‘মুক্তিযোদ্ধা’ শব্দটির সংজ্ঞায়ন ছাড়া কাকে মুক্তিযোদ্ধা বলব?
দেশের বিভিন্ন পেশাজীবী যেমন আইনজীবী, চিকিৎসক, প্রকৌশলী, সাংবাদিক এর সংজ্ঞা আইন দ্বারা নির্ধারিত অনুরূপ প্রজাতন্ত্রের কর্মে নিয়োজিত বিভিন্ন পদধারী যেমন সচিব, জেলা জজ, জেলা প্রশাসক প্রভৃতির সংজ্ঞাও আইন দ্বারা নির্ধারিত। যখন যেকোনো পেশাজীবী বা পদধারীর সংজ্ঞা আইন দ্বারা নির্ধারিত হয় তখন প্রয়োজনীয় যোগ্যতাসম্পন্ন ব্যক্তি ছাড়া অপর কারও সংজ্ঞাভুক্ত হওয়ার সুযোগ থাকে না।
আমাদের মুক্তিযুদ্ধের ব্যাপ্তিকাল ১৯৭১ খ্রিস্টাব্দের মার্চ হতে ডিসেম্বর অবধি, এ সময়ে অনেকে ভারতে গিয়ে প্রশিক্ষণ গ্রহণ করে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন। আবার অনেকে ভারতে অবস্থান করেই মুক্তিযুদ্ধের স্বপক্ষে কাজ করেন। মুক্তিযোদ্ধাদের মধ্যে এমন অনেকে আছেন, যারা দেশের অভ্যন্তরে প্রশিক্ষণ গ্রহণ করে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন। মুক্তিযুদ্ধকালীন মুক্তিযোদ্ধাদের খাদ্য, পথ্য, অর্থ ও আশ্রয় দিয়ে সাহায্য করেছেন এমন মানুষের সংখ্যাও অগণিত। মুক্তিযুদ্ধের রণকৌশল ছিল গেরিলা যুদ্ধভিত্তিক। একটি দেশের সাধারণ জনমানুষের প্রায় নিরঙ্কুশ সমর্থন ব্যতীত গেরিলা যুদ্ধ সফল হয় না। মুক্তিযুদ্ধকালীন যেসব এলাকায় পাকিস্তান বাহিনী বা তাদের সহায়তাকারী রাজাকার, আলবদর বা আলশামস বাহিনী মুক্তিযোদ্ধাদের চোরাগোপ্তা হামলার শিকার হয়েছেন অধিকাংশ ক্ষেত্রেই দেখা গেছে, হামলা পরবর্তী যে এলাকা থেকে হামলা পরিচালনা করা হয়েছে উক্ত এলাকার মানুষজনকে নির্বিচারে হত্যাসহ তাদের বাড়িঘর জ্বালিয়ে দেওয়া হয়েছে। এরূপ অত্যাচার ও নিস্পেষণের শিকার অনেক পরিবারের আত্মত্যাগ অবিস্মরণীয় হলেও এদের কতজন মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে স্বীকৃত?
মুক্তিযোদ্ধা শব্দটির সংজ্ঞায়ন ব্যতিরেকেই স্বাধীনতার অব্যবহিত পর সরকারি চাকরিতে নিয়োগে মু্িক্তযোদ্ধাদের জন্য শতকরা ৩০ ভাগ কোটা নির্ধারণ করে দেওয়া হয় এবং মুক্তিযোদ্ধাদের চাকরিতে প্রবেশের বয়সসীমা সাধারণদের চেয়ে দুবছর বৃদ্ধি করে ৩২ বছর করা হয়। ১৯৯৬ খ্রিস্টাব্দে আওয়ামী লীগ ক্ষমতাসীন হলে মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য নির্ধারিত শতকরা ৩০ ভাগ কোটা মুক্তিযোদ্ধাদের সন্তানদের জন্য প্রযোজ্য করা হয়। অতঃপর ২০১৫ খ্রিস্টাব্দে এ সুবিধাটি মুক্তিযোদ্ধাদের নাতি-নাতনি অবধি বিস্তৃত হয়। ২০০৯ খ্রি. আওয়ামী লীগ দ্বিতীয় দফায় পুনঃ ক্ষমতাসীন হলে মুক্তিযোদ্ধাদের চাকরি হতে অবসরের বয়সসীমা ৫৭ হতে বাড়িয়ে প্রথমত ৫৯ এবং পরবর্তীতে ৬০বছর করা হয়।
মুক্তিযুদ্ধে প্রত্যক্ষভাবে যারা অংশগ্রহণ করেছিলেন এদের মধ্যে ১৮ বছরের নিম্নের বয়সধারীর সংখ্যা ছিল অতি নগণ্য। সে নিরিখে ১৮-২১ বছরের বয়সধারী কোনো ব্যক্তি স্বাধীনতার অব্যবহিত পর মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে চাকরিতে যোগদান করে থাকলে ২০১৩-২০১৬ সালের মধ্যে ৬০ বছরে উন্নীত হওয়া পরবর্তী তিনি চাকরি হতে অবসরে চলে গেছেন এমনটিই প্রতিভাত। স্বাধীনতা পরবর্তী ২২-৩২ বছর বয়সধারী যারা মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে চাকরিতে যোগদান করেছেন তাদের সকলেই ২০০০-২০১০ সালের মধ্যে অবসরে চলে গেছেন। উপরোক্ত তথ্য বিবেচনায় নিলে দেখা যায়, প্রত্যক্ষভাবে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছেন এমন কোনো মুক্তিযোদ্ধা বর্তমানে প্রজাতন্ত্রের চাকরিতে কর্মরত নেই।
মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ছিল অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের মাধ্যমে গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে নির্বাচিত সরকার দ্বারা রাষ্ট্র পরিচালনা এবং দেশের জনমানুষকে প্রকৃত সেবা দেওয়ার নিমিত্ত দুর্নীতিমুক্ত প্রশাসন ও বিচারব্যবস্থা। মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে চাকরিতে যোগদান করেছেন এদের সকলেই যে মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে লালন করে চলেছেন এ কথাটি যেমন সত্য নয়, অনুরূপ একজন মুক্তিযোদ্ধার সন্তান বা নাতি-নাতনি মুক্তিযুদ্ধের চেতনাধারী হবেন এর নিশ্চয়তাও নেই। সুতরাং অনিশ্চিতের উপর ভিত্তি করে দেশের প্রকৃত মেধাবী ও যোগ্যতাসম্পন্নদের বঞ্চিত করে মুক্তিযোদ্ধাদের সন্তান অথবা নাতি-নাতনির জন্য মুক্তিযোদ্ধাদের ন্যায় শতকরা ৩০ ভাগ কোটা নির্ধারণ কতটুকু যৌক্তিক তা ভেবে দেখা প্রয়োজন।
দেশের বিভিন্ন বিভাগের সরকারি চাকরি লোভনীয় ও আকর্ষণীয় হওয়ার মূলে রয়েছে ক্ষমতা। একজন সরকারি কর্মচারী ক্ষমতার আইনানুগ প্রয়োগ করলে তার নিকট হতে দেশের সাধারণ জনমানুষ নিঃস্বার্থ সেবা পেয়ে থাকে। আর যে সকল সরকারি কর্মচারী ক্ষমতার অপব্যবহার করে থাকে তাদের নিকট হতে দক্ষিণা ব্যতীত কার্য উদ্ধার সম্ভব হয় না। বর্তমানে সরকারি কর্মচারীদের যে বেতন-ভাতা ও সুযোগসুবিধাদি দেওয়া হয় তাতে এদের কারও বেআইনি কার্যকলাপের সঙ্গে সম্পৃক্ত হয়ে দুর্নীতিতে লিপ্ত হওয়ার কথা নয়। কিন্তু বর্ধিত বেতন-ভাতা ও সুযোগসুবিধাদি কার্যকর পরবর্তী দেখা যায়, অতীতের সৎ ও ন্যায়নিষ্ঠরা পূর্ববৎ সৎ ও ন্যায়নিষ্ঠ রয়েছেন অপরদিকে অতীতের দুর্নীতিগ্রস্তরা সঅবস্থান হতে বিচ্যুৎ হননি।
সাধারণ চাকরিজীবীদের চেয়ে মুক্তিযোদ্ধা চাকরিজীবীদের অবসরের বয়স বৃদ্ধি করায় এবং মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য নির্ধারিত কোটা তাদের সন্তান ও নাতি-নাতনি অবধি বিস্তৃত করায় বর্তমানে মুক্তিযোদ্ধা সনদ খুবই লোভনীয় বস্তুতে পরিণত হয়েছে। এ লোভের বশবর্তীতে দেখা গেল, খোদ মুক্তিযোদ্ধা মন্ত্রণালয়ের এককালের সচিব ও প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের এককালের মূখ্য সচিবসহ সরকারের অপর কতিপয় মন্ত্রণালয়ের এককালের সচিবদের মুক্তিযোদ্ধা সনদ ভুয়া। বর্তমানে সরকারের বিভিন্ন বিভাগে কর্মরত রয়েছেন এমন অগণিত সংখ্যক ব্যক্তি যে মুক্তিযোদ্ধা সনদের ভিত্তিতে মুক্তিযোদ্ধার সন্তান বা নাতি-নাতনি হিসেবে চাকরি নিয়েছেন এদের মুক্তিযোদ্ধা সনদ যথাযথভাবে পরীক্ষানিরীক্ষা করলে দেখা যাবে, এসকল সনদের অনেকগুলোই ভুয়া। সম্প্রতি পত্রিকায় প্রকাশিত সংবাদ হতে জানা যায়, দুদকের অনুসন্ধানে বেরিয়ে এসেছে মুক্তিযোদ্ধা সনদের ভিত্তিতে চাকরি পাওয়া পুলিশ বিভাগের ১৯ জন সদস্যের সনদ ভুয়া। এরূপ ভুয়া মুক্তিযোদ্ধা সনদের ভিত্তিতে যারা চাকরি নিয়েছেন সেটি চাকরিতে আবেদন দাখিল পরবর্তী যথাযথভাবে পরীক্ষানিরীক্ষা করলে তখনই উদ্ঘাটিত হওয়ার কথা। কিন্তু ধারণা করা হয় বিভিন্ন অবৈধ যোগের কারণে সংশ্লিষ্টরা তা উদ্ঘাটন হতে বিরত থাকেন।
মুক্তিযুদ্ধকালীন পাকিস্তানি বাহিনীকে প্রত্যক্ষভাবে সহায়তা করেছেন এমন সকল ব্যক্তি ছাড়া অপরাপর সকলেরই অবস্থান ছিল মুক্তিযুদ্ধের স্বপক্ষে। আর এ কারণেই পাকিস্তানি বাহিনী বা তাদের সহায়ক বাহিনীর সঙ্গে সরাসরি যুদ্ধে যে সংখ্যক মুক্তিযোদ্ধা নিহত হয়েছেন তার চেয়ে অনেক অধিক সংখ্যক মানুষজন নিহত হয়েছেন মুক্তিযোদ্ধাদের সহায়তায় সাহায্যের হাত প্রশস্ত করায়। সুতরাং মুক্তিযোদ্ধার সংজ্ঞা নির্ধারণে এদের মুক্তিযোদ্ধার পরিধি হতে বাদ দেওয়ার অবকাশ কোথায়? মুক্তিযোদ্ধা সনদধারীরা বিশেষ সুবিধার অন্তর্ভুক্ত হওয়ায় যতদিন পর্যন্ত মুক্তিযোদ্ধা শব্দটি সংজ্ঞায়িত না হবে ততদিন পর্যন্ত মুক্তিযোদ্ধা সনদকে কেন্দ্র করে অসাধু বাণিজ্য চলতে থাকবে। আর তাই মুক্তিযোদ্ধা শব্দটি সংজ্ঞায়িত না হওয়া পর্যন্ত কে মুক্তিযোদ্ধা এবং কে মুক্তিযোদ্ধা না এ বিতর্ক চলতেই থাকবে, যা কোনোভাবেই চলতে দেওয়া উচিত না। সম্পাদনা: আশিক রহমান