মীর কাসেমের পর ইসলামী দলগুলোর বিচার জরুরি
মিল্টন বিশ্বাস
৩ সেপ্টেম্বর মীর কাসেমের ফাঁসি কার্যকরের মধ্য দিয়ে জাতি আরেক ধাপে কলঙ্কমুক্ত হয়েছে। মীর কাসেম ছিল জামায়াতে ইসলামীর সর্বোচ্চ নীতি-নির্ধারণী ফোরাম মজলিসে শুরার সদস্য, দলটির অর্থ জোগানদাতা হিসেবেই সে পরিচিত। চট্টগ্রামের ডালিম হোটেলে নির্যাতনের ‘কৃতিত্বের’ প্রেক্ষাপটে একাত্তরের শেষ দিকে ইসলামী ছাত্রসংঘের পূর্ব পাকিস্তান শাখার সাধারণ সম্পাদক করা হয়েছিল তাকে। স্বাধীন বাংলাদেশে নতুন করে আবার ছাত্র সংগঠনের যাত্রা শুরুতে তার ওপরই ভরসা করতে দেখা যায় জামায়াত নেতৃত্বকে। স্বাধীনতার পর নিষিদ্ধ জামায়াতে ইসলামী পঁচাত্তরে রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর স্বাধীন বাংলাদেশে রাজনীতি করার সুযোগ পায়। ১৯৭৭ সালের ৬ ফেব্রুয়ারি ছাত্রশিবির যাত্রা শুরু করলে তার সভাপতি হয় সে। তারপর ঘটতে থাকে মীর কাসেমের উত্থান, যা তাকে এতটাই উদ্ধত করেছিল যে রায়ের পরপরই এই জামায়াত নেতার প্রতিক্রিয়ায় তার প্রকাশ ঘটে।
একই মুদ্রার এপিঠ-ওপিঠ হলো একাত্তরের যুদ্ধাপরাধীবৃন্দ এবং ইসলামি জামায়াত ও ছাত্রসংঘ। কারণ যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের রায় প্রদান করার সঙ্গে সঙ্গে হরতাল ও নাশকতা সৃষ্টিতে মেতে ওঠে জামায়াত ও তাদের ছাত্র সংগঠন ছাত্রশিবির। এমনকি জামায়াতের যেকোনো অপরাধী নেতাকে গ্রেফতার করার পর তারা হরতাল পালন করেছে একাধিক দিন। যারা এতদিন নেতা হিসেবে তাদের কর্তৃত্ব মেনে নিয়ে আদেশ পালন করে রগ কেটে বোমা-গ্রেনেড মেরে মুক্তবুদ্ধির মানুষদের নিশ্চিহ্ন করতে চেয়েছে তাদের এখন বুঝতে হবে এসব বড় বড় অপরাধীদের পেছনে নিজের ভবিষ্যৎ অন্ধকার করে দিয়ে দিনের পর দিন সময় নষ্ট করা বৃথা। তাদের সেই সব ধর্মপ্রাণ (?) নেতারা এখন মৃত অথবা ফাঁসির দড়িতে ঝুলছে। তাদের বিরুদ্ধে অভিযোগগুলো নিশ্চয়ই সমর্থকদের নজরে এসেছে। অপরাধগুলো ভয়াবহ। জামায়াত নেতাদের পেছনের ইতিহাস সকলের জানা।
যুদ্ধাপরাধী ও জঙ্গি সংগঠন হিসেবে জামায়াতের বিচারে ট্রাইব্যুনালের বর্তমান আইন কোনো বাধা নয়। ২০১০ সালের ২৫ মার্চ আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল গঠনের পর থেকে এ পর্যন্ত জামায়াতের সাবেক আমির গোলাম আযম, বিএনপি নেতা সালাহউদ্দিন কাদের চৌধুরীসহ অনেক ব্যক্তির বিরুদ্ধে মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় রায় হয়েছে। এসব রায়ের মধ্যে বেশ কয়েকটিতে জামায়াতকে অপরাধী সংগঠন হিসেবে উল্লেখ করা হয়। ২০১৩ সালের ফেব্রুয়ারিতে ব্যক্তির পাশাপাশি সংগঠনের বিচার করার জন্য আন্তর্জাতিক অপরাধ (ট্রাইব্যুনাল) আইন সংশোধন করা হয়েছে। এর সূত্র ধরে তদন্ত সংস্থা জামায়াতের বিরুদ্ধে তদন্ত শুরু করে। গত ২০১৪ সালের ২৭ মার্চ প্রসিকিউশনের কাছে তদন্ত প্রতিবেদন দাখিল করা হয়। আমরা সকলে জানি, জামায়াত বাংলাদেশে বিশ্বাস করে না। সকলের প্রত্যাশা তারা যেন এ দেশে রাজনীতি করতে না পারে।
উল্লেখ্য, আন্তর্জাতিক অপরাধ (ট্রাইব্যুনালস) আইন-১৯৭৩-এর ২০(২) ধারায় অপরাধী ব্যক্তির শাস্তি কী হবে, তা উল্লেখ রয়েছে। কিন্তু অপরাধী কোনো সংগঠনের শাস্তি কী হবে তা বলা নেই। তবে আইনে বলা আছে, অপরাধ প্রমাণিত হলে ট্রাইব্যুনাল যেরূপ মনে করে, সেরূপ শাস্তি দিতে পারবে। আইনের এই ধারার সুযোগে ট্রাইব্যুনালের বিচারে দোষী যেকোনো সংগঠনকে শাস্তি দেওয়ার সুযোগ রয়েছে।
এক্ষেত্রে নজির হিসেবে নুরেমবার্গ ট্রায়ালের আদেশ অনুসরণ করা যেতে পারে বলে মনে করেন অনেক আইনজ্ঞ। আইনি জটিলতা ও অস্পষ্টতাকে সরিয়ে জামায়াত-শিবিরের নৃশংসতা থেকে আমাদের নিরাপদ করতে তাদের অপরাধ বিষয়ে বিচার সম্পন্ন করা জরুরি বলে আমরা মনে করি।
লেখক: অধ্যাপক এবং পরিচালক, জনসংযোগ, তথ্য ও প্রকাশনা দপ্তর, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়
সম্পাদনা: জব্বার হোসেন