
‘জজ মিয়া’র ভয় : ‘দেহা গেল ভালা মাইসের মত আমার গাড়ি ভাড়া নিল তারপর আমারে মাইরা ফালাইল’
রিকু আমির ও মাহমুদুল আলম : ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলার মামলায় ফাঁসানো মো. জালাল ওরফে জজ মিয়ার দিন যাচ্ছে ব্যাংক ঋণে কেনা প্রাইভেট কার ভাড়ায় চালিয়ে। পরিবারে রয়েছে কিডনি রোগাক্রান্ত মা, স্ত্রী ও ভাই-বোন। গতকাল বৃহস্পতিবার দুপুরে জজ মিয়ার সঙ্গে কথা হয় ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়ক সংলগ্ন মাতুয়াইল এলাকায়।
দিনকাল কেমন যাচ্ছেÑ প্রশ্ন করতেই সাদা রঙের প্রাইভেট কারটির দিকে আঙ্গুল উঁচিয়ে বলেন, চলতাছি তো এইডা দিয়া। ব্যাংক থেইকা চার লাখ টাকা ঋণ নিয়া কিনছিলাম। কিন্তু গাড়ি চালাইতে খুব ডর লাগে। কতো মাইনসে আমার গাড়ি ভাড়া নিতে আসে। কে কোন উদ্দেশ্যে আমার কাছে আসে, বুঝন তো যায় না। দেহা গেল ভালা মাইনসের মত আমার গাড়ি ভাড়া নিল, তারপর আমারে মাইরা ফালাইল। এইটা নিয়া আমি খুব ডরাই।
উপার্জনের বিষয়ে গাড়িটির দিকে তাকিয়ে তিনি বলতে থাকেন, টেকা পয়সার ঠিক নাই। কোনো সময় মাসে সাত হাজারও পাই আবার ১৫ হাজারও পাই। এই যে দেহেন, গত দুই সপ্তাহ ধইরা কোনো খ্যাপ (ট্রিপ) নাই। কিন্তু খাওন পিন্দন তো ঠিকই লাগে। সামনে ঈদ, কত খরচ আছে। কিন্তু ক্যামনে কী করুম, বুঝতে পারতাছি না।
৩৫ বছর বয়স্ক জজ মিয়ার আকুতিÑগাড়িচালক হিসাবে কোনো সরকারি অফিস-আদালতে নিয়োগ দিয়ে সরকার যেন তার উপার্জনের পথে শঙ্কা কমিয়ে দেয়। তিনি জানালেন, আত্মীয়-স্বজনের কাছ থেকে ধার করে ব্যাংক ঋণ শোধ করেছেন। কিন্তু স্বজনদের ঋণ শোধ হয়নি এখনও। এর উপর তার মায়ের দুটো কিডনি স্থায়ীভাবে বিকল হওয়ার পথে। এজন্য মাঝে মধ্যে হাসপাতালে যাওয়ার পাশাপাশি দৈনিক প্রায় ২০০ টাকার ওষুধ লাগছে। নববধূসহ পাঁচ সদস্যের পরিবার, জজ মিয়াকেই বহন করতে হচ্ছে সংসারের অধিকাংশ খরচ।
তিনি আরও জানান, প্রায় ১৫-১৬ বছর আগে তার বাবা মোহাম্মদ রশিদ মৃত্যুবরণ করেন। আর চার ভাই ও এক বোনের মধ্যে জজ মিয়া দ্বিতীয়। ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের রায়েরবাগ এলাকায় তার বাসা। সেখানে দুই কক্ষের বাসার ভাড়া দেন মাসে ৭ হাজার টাকা। বড় ভাই তার সংসার নিয়ে আলাদা বাস করেন। তৃতীয় ভাই গাজীপুরে ব্যাটারিচালিত অটোরিকশা চালান। একমাত্র বোনকে এ বছর উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়ের মাধ্যমিক শ্রেণিতে ভর্তি করিয়েছেন। এর পাশাপাশি একটি বেসরকারি ক্লিনিকেও কাজ করে। ছোট ভাই পুরান ঢাকার সিদ্দিক বাজারে ব্যাগের কারিগর।
জজ মিয়া বলেন, হেই ঘটনা (গ্রেনেড হামলা মামলা) আমারে তছনছ কইরা দিছে। তহন তো গুলিস্তানে হকারি করতাম আর মতিঝিলে ফল বেচতাম। জেল থেইকা বাইর হইয়া গার্মেন্টসের কাপড় বেচছি ফুটপাতে। কিন্তু শরীরে কুলাইতো না। অসুস্থ হইয়া পড়তাম। এরপর ড্রাইভিং শিখি। একটা বেসরকারি টিভিতে চাকরি পাইছিলাম। বেতন দিত ৭ হাজার টাকা। এইটা দিয়া কী আমার চলে? বহুত কইছি বেতন বাড়াইতে, কিন্তু বাড়ায় নাই। পরে আমি চাকরি ছাইড়া নিজে গাড়ি কিননের চেষ্টা করি। এহন দেখতাছি, মার্কেট খারাপ, গাড়ি কিন্না ধরা খাইছি।
নিজের শারীরিক অবস্থা সম্পর্কে জজ মিয়া বলেন, রিমান্ডে আমারে যে মারা মারছে, এহন যে বাইচা আছি, এইটা বোনাস। এখনও রাইত হইলে ঘুমাইতে পারি না। ডাইন হাতে অনেক ব্যথ্যা করে। ডাক্তার দেখাইছি, কিন্তু যে টেকা চায়, ওইটা তো দিতে পারি না। আমার রোজগার বাড়লে নিজের আর মায়ের চিকিৎসা করাইতে পারুম, সংসারটারে ঠিকভাবে টানতারুম, আমিও আরেকটু নিরাপদে থাকুম। সরকার যাতে আমার দিকে একটু নজর দেয়। আমি তো বেশি কিছু চাই না, আমারে যাতে একটা সরকারি ড্রাইভারির চাকরি দেয়।
