাহতিপত্রে তিনি স্বাক্ষর করেন।
গতকাল একাধিকবার চেষ্টা করেও বাবুল আক্তারের সাথে যোগাযোগ করা যায়নি। তার শ্বশুর মোশাররফ হোসেন বলেন, আমরা এখনো অফিসিয়ালি কোনো সংবাদ পাইনি। আপনাদের মাধ্যমে জানতে পেরেছি। সরকার ও পুলিশবাহিনী যদি কাউকে পছন্দ না করে তাহলে সে কিভাবে পুলিশে চাকরি করবে। আপনারা যা সত্য তাই লিখেন – এ বিষয়ে আমি আর কোনো মন্তব্য করব না।
উল্লেখ্য, গতকাল মঙ্গলবার বিকালে বাবুল আক্তার খিলগাঁওয়ের বাসা থেকে বেরিয়ে গেছেন। এ রিপোর্ট লেখার সময়ও (রাত ৯টায়) তিনি বাসায় ফিরেননি।
ফেসবুকে স্ত্রীকে নিয়ে বাবুলের স্ট্যাটাস : অতি সম্প্রতি বাবুল আক্তার স্ত্রী মাহমুদা আক্তার মিতুকে নিয়ে নিজের ফেসবুকে এক আবেগঘন স্ট্যাটাস দিয়ে স্ত্রীর সঙ্গে সংসারের স্মৃতিচারণ করেছেন। তিনি লিখেছেন, ‘এক সুন্দর দিনে সাধারণ এক কিশোরী বউ হয়ে আমার জীবনে এসেছিল। ঘর-সংসার কী অত বুঝত সে তখন? তাকে বুঝে উঠার সবটুকু সাধ্য হয়নি কখনও। কারণ সদাহাস্য চেহারা যার, তার অন্যান্য অনুভূতি ধরতে পারাটা কঠিন। তারপর যুগের শুরু। এক কিশোরীর নারী হয়ে উঠার সাক্ষী আমি। ছোট ছোট আবদার আর কথাগুলো ক্রমেই দিক পাল্টালো। হাতের নখের আকার পাল্টে গেল আমার খাবারটুকু স্বাস্থ্যকর রাখার জন্য। ঘরের চারপাশে ছড়িয়ে মিশে গেল তার চব্বিশ ঘণ্টা, মাস, বছর এবং যুগ।
রাতের পর রাত কাজ থেকে ফিরে দেখতাম, মেয়েটি ক্রমেই রূপ হারাচ্ছে রাত জেগে আমার অপেক্ষায় থেকে থেকে। হয়ত ভালোবাসার চেয়ে স্নেহই ছিল বেশি। প্রথম সন্তানের জন্মের পর যেন সে স্নেহের ডালপালা ছড়ালো। নিজেকে এত যতœ পাওয়ার যোগ্য আমার কখনই মনে হয়নি। পোশাক থেকে খাবার, কাজ থেকে ঘুম সবকিছুতেই মায়া।
কাজের মাঝে বুঁদ হয়ে থাকা এই আমির সব পারিবারিক দায়িত্ব সে পালন করতে করতে সবার কাছে আমার নাম মানেই হয়ে উঠে তার অবয়ব। ততদিনে হয়ত সংসার বুঝে গিয়েছে সে। মেয়ে আসলো কোলজুড়ে। দেখতে অবিকল মায়ের মতো। সবকিছু জেঁকে ধরে কিশোরীটিকে নারী বানালো। কিন্তু ক্ষুদ্র থেকে ক্ষুদ্র বিষয়ে তার শিশুসুলভ উচ্ছ্বাসের সাক্ষী আমি। আমার সামান্যতম ক্ষতির আশঙ্কায় তার কেঁদে অস্থির হওয়ার সাক্ষী আমি। মেয়েটি কী আসলেই সংসার বুঝেছিল ততদিনে? কারণ আমি জানি আমি সংসার তখনও বুঝিনি। এরপর অনেকগুলো দিন কেটে গেল আমার, আমাদের জীবনে। নেহায়েত সাধারণ কিশোরীটি তখন নারী। ততদিনে সাধারণ মানুষটির ছোঁয়ায় আমার জীবন অসাধারণ। তখন সে সংসার বোঝে। কিন্তু আমি বুঝি না, এতেই কী এত ক্ষোভ ছিল তার? এত বেশি ক্ষোভ যে ছেড়েই চলে গেল?
নির্ঝঞ্ঝাট সংসার হয়ত কোনো দেবদূতেরও থাকে না। সে জায়গায় আমি তো সংসারই বুঝতাম না। কিন্তু সে সব বুঝতো। আগলেছিল আমাকে। সে চলে গেল, কিন্তু আমার যাওয়ার উপায় রাখল না। সন্তান দুটো আমার বেঁচে থাকার বাধ্যবাধকতা। না হয় হয়ত পিছু নিয়ে জানতে চাইতাম, এভাবে যাওয়ার কারণটা। তারপর জীবনের শেষ মৃত্যুতে, না কী মৃত্যুতেই মুক্তি; এই বিশাল বাস্তবতা এসে চাপল আমার ঘাড়ে। শরীর থেকে মাথা কাটা পড়ার অনুভূতি কী এই জীবন মেনে নেওয়ার চেয়েও ভয়ঙ্কর? যার সবটুকু শেষ হয়ে যায় তার কাছ থেকে কেড়ে নেওয়ার কিছু থাকে না। তবুও আমার কাছ থেকে আরও কী যেন চান স্রষ্টা ও সৃষ্টি! তারাই সব বলেন!
গোলকধাঁধাঁর মারপ্যাঁচ বুঝার বয়স কী হয়েছে মায়ের মৃত্যুর সাক্ষী ছেলেটার? তার প্রশ্নগুলো সহজ, কিন্তু উত্তর দেওয়ার মতো শব্দ দুষ্প্রাপ্য। যখন মা হারানো মেয়েটার অযথা গড়াগড়ি দিয়ে কান্নার শব্দ কেবল আমিই শুনি, তখন অনেকেই নতুন নতুন গল্প বানাতে ব্যস্ত। আমি তো বর্ম পরে নেই, কিন্তু কোলে আছে মা-হারা দুই শিশু। আঘাত সইতেও পারি না, রুখতেও পারি না। এরপর আর কোনো ভোর আমার জীবনে সকাল নিয়ে আসেনি। সন্তান দুটো এবং আমি আর স্নেহের ছায়ায় ঘুমাইনি। এরপরই আমি বুঝেছি সংসার কী? সংসার মানে তুমি’। সম্পাদনা: পরাগ মাঝি