
আন্তর্জাতিক সাক্ষরতা দিবসে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বই সাজিয়ে রাখার জন্য নয় পড়তে হবে
দীপক চৌধুরী: ছাত্রছাত্রীদের মনোযোগ দিয়ে লেখাপড়া করে সুনাগরিক হিসাবে গড়ে উঠার আহ্বান জানিয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, বইপত্র সাজিয়ে রাখার কোনো বস্তু নয়, তোমাদের পড়তে হবে। জ্ঞান অর্জন করতে হবে।
গতকাল বৃহস্পতিবার রাজধানীর ওসমানী স্মৃতি মিলনায়তনে ‘আন্তর্জাতিক সাক্ষরতা দিবস ২০১৬’-এর উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির বক্তব্যে তিনি এসব কথা বলেন।
আগামী দিনে তোমাদের মধ্যেই দেশের নেতা-প্রধানমন্ত্রী হবে উল্লেখ করে শেখ হাসিনা বলেন, কাজেই সেভাবেই নিজেদের তৈরি করতে হবে। দেশকে নিরক্ষরমুক্ত করতে দেশের ছাত্রসমাজ, শিক্ষক, জনপ্রতিনিধি, রাজনৈতিক দল ও তাদের ছাত্রসংগঠনের নেতা-কর্মীদের এগিয়ে আসার আহ্বান জানান।
দেশকে শতভাগ নিরক্ষরমুক্ত করতে সব শ্রেণিপেশার নাগরিকদের এগিয়ে আসার আহ্বান জানিয়ে তিনি বলেন, সবার উদ্যোগেই আমরা এ দেশকে দ্রুতই নিরক্ষরমুক্ত ঘোষণা করতে পারব, যদি সবাই নিজ নিজ অবস্থান থেকে নিজ নিজ এলাকার নিরক্ষরদের শিক্ষিত করার উদ্যোগ গ্রহণ করেন।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, শিক্ষার মাধ্যমে আমরা জাতিকে অন্ধকার থেকে আলোর পথে এনেছি। সারা বিশ্বে শিক্ষায় মেয়েদের অংশগ্রহণ কম বলে ছেলেমেয়ে সমতা আনার কথা বলা হয়। আর আমাদের দেশে উল্টো। এখানে মেয়েদের সংখ্যা বেশি বলে এখন ছেলেদের এগিয়ে আনতে হবে।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, প্রত্যেকটি জেলাকে নিরক্ষরমুক্ত করার উদ্যোগ নেওয়ার ফলে সাক্ষরতার হার ৬৫ দশমিক ৫ ভাগে উন্নীত হয়েছিল। যার ফলে ১৯৯৮ সালে ইউনিস্কো আমাদেরকে সাক্ষরতা পুরস্কার দেয়। আমাদের দুর্ভাগ্য ২০০১ বিএনপি-জামায়ত ক্ষমতায় এসে তারা সব উদ্যোগ বন্ধ করে দেয়, ফলে সাক্ষরতার হার আবার কমে যায়।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, ২০০৯ সালে আমরা যখন পুনরায় সরকার গঠন করি তখন দেখলাম সাক্ষরতার হার ৬৫ ভাগ থেকে কমে মাত্র ৪৪ ভাগে দাঁড়িয়েছে। তখনই আমরা আবার উদ্যোগ নেই। ইতোমধ্যেই বাংলাদেশে সাক্ষরতার হার বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৭১ শতাংশে।
তিনি আরও বলেন, দেশের সার্বিক উন্নয়নের জন্য শিক্ষিত ও দক্ষ মানবসম্পদ অপরিহার্য। ২০০৯ সালে সরকার পরিচালনার দায়িত্ব গ্রহণের পর থেকে আওয়ামী লীগ দেশের নিরক্ষর জনগোষ্ঠীকে সাক্ষরতা কর্মসূচির আওতায় এনেছে। পাশাপাশি এখনো আওয়ামী লীগ সরকার দক্ষতাভিত্তিক প্রশিক্ষণ প্রদান এবং আধুনিক ও কর্মমুখী শিক্ষায় শিক্ষিত করে দক্ষ মানবসম্পদ হিসাবে গড়ে তুলতে কাজ করে যাচ্ছে।
তিনি বলেন, জাতির পিতার পথ অনুসরণ করে শিক্ষাকে আমরা অধিকার হিসাবে ঘোষণা দিয়েছি। শিক্ষার মাধ্যমে আমরা জাতিকে অন্ধকার থেকে আলোর পথে এনেছি। সারা বিশ্বে শিক্ষায় মেয়েদের অংশগ্রহণ কম বলে শিক্ষার ক্ষেত্রে ছেলে-মেয়েদের সমতা আনার কথা বলা হয়। কিন্তু আমাদের দেশে তা উল্টো। শিক্ষায় মেয়েদের সংখ্যা বেশি বলে, এখন ছেলেদেরও এগিয়ে নিতে হবে।
শিক্ষকদের উদ্দেশ্যে প্রধানমন্ত্রী বলেন, জাতির পিতা বলেছিলেন সোনার বাংলা গড়ার জন্য সোনার মানুষ চাই। আপনারাই ছেলে-মেয়েদের আর্দশ। তাই আপানারা ছেলে-মেয়েদের নিষ্ঠাবান করে গড়ে তুলবেন। তিনি বলেন, সমগ্র বাংলাদেশে আমাদের জনপ্রতিনিধিরা আছেন, রাজনৈতিক সংগঠনের নেতা-কর্মীরা আছেন; পাশাপাশি যেসব সরকারি-বেসরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারী রয়েছেন এবং বিভিন্ন শ্রেণিপেশার নাগরিকরা যারা রয়েছেন, তারা প্রত্যেকে যদি উদ্যোগ নেন যে, আমাদের এলাকায় কোনো নিরক্ষর থাকবে না এবং আপনি তাদের সাহায্য করবেনÑনিজ নিজ উদ্যোগ নিলেই আপনারা দেখবেন যে আমরা অভীষ্ট লক্ষ্যে পৌঁছতে পারব। তিনি বলেন, এই দেশটা আমাদের। আসুন, সবাই মিলে আমরা এই দেশকে গড়ে তুলি, যাতে আমরা মর্যাদার সঙ্গে চলতে পারি।
শেখ হাসিনা বলেন, আপনারা পারেন নীতি ও মূল্যবোধের চর্চা শিখিয়ে দেশের প্রতিটি শিশুকে আদর্শ নাগরিক হিসাবে গড়ে তুলতে। ভালো-মন্দ কিংবা ন্যায়-অন্যায় বিবেচনার জ্ঞান এবং দেশাত্মবোধের শিক্ষা দেওয়া আপনাদের দায়িত্ব।
প্রাথমিক ও গণমুখী শিক্ষার প্রসারে সরকারের বিভিন্ন উদ্যোগ প্রসঙ্গে প্রধানমন্ত্রী বলেন, তার সরকার ২০১০ সালে আধুনিক ও বিজ্ঞানসম্মত জাতীয় শিক্ষানীতি প্রণয়ন করেছে। যেখানে প্রাথমিক শিক্ষা-শিক্ষার্থীর মানসিক বিকাশ, আচরণ ও ভাষা শেখানোর মৌলিক স্তর হিসাবে বিবেচিত হয়েছে।
মাধ্যমিক থেকে উচ্চশিক্ষা পর্যন্ত বৃত্তি উপবৃত্তি চালুর কথা উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান মেমোরিয়াল ট্রাস্ট থেকে বিভিন্ন পর্যায়ে দেড় হাজার দরিদ্রমেধাবী ছাত্রছাত্রীকে বৃত্তি দিচ্ছি। তিনি বলেন, এক হাজার কোটি টাকার সিড মানি দিয়ে ‘প্রধানমন্ত্রীর শিক্ষা-সহায়তা ট্রাস্ট’ গঠন করেছি। এখান থেকে প্রাথমিক হতে ডিগ্রি পর্যন্ত ১ কোটি ২৮ লাখ ছাত্রছাত্রীকে বৃত্তি দেওয়া হচ্ছে।
শেখ হাসিনা বলেন, ৪৫২ কোটি টাকা ব্যয়ে মৌলিক সাক্ষরতা প্রকল্প ৬৪ জেলার নামে প্রকল্প বাস্তবায়ন করা হচ্ছে। সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষকের পদ ২০১৪ সালে দ্বিতীয় শ্রেণিতে উন্নীত করার প্রসঙ্গ উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, সহকারী শিক্ষকের বেতন একধাপ বাড়ানো হয়েছে। তিনি বলেন, ছাত্রছাত্রী ঝরে পড়ার হার আমরা ২৪ শতাংশে নামিয়ে এনেছি। বিএনপি-জামায়াত জোট আমলে ২০০৭ সালে ঝরে পড়ার হার ছিল ৫০ দশমিক ৫ শতাংশ। ঝরে পড়া রোধকল্পে মিড-ডে মিল চালুর জন্য সমাজের বিত্তবানদের তিনি এগিয়ে আসার আহ্বান জানান।
শিশুকল্যাণ ট্রাস্ট এবং আনন্দ স্কুল প্রতিষ্ঠায় সরকারের উদ্যোগ সম্পর্কে প্রধানমন্ত্রী বলেন, শিশুকল্যাণ ট্রাস্টের আওতায় ৯১টি ‘শিশুকল্যাণ প্রাথমিক বিদ্যালয়’ প্রতিষ্ঠা করেছি। এসব বিদ্যালয়ে ছাত্রসংখ্যা ২০ হাজার। এদের প্রাথমিক স্তরে ৬০০ ও মাধ্যমিক স্তরে ৮০০ টাকা করে প্রতি মাসে বৃত্তি দেওয়া হয়। তিনি বলেন, দেশের ৫২টি জেলার ১৪৮টি উপজেলায় ১ হাজার ১৪০ কোটি ২৬ লাখ টাকা ব্যয়ে ১২ হাজার ৫৬৭টি ‘আনন্দ স্কুল’ প্রতিষ্ঠা করেছি। ফলে ঝরে পড়া ৭ থেকে ১৪ বছর বয়সী ৭ লাখ ২০ হাজার শিশু দ্বিতীয়বার প্রাথমিক শিক্ষার সুযোগ পেয়েছে।
শারীরিক ও মানসিক বিকাশ এবং ক্রীড়ানৈপুণ্য বাড়াতে প্রাথমিকে ছাত্রদের জন্য বঙ্গবন্ধু গোল্ডকাপ এবং ছাত্রীদের বঙ্গমাতা বেগম ফজিলাতুন্নেছা মুজিব গোল্ডকাপ ফুটবল টুর্নামেন্ট আয়োজন করা হচ্ছে উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ২০১০ সাল থেকে প্রতিটি বিদ্যালয়ে ‘স্টুডেন্টস কাউন্সিল’ গঠিত হচ্ছে। প্রধানমন্ত্রী অনুষ্ঠানের বক্তৃতা পর্ব শেষে মনোজ্ঞ সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানও উপভোগ করেন।
প্রাথমিক ও গণশিক্ষামন্ত্রী মোস্তাফিজুর রহমানের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠানে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের ভারপ্রাপ্ত সচিব মোহাম্মদ আসিফ উজ্জামান এবং প্রাথমিক ও গণশিক্ষা অধিদফতরের মহাপরিচালক রুহুল আমিন সরকার অনুষ্ঠানে বক্তৃতা করেন। অনুষ্ঠানে ইউনেসকোর মহাপরিচালক ইরিনা বোকোভার একটি শুভেচ্ছাবাণীও পড়ে শোনানো হয়। সম্পাদনা : সুমন ইসলাম
