ক্লায়েন্ট
যায়নুদ্দিন সানী
কেন যেন আজকে বেশ সকালেই ঘুম ভেঙে গেল। উঠে পড়ব? না শুয়ে থাকব? প্রীতি এখনও ঘুমাচ্ছে। বেশ সুন্দর লাগছে ওকে দেখতে। চুলগুলো এলোমেলো হয়ে মুখের ওপর ছড়িয়ে আছে। কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকলাম। একবার ভাবলাম ডাকি। রোমান্টিক সকালটা দুজনে মিলে গল্প করি। তারপরে ভাবলাম, থাক। আর একটু পরেই তো বুয়া এসে পড়বে। তারপর তো শুরু হবে সারাদিনের ব্যস্ত রুটিন। সময়টা বরং একাকীই কাটাই। ঘড়ির দিকে চোখ পড়ল, ছয়টা বাজে। এসময় সাধারণত উঠি না। বাকি সবাই আগে উঠলেও আমি সাধারণত আরেকটু পরে উঠি। অফিস দশটা থেকে। সো মেয়েদের স্কুলের জন্য রওয়ানা করিয়ে দিয়ে, তারপর প্রীতি আমাকে ওঠায়। আটটা থেকে সাড়ে আটটার মধ্যে ওঠাটাই আমার রুটিন।
আমার সন্তান বলতে দুই মেয়ে, স্বপ্না আর অর্না। ওরা স্কুলের জন্য বেরোয় সাড়ে সাতটায়। সম্ভবত আরও কিছুক্ষণ ঘুমাবে। ওদেরকেও আসলে টেনে ওঠাতে হয়, প্রীতিই করে। ফ্ল্যাটটায় তিনটে বেডরুমের অন্যটায় দুই মেয়ে থাকে। একটা ফাঁকাই থাকে। ড্রইং রুমটা বেশ বড়। সঙ্গে একটা ব্যালকনিও আছে। সেখানে দাঁড়ালে সামনের রাস্তাটা দেখা যায়। এক কাপ চা খেতে পারলে ভালো লাগত। অনেকদিন আগে বানাতে শিখেছিলাম, মাঝে মাঝে বানিয়েও খেয়েছি। কিন্তু এখন ইচ্ছে করছে না। সিগারেট বছর খানেক হলো ছেড়েছি। আজকে একটা খেতে পারলে মন্দ হতো না। ধীরে ধীরে আবার ড্রইং রুমে ফিরে আসলাম।
সোফার পাশের ছোট টেবিলটায় রাখা ছিল ম্যাগাজিনগুলো। প্রীতি বেশকিছু মেয়েলি পত্রিকা নেয়। সেসবের মাঝে হঠাৎ চোখে পড়ল একটি পত্রিকার ঈদ সংখ্যা। এটা কবে এসেছে? ওরা পাঠিয়েছে? না প্রীতি কিনেছে? ওরা পাঠিয়ে থাকলে, আসলো কিভাবে? বাই পোস্ট এসেছে? না কেউ দিয়ে গেছে? তার চেয়েও অবাক লাগছে, প্রীতি তো আমাকে কখনও বলেনি এটার কথা। হয়তো আমি অযথা ভাবছি। হয়তো প্রীতি কিনেছে? ঈদ সংখ্যা কিনতে পারে না, এমন না, কিন্তু এসব পড়বার মেয়ে প্রীতি না। কেউ গিফট করেছে? করে নাকি কেউ? বইপত্র করে, কিন্তু ঈদ সংখ্যা? এসব সাত পাঁচ ভাবতে ভাবতে কাঁপা কাঁপা হাত বাড়িয়ে পত্রিকাটা নিলাম।
বছর দুয়েকের পুরনো। আচ্ছা, এতদিন কেন চোখে পড়েনি? হয়তো ড্রইং রুমে বসাই হয় না। কিংবা বসা হলেও, এদিকে চোখ পড়েনি। বেডরুমে আরেকটা টিভি আছে। অফিস থেকে ফিরে বাকি সময় আমার কাটে টিভি দেখে আর নয়তো নেটে পত্রিকা পড়ে। ইদানিং ফেসবুকিং শুরু করেছি। আর কী করি? মাঝে মাঝে মেয়েদের নিয়ে ঘুরতে বেড়ানো। আত্মীয়-স্বজন খুব একটা আসে না। আমাদেরও কোথাও যাওয়া হয় না। আর ক্লোজ কেউ আসলে তো সোজা বেডরুমেই চলে আসে। পত্রিকা উল্টাতে শুরু করলাম। সূচিপত্রে এসে চোখ আঁটকে গেল।
দুই. ঝিরঝিরে বৃষ্টি হচ্ছে। রাস্তাঘাট অনেকটাই ফাঁকা এখন। আজ ক্লোজিং ছিল। এই দিনগুলোতে সাধারণত দেরি হয়। প্রীতি জানে। তাই তাগাদা দেওয়া ফোন এখনও আসেনি। সাধারণত ড্রাইভারকে রাখি, কিন্তু আজ ওর কি কাজ আছে দেখে, ছুটি চাইল। আমিও আপত্তি করলাম না। অফিসের গাড়ি চাওয়া যেত, কিন্তু সেটাও নিলাম না। ড্রাইভারের কাছ থেকে চাবি রেখে দিলাম। আজ নিজেই ড্রাইভ করে যাব। খুব ভালো ড্রাইভ করতে না পারলেও কাজ চালিয়ে নিতে পারি। ফাঁকা রাস্তা হওয়াতে একটু ভালোই হয়েছে। নিজে চালাচ্ছি বলেই বোধ হয় নিয়ম একটু বেশি মানছি। সব ক্রসিংয়ে নিয়ম মানছি। ট্রাফিক না থাকলেও রেড লাইট অবজ্ঞা করছি না।
আরও একটা কারণে আজ মেজাজ বেশ ফুরফুরে। একটা পত্রিকা থেকে অফার পেয়েছি ঈদ সংখ্যায় লেখা দেওয়ার। অফার বললে ভুল হবে, আদায় করে নেওয়া। লেখালেখির অভ্যাস ঠিক কবে থেকে বলতে পারব না, তবে লিখি। আগে যখন চাকরি সূত্রে রাজশাহীতে ছিলাম, কিছু লোকাল পত্রিকার সঙ্গে সম্পর্ক হয়েছিল। তখন প্রথমবারের মতো আমার একটা গল্প ছাপা হয়েছিল। বেশ ভালোই লেগেছিল। গল্পটা কেমন হয়েছিল জানি না, আমার লেখার উৎসাহ বেড়ে গিয়েছিল। ওদের একটা লোনও পাশ করিয়ে দিই। এরপরে চাকরি সূত্রে দেশের বিভিন্ন জায়গায় যাওয়া। কখনও একে তাকে ধরে। কখনও পয়সা দিয়ে সেসব শহরের বেশকিছু লোকাল পত্রিকায় আমার গল্প ছাপা হয়েছে। খুব ভালো লিখি কি না জানি না, তবে বড় কোনো পত্রিকায় লেখা পাঠাতে সাহস করিনি।
গল্প লেখায় তেমন কোনো উন্নতি না হলেও, আমার চাকরি জীবনে হয়েছে। এখন একটি প্রাইভেট ব্যাংকের জিএম। দারুণ ক্ষমতাধর, এমনটা বলব না, তবে কিছু ক্ষেত্রে, ক্ষমতা আছে। আজকে তেমনই একটা ক্ষমতা প্রয়োগের সুযোগ ছিল। অনুরোধটা নিয়ে যিনি এসেছিলেন, তিনি এক বড় পত্রিকার সম্পাদক। সম্পাদনার সঙ্গে সঙ্গে তিনি একটা প্রকাশনা সংস্থারও কর্ণধার। প্রতিযোগিতা বাড়ছে, তাই নিজের অফসেট প্রেস চাই। আর তা করতে চাই কিছু লোন। বিশাল আকারের কিছু না। তবে এধরনের কেসে সাধারণত আমরা খুব একটা ইনভল্ভড হতে চাই না। তাই সম্ভবত জুনিয়র অফিসাররা ভদ্রলোককে ঘুরাচ্ছিলেন। হতাশ হয়ে সম্পাদক সাহেব তাই আজকে আমার সঙ্গে দেখা করতে সিদ্ধান্ত নেন।
কার্ডটা যখন পিওন এসে দিল, তখন বেশ বিরক্তির সঙ্গেই সেটাতে নজর বুলালাম। আজকের দিনে কোনো উৎপাত পছন্দ হওয়ার কথা না। ‘গিয়ে বল স্যার বিজি’ বলতে গিয়েও আঁটকে গেলাম। আসলে সম্পাদক আর পত্রিকার নাম, এই শব্দদুটোতে চোখ আঁটকে গেল। যদিও কাজের চাপ, তারপরও উনাকে সময় দিলাম। কেসটা শুনলাম। আমার একটা কথাতেই লোনটা পাশ হয়ে যাবে। সো, সুযোগটা কাজে লাগালাম। বাই দ্যা ওয়ে জানাচ্ছি এমন ভাব করে নিজের সুপ্ত প্রতিভার কথাটা বললাম। উনি শুনে উৎসাহ দেখালেন। হয়তো বা বাধ্য হয়েই দেখালেন। না দেখিয়ে উপায় নেই, আমার হাতে রয়েছে উনার আকাক্সক্ষা পূরণের চাবিকাঠি। জুনিয়র যে অফিসারের কাছে উনার ফাইলটা আছে, তাকে ডেকে, লোনটা ‘ওকে’ করে দিলাম। ভদ্রলোক দেখলাম, আমার চেয়েও একধাপ এগিয়ে। জানালেন, আজকেই সব কাজ হয়ে গেলে নাকি উনার ভালো হয়। হয়তো ধরে ফেলেছেন, কেন আমি উনার কাজ এত সহজে করে দিচ্ছি। বুদ্ধিমান লোক। আমার দুর্বল পয়েন্ট বুঝে ফেলেছেন। লোনটা যে উনার চেহারার বদলে উনার সম্পাদক পোস্টের কারণে দিচ্ছি, ব্যাপারটা আঁচ করে ফেলেছেন। কাজটা যে আমি করে দিব, সেটাও বোধহয় বুঝতে বাকি নেই। একদিক দিয়ে সুবিধাই হলো। বিনিময়ে আমি কি চাই, তাও না বোঝার কথা না। তারপরও, আমি অপেক্ষা করছি, অফারটা আসুক।
অফিশিয়াল কিছু প্রসেডিওর বাকি ছিল। বেশকিছু কাগজপত্র পূরণ করার কাজ। কাজগুলো করে, ফাইল আমার রুমেই নিয়ে পাঠিয়ে দিতে বলেছিলাম। আর সময়টা চুপচাপ বসে না থেকে, কাজে লাগাবার জন্য আমার একটা লেখা পড়তে অনুরোধ করলাম। ভদ্রতার খাতিরেই হোক আর প্রয়োজনের খাতিরে, উনি পড়লেন। কাজের ফাঁকে ফাঁকে ভদ্রলোকের মুখের দিকে চাইলাম। চেহারা দেখে মনে হলো না খুব ভালো লেগেছে। যাইহোক, পড়া শেষে প্রশংসা করলেন।
‘আরও কিছু লেখেন। সামনের বইমেলায় তাহলে একটা বই ছাপানো যাবে।’
কৃতজ্ঞতা? না সত্যিকারের উৎসাহ? হতে পারে লোন দ্রুত পাওয়ানোর জন্য বিশেষ জাতের ‘থ্যাংকস’। কাহিনী যেটাই হোক, আপাতত ডিস্ট্র্যাক্টেড হতে চাইছি না। বই প্রকাশের ব্যাপারটা খুব সিরিয়াসলি না নিলেও, মনে রাখলাম। প্রকাশনার যা নিয়মকানুন, আমাকে হয়তো বই ছাপানোর খরচ দিতে হবে। সে পরে ভেবে দেখা যাবে। আপাতত অ্যাক্টিং করলাম যেন কথাটা খুব মনে ধরেছে। ‘কি যে বলেন’ টাইপ একটা উত্তর দিলাম। এই মুহূর্তে আমার চাওয়া ঠিক সেটা না। অপেক্ষা করে আছি, আমার প্রত্যাশিত অফারটা উনি দেন কিনা?
এর মধ্যে অফিশিয়াল কাজকর্ম শেষ হয়ে গেল। অবিশ্বাস্য দ্রুততায় তার কাজ হয়ে যাওয়ায় ভদ্রলোক সম্ভবত এখন ‘হতবাক’ স্টেজে আছেন। ভবিষ্যতে কোনো সমস্যা হলে আমাকে সরাসরি যোগাযোগ করতে বললাম। আবার লোন প্রয়োজন হলে এমনই অবিশ্বাস্য দ্রুততায় সেটাও পাইয়ে দিব কথা দিলাম। এবার উনার পালা। অপেক্ষায় আছি, অফারটা দেবেন কিনা।
‘এবারের আমার পত্রিকার ঈদ সংখ্যার জন্য একটা লেখা দেন না।’ ভদ্রলোক উঠতে উঠতে বললেন। অফার? না ভদ্রতা? আওয়াজ শুনে ভদ্রতাই মনে হলো। সাহিত্যিক এবং সম্পাদক হিসেবে উনার একটা গ্রহণযোগ্যতা আছে। ‘হেঁজিপেঁজি’ গল্প ছাপিয়ে সেটার বারোটা বাজাবার লোক উনি না। মনে হচ্ছে, আশ্বাসটা মিথ্যা। জমা হয়তো নেবেন কিন্তু ছাপবেন না। তারপরও কেন যেন আরেকটা গল্প লিখতে মন চাচ্ছে।
গাড়ি নিয়ে রাস্তায় বেরিয়েই চারদিকে গল্প খোঁজা শুরু করলাম। ওই সামনে যে বৃদ্ধ রিকশাওয়ালাটা যাচ্ছে, ওরও তো একটা গল্প আছে। হয়তো ছেলেগুলো বড় হয়ে আলাদা হয়ে গিয়েছে। কিংবা হয়তো ছেলে নেই, সবগুলো মেয়ে, বিয়ে করে চলে গেছে। আচ্ছা, ওই যে রাস্তার ধারে ‘জামাই বউ’ চানাচুর বিক্রি করছে, ওর কোনো গল্প নেই? যাই দেখছি তার ভিতরেই গল্প খোঁজার চেষ্টা করছি। স্মৃতি রোমন্থন, ক্লায়েন্টদের গল্প, কলিগদের গল্প সবকিছুই ঘুরছে মাথায়, কিন্তু গল্প হচ্ছে না।
Ñক্যান আই হ্যাভ আ লিফট প্লিজ?
৩
সম্ভবত চিন্তার জগতের বেশ ভিতরে প্রবেশ করে গিয়েছিলাম। তাই ধাতস্থ হতে একটু সময় লাগল। গাড়িটা আমার তখন একটা সিগন্যালে দাঁড়িয়েছিল। এমন সময় গাড়ির পাশে এসে দাঁড়িয়েছিল। বৃষ্টির ছাট ভালো লাগছে দেখে, আমার দিকের জানালাটা খোলাই রেখেছিলাম। অচেনা একটা মেয়ের এভাবে লিফট চাওয়া? আবার অন্যরকম মেয়েও লাগছে না।
বেশভূষায় কোনো প্রাইভেট ইউনিভার্সিটির সেকেন্ড কিংবা থার্ড ইয়ারের ছাত্রী মনে হচ্ছে। কিছুটা দ্বিধায় পড়ে গেলাম। দুম করে ‘না’ বলতে কেমন যেন ইতস্তত লাগল। ‘কোথায় যাবে?’ জিজ্ঞেস করার সময় ছিল না। লাইট গ্রিন হয়ে গেছে। ইশারায় বোঝালাম পাশের দরজায় আসতে। দরজার লক খুলে দিলাম। মেয়েটা উঠে বসল।
কোথায় যাবেন?
অবাক হলাম। প্রশ্নটা তো আমি করব। খুব সমস্যা না হলে হয়তো পৌঁছেও দিব। আমি কোথায় যাব প্রশ্নটায় সত্যিই হকচকিয়ে গেলাম। বললাম, আমি তো বাসায় যাব। মেয়েটার ঠোঁটে বাঁকা হাসি ফুটে উঠল। আমাকে বাসায় নিয়ে যাবেন?
এবার সত্যিই ধাক্কা খেলাম। এই ধরনের মেয়েদের যে গেটআপটা চোখে সেঁটে আছে, তার সঙ্গে একদমই মিল নেই। মেয়েটা বেশ স্মার্ট। এমন ওয়েস্টার্ন ড্রেস পরা একটা মেয়েকে তেমন মেয়ে ভাববার একেবারে উপায় নেই। সবচেয়ে ইন্টেরেস্টিং লাগল, নিজের পেশার পরিচয় দেওয়ার স্টাইলটা। একটু ঘুরিয়ে, কিন্তু বেশ সুন্দরভাবে বুঝিয়ে দিল, ও কে। আমাকে বোকাও ভাবতে পারেন কিংবা ভ-ও বলতে পারেন। তবে সৎ সত্য হচ্ছে, আসলে তখন গল্পের প্লটের খোঁজ চলছিল মনে মনে। এবং কিছুটা হয়তো অন্যমনষ্কও ছিলাম। তাই লিফটের প্রস্তাবটার সময়, প্রথমে প্রতিক্রিয়া ছিল চমকে ওঠা। মনে যদিও প্রশ্ন জেগেছিল, ‘এত রাতে এখানে কি করে?’ তারপরও বাজে পেশাটার কথা প্রথমেই মনে আসেনি। হয়তো বেশভূষা একটা কারণ হবে। নাকি এসেছিল? হলফ করে বলতে পারব না।
তারপর আবার ভাবলাম, হয়তো সত্যিই বিপদে পড়েছে। এদিকে কোথাও এসেছিল, যাওয়ার জন্য কিছু পাচ্ছে না দেখে লিফট চাইছে। আরও একটা ব্যাপার হতে পারে। মনের কোণে বোধহয় একটা ইন্টিউশান কাজ করছিল। মনে হচ্ছিল একটা গল্পের সন্ধান পাওয়া যেতে পারে। এটা একটা বাহানাও হতে পারে। হয়তো মেয়েটার সৌন্দর্য আমাকে টেনেছিল। শ্যামলা রং। তবে বেশ মিষ্টি চেহারা। চোখটাও বেশ ঘনকালো। ‘একবার তাকালেই দেখা শেষ হয় না’ টাইপ। (চলবে)
লেখক: চিকিৎসক ও কলামিস্ট