ফেসবুকে এ সপ্তাহের বাংলাদেশ
এসব দেখার কোথাও কেউ নেই
গোলাম মোর্তোজা, সম্পাদক, সাপ্তাহিক
মাঠে খেলল মেয়েরা। গর্বিত করল পুরো দেশকে। রথি-মহারথিদের কৃতিত্ব নেওয়ার প্রতিযোগিতায় নাচানাচি করতে দেখলাম। আর গত দুইদিন ধরে কী নিউজ দেখছি! বাসে মেয়েদের গালাগালি করা হচ্ছে, একজন মেয়ের বাবাকে পেটানো হয়েছে, স্কুল থেকে নাকি ৯ জনকে টিসি দিয়ে বের করে দেওয়ার হুমকি দেওয়া হয়েছে। ঘটনার নেপথ্যে কী আছে, কতটা সত্য এসব সংবাদ …কারও কোনো অ্যাকশন দেখছি না। মনে হচ্ছে, এসব দেখার কোথাও কেউ নেই। কী এক আজব দেশে পরিণত হলো বাংলাদেশ! সবকিছু একজন নির্ভর। ঘর-সংসার বা ব্যবসা-প্রতিষ্ঠানÑ এই পদ্ধতিতে চলতে পারে, দেশ নয়। এই পদ্ধতিতে মেয়েদের এখন পত্রিকায় বিজ্ঞাপণ দিয়ে ‘প্রধানমন্ত্রীর নিকট আকুল আবেদন’ জানাতে হবে।
মৃত মানুষকে শাস্তি দেওয়া যায় না
পিনাকি ভট্টাচার্য, চিকিৎসক ও কলামিস্ট
মৃত মানুষকে শাস্তি দেওয়া যায় না। দেওয়াটা সম্ভবও নয়। সে জাগতিক সবকিছুর ঊর্ধ্বে উঠে যায়। আমাদের সংস্কৃতিতে এমনকি আচরিত ধর্মে মৃতের বিরুদ্ধে সৎকারের আনুষ্ঠানিকতার মধ্যে দিয়ে সকল অভিযোগ প্রত্যাহার করে আমরা তাকে সসম্মানে সৎকার বা সমাহিত করি। ইসলামে জীবিতদের পক্ষ থেকে মৃতদের ক্ষমা করার জন্য জানাজায় দোয়া করার সময় বলা হয়, ‘হে আল্লাহ আমাদের জীবিত-মৃত, উপস্থিত-অনুপস্থিত, বালক-বৃদ্ধ, পুরুষ-স্ত্রীলোকদিগকে ক্ষমা করো’। হিন্দু ধর্মেও যাকে সমাজ মৃতের সৎকারের জন্য নির্বাচন করে তাকে বলতে হয়, মৃতের সকল পাপ সত্ত্বেও তার সর্বশরীর দহন করে তাকে দিব্যলোকে স্থান দাও।
মৃত্যুর পরে তার কাজের পর্যালোচনা করতে পারি, মূল্যায়ন করতে পারি; সেটা করাটা জরুরিও। কিন্তু তাকে শাস্তি দিতে পারি না। কারণ সেই শাস্তি তাকে স্পর্শ করে না। মৃতদেহকে অসম্মান করতে পারি না। কারণ এটা আমাদের ঐতিহ্যের বিরোধী। মৃতকে শাস্তি দেওয়াটা একটা ইউরোপিয় ধারণা।
দ-িতের যন্ত্রণা প্রকাশ্যে দৃশ্যমান করাটা ইউরোপিয় ঐতিহ্য। গাদ্দাফির মৃতদেহকে পচতে দিয়ে প্রদর্শন করার পক্ষে ক্রিস্টোফার হিচেন্স লিখেছিলেন, ‘ংধঃরংভুরহম ঃড় ংবব ঃযব পধফধাবৎ ড়ভ ঃযব সড়হংঃবৎ ধহফ নব ংঁৎব ঃযধঃ যব পধহ’ঃ পড়সব নধপশ’। হিটলারের ধারণা ছিল পরাজয়ের পর তার মৃতদেহকে অসম্মানিত করে প্রদর্শন করা হবে; সেই ভয়ে হিটলার তার মরদেহ পুড়িয়ে ফেলার নির্দেশ দিয়েছিল। হিটলার খুব ভালো করে জানতো তার ইউরোপের ঐতিহ্য কী?
ইউরোপের এই ভাবনার পিছনে এনলাইটেনমেন্টের অবদান আছে। এনলাইটেনমেন্ট তো সব ফেনোমেননকে ফিজিক্যাল মনে করে, তাই মৃত মানুষের দেহাবশেষ নিষ্প্রাণ হলেও সেটাকে শাস্তি দিলেও তাদের চলে। আমাদের চলে না। আমাদের কাছে স্পিরিচুয়াল জগতটাও একইসঙ্গে গুরুত্বপূর্ণ। মানুষের সম্পর্ক, ভাব, ভালোবাসা, কল্পনা এগুলোর মূল্য আমাদের কাছে অপরিসীম।
জিয়াউর রহমান তার সকল সীমাবদ্ধতা নিয়েও আমাদের ইতিহাসের গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক ও সামরিক চরিত্র। তাকে বাদ দিয়ে আমাদের স্বাধীনতার, মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস লেখা সম্ভব নয়। সেই জিয়াউর রহমানের স্বাধীনতা পদক কেড়ে নেওয়াটা এক ধরনের জিঘাংসা। মৃতের সঙ্গে এই বিবাদ নিন্দাযোগ্য। এটা আমাদের আচরিত ধর্ম, সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যের সঙ্গে সাংঘর্ষিক।
ছায়ার সঙ্গেই যুদ্ধ করে চলেছি
স্বকৃত নোমান, কথাসাহিত্যিক
প্রতিদিন অফিস থেকে বাসায় ফেরার পথে প্রতিটি মানুষের মুখের দিকে তাকিয়ে মনে হয়, তারা একেকজন যেন সব যুদ্ধে হেরে আসা ক্লান্ত পদাতিক। মনে হয়, তারা যেন শাস্ত্রপ্রোক্ত কোনো দেবতার শাপ বয়ে বেড়াচ্ছে। হয়তো আমার মুখের দিকে তাকিয়ে তাদেরও এমনই মনে হয়। মনে হয়, এই লোকটা, এই যে আমাদের মুখের দিকে তাকিয়ে থাকা লোকটা আমাদের চেয়েও বেশি পরিশ্রান্ত, পরাজয়ের বেদনায় বড় বেশি নুয়ে পড়া।
আমরা আসলে আমাদের ছায়ার সঙ্গেই যুদ্ধ করে চলেছি। এক মহাযুদ্ধ। এই যুদ্ধের নামই জীবন। জীবন আসলে বড় বেশি কর্মব্যস্ত, অগভীর, একঘেয়ে। এর কাছ থেকে আমরা মুক্তির পথ খুঁজে বেড়াই হরদম।
এক সুখকর, পরিপূর্ণ আনন্দভরা জীবন শুধু খুঁজে বেড়াই। শুধু খুঁজে বেড়াই। কিন্তু পাই না। এ এক গোলকধাঁধাঁ। যেদিকে তাকাই শুধু দেখি অসংখ্য পথ। আমরা কেবলই ঘুরপাক খেতে থাকি। আমাদের খোঁজা থামে না। খুঁজতে খুঁজতে আচমকা মৃত্যু এসে দুয়ারে দাঁড়ায়। বলে, চলো। আমরা বিস্ময়ে তার দিকে তাকাই। জীবনকে তো এখনও উদ্যাপনই করা হলো না, তার আগে কোথায় চলে যাব? আশ্চর্য!
এই কর্মব্যস্ততার মধ্যেই আসলে জীবনকে যাপন করতে হয়। সুখ আর আনন্দকে ডেকে হাত ধরে ঘরে ঢুকিয়ে বলতে হয়, এসো আমরা পরস্পরের কোমর জড়িয়ে নৃত্য করি।
মোসাহেবরাও এই প্রশ্নে নীরব-নির্বাক
ফিরোজ আহমেদ, কেন্দ্রীয় সদস্য, গণসংহতি আন্দোলন
মিতু হত্যাকা- রহস্য আমাদের ঠিকঠাক জানিয়ে দেয় গোটা জঙ্গিদমন নাটকে অস্বস্তিকর, গোপনীয় কিছু একটা আছে। পুলিশের কৃতিত্বের প্রশংসায় প্রায় জ্ঞানহারানো মোসাহেবরাও এই প্রশ্নে নীরব-নির্বাক। কিভাবে এই বিষবৃক্ষকে সমাজে বিস্তৃত হতে দিলো, তারপর জঙ্গি প্রশ্নকে ব্যবহার করে কে কে, কারা কারা কত কতভাবে তাদের ব্যক্তিগত, দলীয়, সামাজিক ও রাজনৈতিক এবং আন্তর্জাতিক ফায়দা হাসিল করে নিলো সাধারণ মানুষকে জিম্মি করে, সেই তথ্যগুলো কি চিরকাল গোপনই থাকবে? আমার ব্যক্তিগত বিশ্বাস, জঙ্গি খেলার অবসান ঘটবে শিকারের অভাবে। স্বেচ্ছায় বলির পাঠা হবে এমন তরুণদের মেলাটা কঠিন হয়ে পড়বে দ্রুতই।
গোত্র, ভাষা কিংবা জাতীয়তার রক্তাক্ত সংঘাতে বিপন্ন দেশগুলোতে আত্মোৎসর্গের যে মহিমা তৈরি হয়, সেটা এদেশে কখনোই পাবে না ধর্মীয় উগ্রপন্থিরা। কিন্তু, গোটা সমাজকে গণতান্ত্রিক অধিকারচ্যুত করাকে যেভাবে বৈধতা দিয়ে গেল তারা, রাষ্ট্রকে দিয়ে গেল দাঁত-নখ মেলে ঝাঁপিয়ে পড়ার সুযোগ, ব্যবহৃত হবার এরচেয়ে বড় উদাহরণ আর কি হতে পারে। যেমনÑ বাংলা ভাই-শায়খ কা- ব্যবহৃত হয়েছিল বিএনপির আমলে চরমতম দমন-পীড়নকে জায়েজ করার জন্য।