এখন অপেক্ষা পদক প্রত্যাহার নাটকের ফাইনাল এপিসোডের
জায়নুদ্দিন সানী
অবশেষে পদক প্রত্যাহার। কাজটা করবে, না করবে নাÑ এ নিয়ে খুব একটা সন্দেহ মনে হয় কারো মনেই ছিল না। ‘একবার যখন শখ হয়েছে, কাজটা করবেই’। তার উপর বিএনপি যদি বলে ‘কাজটা ন্যক্কারজনক’ তাহলে তো আওয়ামীরা সেটা করবেই। সো, এই ঘটনা ঘটতই। সমস্যা হচ্ছে, এই ঘটনাকে ঠিক কোন ক্যাটাগরিতে ফেলব। আই মিন, রাজনীতিতে আসলে কিছু ইস্যু ‘তৈরি হয়’, আর কিছু ইস্যু ‘তৈরি করা হয়’। এটা কোন ক্যাটাগরির। আওয়ামী-বিএনপির বৈরিতার পরিণাম হিসাবে এই ঘটনা কি ঘটতই?
ব্যাপারটা নিয়ে ভাবছি কারণ এদেশের রাজনীতি বলে, অযথা ইস্যুগুলো তৈরি করা হয়, আর স্বাভাবিক ঘটনা বলবার চেষ্টা হয়। মাঝে মাঝে কাজে দেয়। তবে সবসময় না। ‘তৈরি হওয়া’ ইস্যু নিয়ে পাবলিক জানতে আগ্রহী হয়, আর ‘তৈরি করা ইস্যু’ নিয়ে পাবলিক ভাবতে বসে, ‘কেন তৈরি করল?’ ‘সরকার কি কোনো কাজ লুকিয়ে-চুরিয়ে করতে চাইছে? ‘কোনো চুক্তি ফুক্তি জনগণকে না জানতে দিয়ে করছে?’ পুরনো কিছু ঘটনা ঘাঁটলে এমন সন্দেহই মাথায় আসে।
পদক ইস্যুটাকে অবশ্য এই দুই ক্যাটাগরির কোনোটাতেই পুরোপুরি ফেলা যাচ্ছে না। কোনো ঘটনা আড়াল করতে এই ইস্যু ‘তৈরি করা’ হয়েছে, মনে হচ্ছে না। ‘গায়ের ঝাল’ মেটানোই মুখ্য মনে হচ্ছে। তবে আরেকটা চেষ্টা হতে পারে, ‘জিয়া পদক পাওয়ার যোগ্য কি না’ এই প্রশ্ন জনমনে জাগানো। সেটা কি হচ্ছে? মনে হয় না। এই মুহূর্তে কারো মনেই নেই। মনে একটাই প্রশ্ন, ‘কী এমন হল, যে আওয়ামীরা এই পদকের পেছনে লাগল।’ ফলে যতই ‘তৈরি হওয়া’ ইস্যু বলার চেষ্টা হোক, কাজে দিচ্ছে না। ঘুরে ফিরে প্রশ্ন এসে যাচ্ছে, ‘কেন?’
পদক প্রত্যাহারের সঙ্গে সঙ্গে যে এসব কথা আলোচনায় আসবে, একথা আওয়ামীরা জানে না, এমনটাও না। সো, এটা আওয়ামীরা জেনেশুনেই করছে। প্রশ্ন হচ্ছে, কেন? এই মুহূর্তে তো তেমন কিছু চোখে পড়ছে না। আর তাই ইস্যুটাকে ‘তৈরি করা’ মনে হচ্ছে না। তাহলে কি তৈরি হওয়া? আওয়ামী নেত্রীর বাড়ি কেড়ে নেওয়ার প্রতিশোধ? হতে পারে। আরও অনেক পসিবিলিটিই মাথায় আসে। বিএনপিকে বেকায়দায় ফেলা? জিয়াকে অপমান করা? না একটা আলোচনার বিষয় যোগান দেয়া? নাকি স্রেফ ‘গায়ের ঝাল মেটানো?’ খুব ভালো বোঝা যাচ্ছে না।
যে কারণেই হোক, এই ব্যাপারে পাবলিকের তেমন কোনো আপত্তি আছে বলে মনে হয় না। ইনফ্যাক্ট, আওয়ামী-বিএনপির মাঝে চলা বউ-শাশুড়ি মার্কা এসব কথা চালাচালি, কামড়াকামড়ি, খামচা খামচি কমবেশি আমরা সবাই উপভোগ করি। গয়েশ্বর চন্দ্র সাহেব কিংবা হাসান মাসুদকে সাবকনসাসলি কিন্তু আমরা বেশ পছন্দই করি। আমাদের এলেবেলে জীবনে মাঝে মাঝে তাঁরা আনন্দের বন্যা বইয়ে দেন। সো, দ্য বটম লাইন ইজ, এদেশে আওয়ামী-বিএনপি একে অপরকে ঘায়েল করতে সারাক্ষণ মাথা ঘামাবে, সুযোগ পেলে তার সদ্ব্যবহার করবে, এটা জায়েজ। বেশ হালাল একটা ব্যাপার।
পদক ইস্যুটা যে সেটারই একটা এক্সট্রিম ভার্সান, এটা কারোর তেমন বুঝতে বাকি নেই। বাড়িঘর কেড়ে নেয়ার শুরুটা যদিও বিএনপির শুরু, তবে এখন ব্যাপারটা ডানা মেলেছে। যদি অলৌকিক কিছু না ঘটে, তবে আমার ধারণা এমন ঘটনা সামনে আরও ঘটবে। গদির পরিবর্তন হলে তো নতুন জোসে কাড়াকাড়ি শুরু হবে, তবে এবার কাড়বে অন্য পক্ষ। আলোচনার বিষয় আসলে সেটা নয়।
বিষয় হচ্ছে, পদক ইস্যুতে, ‘হারছে কে?’ পদক কেড়ে নেয়া কি বিজয়? ‘দেখ আমার কত ক্ষমতা?’ আওয়ামী থিঙ্কট্যাঙ্ক সম্ভবত সেটাই ভাবছে। কিন্তু আসলে কী হচ্ছে? জিয়া যে পেয়েছিলেন, এই খবরই বা কয়জনের মুখস্থ ছিল। কবে পেয়েছে সেই সালটা কি জানেন? সামনে বিসিএস পরীক্ষা থাকলে হয়ত জানেন, আর নয়ত আমি জানিয়ে দিচ্ছিÑ সালটা ২০০৩। এইমাত্র গুগল করে জানলাম। বরং এই প্রত্যাহারে সবাই জানল, জিয়া পেয়েছিলেন এবং সেইসঙ্গে বঙ্গবন্ধুও। আলোচনায় অনেক বেশি করে আসছে, উনাদের দুজনকে একই বছর কেন দেয়া হয়েছিল, পেছনে বিএনপির কী উদ্দেশ্য কাজ করেছিল, এসব। এটাই কি আওয়ামীরা চেয়েছিল? সেটা চেয়ে থাকলে, তাঁরা সফল। প্রশ্ন হচ্ছে এটাই তাদের চাওয়া ছিল কি না।
আচ্ছা, সত্যি করে বলুন তো কি এই পদক ফদক নিয়ে আর কেউ ভাবে? মোটামুটি তো জানাই, কোন আমলে কে পদক পাবে। বরং এসব পদকের পরে যা ঘটে, তা হচ্ছে, লুকানো দলবাজ বুদ্ধিজীবীদের ব্যাপারে আমরা আরও নিশ্চিত হই, কোনো বুদ্ধিজীবী আসলে কোন ঘাটের পানি খান। অনেস্টলি স্পিকিং, প্রতিবার পদকের পরে, আলোচনায় একটা ব্যাপারই থাকে, ‘একে কেন দিল?’ প্রশ্নটায় যা জানতে চাওয়া হয়, ‘এর চেয়ে আরও বেশি পা-চাটা লোক তো ছিল।’
তাই বলা যায়, পদকের খবরের মূল আকর্ষণ কখনোই থাকে না, ‘কে পেল?’। নিজের রঙ জাহির করে দেয়া বুদ্ধিজীবীদের পদক না পাওয়াটাই বরং খবর। যখন পদক পান না, তখন গুঞ্জন উঠতে থাকে, ‘কী হল?’ বুদ্ধিজীবী সাহেব কি ‘কেবলা পরিবর্তন করেছেন?’ ইত্যাদি। গুণ সাহেব যত না আলোচনায় আসলেন পদক পেয়ে, তার চেয়ে বেশি বাজার মাতিয়েছিলেন নিজের কাপড় খুলে, ‘আওয়ামী পা চেটেও পদক পাচ্ছি না কেন?’ উনাকে যে এমন হুমকি-ধমকি দিয়ে পদক পেতে হল, এটাই বরং বিস্ময়ের।
এমন ভাববেন না, ব্যাপারটা এক তরফা। অন্য আমলেও এমন ঘটনা ঘটেছে। যেসব বুদ্ধিজীবী এখনও মিনমিনে স্বরে এখনও ‘তারেক রহমানের মতো নেতা হয় না’ মার্কা কথা বলছেন, তাঁদের ‘অনেস্ট উইশ লিস্টে’ যে এখন পদক কিংবা পদ ঘোরাঘুরি করছে, তা বলাই বাহুল্য। সো, এইসব পদক ফদক কখনোই আর সেই সম্মানের বাহক হবে না। আগেও ছিল না, এখনও নেই। এই পদক প্রত্যাহারে একটি কথাই প্রমাণ হয়, ‘জিয়া আওয়ামী ছিলেন না’। তথ্যটা সম্ভবত দেশবাসী জানে। আর তাই এই পদক প্রত্যাহার দেশবাসীর জন্য নতুন কোনো তথ্য এনে দিচ্ছে না।
মোদ্দা কথা, ‘পদক প্রত্যাহার’ এখন হেডলাইন। আলোচনার কেন্দ্রে। আওয়ামী এবং বিএনপি নিজ নিজ ভাষায় কথা বলছে। একজন নিজের কাজকে জায়েজ করছে, আর একজন ধিক্কার জানাচ্ছে। ফলাফল? একটি জাতীয় বিনোদন, সঙ্গে একটি চায়ের স্টলের টপিক। বিএনপিও জানে, এ নিয়ে তিড়িং বিড়িং করবার মুরোদ তাঁদের নেই। আওয়ামীরাও জানে, ক্ষমতা নামক ‘আলাদিনের দৈত্য’ এখন তাঁদের কাছে, যা চাইবে, তাই হবে। এবং এটাও জানে কখনও ‘দৈত্য’ ওদের দখলে গেলে কী হবে।
এনিওয়ে, এসব গল্প আপনাদের সবারই জানা। বরং নতুন কিছু ভাবি। এই পদকের এখন কী করা যায়? কী করলে আওয়ামীদের ‘গায়ের ঝাল’ পুরোপুরি মিটবে? বুড়িগঙ্গায় বিসর্জন? করা যায়। তবে নদীর নাব্যের যে অবস্থা, একটু এক্সপার্ট ডুবুরি দিনদুয়েক খুঁজলেই আবার উদ্ধার করে ফেলবে। তখন এর ‘অ্যান্টিক ভ্যালু’ যাবে বেড়ে। নাহ, বিএনপির পদকের এমন মূল্যবৃদ্ধি আওয়ামীদের পক্ষে সহ্য করা সম্ভব না।
আওয়ামীদের গায়ের ঝাল মিটেছে, এমনও মনে হচ্ছে না। মনে হচ্ছে পদকটার কপালে আরও কিছু ভোগান্তি আছে। গায়ের ঝাল মেটাতে অন্য কিছু করতে হবে। কেন যেন মনে হচ্ছে, পদক প্রত্যাহারের চেয়ে পদক নিয়ে কী করা হবে, সেখানে দারুণ কোনো বিনোদন অপেক্ষা করছে। খেলা মনে হয় অচিরেই শুরু হবে। কী করলে এই পদকের সঠিক মূল্যায়ন হবে, তা নিয়ে আওয়ামী থিঙ্কট্যাঙ্ক মনে হয় বসে গেছে। ক্রিয়েটিভ কিছু আশা করছি না, তবে কমেডি শো যে হবে তা নিশ্চিত। সো, লেট’স ওয়েট ফর দ্য ফাইনাল পার্ট অব দ্য এপিসোড।