দেয়ালের ওপারে একটা সুন্দর পৃথিবী আছে
আসিফ এন্তাজ রবি
হাসপাতালের একটা কেবিনে দুই অসুস্থ বৃদ্ধ। একজন বৃদ্ধ সারাদিন বিছানায় শুয়ে থাকেন। আরেকজন বসে থাকেন জানালার পাশে। বিছানায় শুয়ে থাকা বুড়োটা নড়তে চড়তে পারে না। তার খুব ইচ্ছে করে জানালার পাশে গিয়ে বসতে। তার ইচ্ছে করে জানালা দিয়ে বাইরের আকাশ দেখতে, রোদ দেখতে, বৃষ্টি দেখতে, মাঠে ছেলে পেলেরা খেলছে, লোকজন হাঁটাহাটি করছে, এগুলো দেখতে। কিন্তু সে বিছানা থেকে উঠতে পারে না।
জানালের পাশে যে লোকটি থাকে, সে খুবই ভালো। সে সারাদিন জানালার পাশে বসে বসে ধারাভাষ্য দেয়। বিছানায় শুয়ে থাকা বুড়োটাকে বলে, ভাই রে, বাইরে যা সুন্দর রোদ উঠছে। পোলাপান মাঠে ফুটবল খেলছে। জানেন ভাই, একদল দিছে সাত গোল, আরেকদল একটাও দিতে পারে না। পুরা ব্রাজিল কেস। বিছানায় শুয়ে শুয়ে লোকটা এগুলো শোনে আর হাসে।
আরেকদিন তুমুল বৃষ্টি চলছে। জানালার পাশে বসে থাকা লোকটা বলছে, ভাই রে, যে দারুণ বৃষ্টি হচ্ছে। পোলাপান আজও মাঠে নামছে। এই তো, একটা পোলা এইমাত্র আছাড় খেল। ইশশ, কি ব্যথা পাইছে। তবু কা- দেখেন ভাই, পোলাডা হাসতাছে। কোনো মানে হয়? বিছানায় শুয়ে থাকা লোকটা গল্প শোনো আর হাসে। এইভাবে দুই বুড়োর সময় বেশ ভালোই কাটছিল।
তবে সুখের সময় কি আর চিরদিন থাকে? জানালার পাশে বসে থাকা লোকটা আচমকা একদিন ঘুমের মধ্যেই মরে গেল। আর সে জানালার পাশে বসে না। বিছানায় শুয়ে থাকা লোকটার দিন আর কাটতে চায় না। আগে তার সারাদিন কেটে যেত জানালার গল্প শুনে। এখন গল্প বলার কেউ নেই।
একদিন মরিয়া হয়ে সে নার্সকে বলল, আমার বিছানাটা ঠেলে জানালার পাশে নিয়ে যাও। আমি জানালা দিয়ে বাইরের আকাশ দেখব। মাঠ দেখব, রোদ দেখব, বৃষ্টি দেখব, পোলাপানের ফুটবল খেলা দেখব।
তাকে জানালার পাশে নিয়ে যাওয়া হলো। জানালা দিয়ে সে বাইরে তাকিয়ে দারুণ ধাক্কা খেল। জানালার সামনে কিছু নেই। একটা বড় দেয়াল। কোনো মাঠ নেই, কোনো রাস্তা নেই, এমনকি উঁচু দেয়ালটার কারণে আকাশও ঠিক মতো দেখা যায় না। সে সিস্টারকে বলল, কি আজব ব্যাপার। জানালা দিয়ে তো কিছুই দেখা যায় না। তাহলে সেই লোকটা এতকিছু দেখত কীভাবে?
সিস্টার অবাক হয়ে গেল। বলল, জানালা দিয়ে কিছু দেখা গেলেও তো কোনো লাভ হতো না। কারণ জানালার পাশে যিনি ছিলেন, তিনি তো চোখেই দেখতেন না। নিজের জীবনে অনেক দুঃখ, কষ্ট, ক্ষোভ আর বঞ্চনা থাকবে। কিন্তু মানুষকে ক্রমাগত কেবল দুঃখের কথা শোনাবেন না। তাদেরকে আশার কথা বলুন, স্বপ্নের কথা বলুন, ভালোবাসা আর মমতার কথা বলুন।
আমাদের অনেকের সামনেই দেয়াল। দেয়ালের ওপারে একটা সুন্দর পৃথিবী আছে। আমরা শুধু দেয়ালের বদনাম না করে, চলুন, সবাই সুন্দর পৃথিবীর গল্পটা অন্যদের বলি। মানুষের জীবনে অনেক কাজ আছে। সম্ভবত মানুষের জীবনের সবচেয়ে বড় কাজ হচ্ছে, অন্যকে আনন্দ দেওয়া। অন্যকে একটা জিনিসই দিতে হয়, আনন্দ। কষ্টটা না হয় নিজেরই থাকুক। লেখক : সাংবাদিক ও সঞ্চালক
ঈদসংখ্যা পরিকল্পনা, সমন্বয় ও সম্পাদনা: আশির রহমান
সহ-সমন্বয়ক: শরিফুল ইসলাম, তানভীন ফাহাদ ও মাহাদী হাসান