জঙ্গিবাদ প্রতিরোধে কর্তৃপক্ষের ঢিলেমি নজরদারিতে ২৩ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান
দীপক চৌধুরী : শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে জঙ্গিবাদ ও সন্ত্রাসী কর্মকা- প্রতিরোধে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের নির্দেশের পরও কর্তৃপক্ষের তরফ থেকে সাড়া পাওয়া যাচ্ছে খুবই কম। তবে চাঞ্চল্যকর কিছু তথ্য গোয়েন্দাদের হাতে পড়েছে। এরমধ্যে রয়েছে- বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে শিক্ষার্থী হিসাবে নাম সংযুক্ত থাকলেও তারা অনেকেই এখন নিখোঁজ, কেউবা বিদেশে।
সরকারের নির্দেশের পরিপ্রেক্ষিতে তিনটি বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ তালিকা প্রকাশ করেছে। তবে কর্তৃপক্ষ বলেছে, যুক্তিসংগত বা প্রকৃত কারণ তারা খুঁজে দেখবে। যদি কোনো শিক্ষার্থী গ্রহণযোগ্য কারণ ছাড়া অনুপস্থিত থাকেন, তাহলে র্যাব-পুলিশ ও গোয়েন্দারা তদন্ত করে দেখেন।
গত ১ আগস্ট সরকার বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের কাছে অনুপস্থিত শিক্ষার্থীদের তালিকা চেয়েছিল। বাড়ি পালিয়ে জঙ্গিবাদে জড়ানোর বেশ কয়েকটি ঘটনা প্রকাশ্যে আসার পর দেশের সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে টানা ১০ দিনের বেশি অনুপস্থিত শিক্ষার্থীদের তালিকা চাওয়া হয়। কিন্তু দীর্ঘ ৪০ দিনে এ ব্যাপারে আশানুরূপ সাড়া পায়নি সরকার।
গুলশানের ঘটনার পর গোয়েন্দা নজরদারিতে আছে ইংরেজিমাধ্যম ও বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় মিলে ২৩টি প্রতিষ্ঠান। এরমধ্যে রয়েছে ১৪টি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় এবং ৯টি ইংরেজিমাধ্যম স্কুল। এসব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান সম্পর্কে শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদ বলেছেন, তথ্য লুকানোর চেষ্টা করা হলে তার পরিণাম হবে ভয়াবহ।
মাসখানেক আগে নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের বসুন্ধরা ক্যাম্পাস পরিদর্শন করে বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন-ইউজিসি’র একটি তদন্ত দল। এ দলের নেতৃত্বে ছিলেন বুয়েটের শিক্ষক প্রফেসর ডক্টর দিল আফরোজা বেগম।
গত বছরের তদন্ত কার্যক্রমের সুপারিশ কতটা বাস্তবায়ন হয়েছে সেটা জানার জন্য এটি নিয়মিত পরিদর্শন হলেও জঙ্গি ইস্যুটি সামনে আসায় এ বিষয়েও নতুন করে তদন্ত করেছে দলটি। কিন্তু এতে কী রকম তথ্য পাওয়া গেল এ ব্যাপারে তারা কোনো বক্তব্যই দেননি।
এমনকি গত সপ্তাহেও এক অনুষ্ঠানে প্রাসঙ্গিকক্রমে শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদ বলেন, দেশের শীর্ষ বেসরকারি এক বিশ্ববিদ্যালয়ের কয়েকজন শিক্ষকের জঙ্গি সম্পৃক্ততার স্পষ্ট প্রমাণ আছে মন্ত্রণালয়ের কাছে।
তিনি বলেন, পরবর্তীতে এসব বিষয় সম্পর্কে আমাদের জানাতে বলেছিলাম তাদের। কিন্তু তারা কিছু উত্তর দেয়নি। সেই তথ্যগুলো আমাদের কাছে আছে। তারা উপলব্ধি করবে এমনটা ভেবেই আমরা এসব বিষয় পাবলিক করিনি।
শিক্ষামন্ত্রী জানান, সুনির্দিষ্ট তথ্যের ভিত্তিতেই গোয়েন্দা সংস্থাগুলো একাধিক প্রতিষ্ঠানকে নজরদারিতে রেখেছে। সব ধরনের তথ্য দিয়ে সহায়তা করতে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।
শিক্ষামন্ত্রণালয়ের একজন উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা জানান, বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে এ ঢিলেমির ব্যাপারে গোয়েন্দারা নজর রাখছে। তাদের কাছ থেকেই আমরা তথ্য পেতে পারি। নর্থ সাউথ বা স্কলাস্টিকা বলেছে যে, জঙ্গিরা তাদের ছাত্র ছিল। আমরা অনুরোধ করবো, কেউ যেন কোনো তথ্য না লুকায়। কারণ, এখন তথ্য লুকিয়ে চাপা দিয়ে রাখলেও একসময় সেটা বিশাল বড় আকার ধারণ করবে। তথ্য থাকলে দ্রুত আমাদের জানাক।
জানা গেছে, নজরদারিতে থাকা শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে রয়েছে মানারাত, নর্দানের ঢাকা ও খুলনা ক্যাম্পাস, এশিয়ান বিশ্ববিদ্যালয়, বিজিসি ট্রাস্ট, ইন্টারন্যাশনাল ইসলামিক ইউনিভার্সিটি অব চিটাগাং, দারুল ইহসান ও বাংলাদেশ ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়সহ ১৪টি বিশ্ববিদ্যালয়। পুলিশের একজন ডিআইজি পদমর্যাদার কর্মকর্তা বলেন, কোনো কোনো ক্ষেত্রে অভিযোগ পাওয়া যায় বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের অনেক খ-কালীন শিক্ষক ও ভিজিটিং প্রফেসরের বিরুদ্ধে। তাদের কেউ কেউ একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে বিশেষ উদ্দেশ্য নিয়েই ঢোকেন। এরপর শিক্ষার্থীদের সম্পৃক্ত করেন জঙ্গি কার্যক্রমে। কিন্তু ইউজিসির কাছে কোন বিশ্ববিদ্যালয়ে কারা শিক্ষকতা করছেন, এ ব্যাপারে বিস্তারিত তথ্য নেই। ফলে দেশি-বিদেশি অনেক ভিজিটিং প্রফেসরই এখনো সরকারের নজরদারির বাইরে রয়েছেন বলে জানা যায়।
শিক্ষার্থীরা যাতে আধুনিক বিজ্ঞান ও জ্ঞানার্জনের মাধ্যমে বর্তমান বিশ্বের সাথে তাল মিলিয়ে চলতে পারে, সে লক্ষ্যে গত ৭ সেপ্টেম্বর রাষ্ট্রপতি আবদুল হামিদ দেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর কর্তৃপক্ষকে তদারকি আরও জোরদারের নির্দেশ দেন। সেদিন বঙ্গভবনে তার সাথে বাংলাদেশ ইউনিভার্সিটি অব প্রফেশনালের (বিইউপি) নবনিযুক্ত উপাচার্য মেজর জেনারেল মো. সালাহউদ্দিন মিয়াজী সৌজন্য সাক্ষাৎ করতে এসেছিলেন রাষ্ট্রপতির সঙ্গে।
রাষ্ট্রপতি আবদুল হামিদ শিক্ষক-শিক্ষার্থী-অভিভাবকবৃন্দের সমন্বয়ে ‘মোটিভেশনাল প্রোগ্রাম’ আয়োজনের জন্য বিইউপি’র উপাচার্যকে নির্দেশনা দেন, যাতে তারা নিজেদেরকে জঙ্গিবাদের মতো কর্মকা-ে জড়িয়ে না ফেলে। আর এ ধরনের কর্মসূচি গ্রহণের উপর গুরুত্বারোপ করেন, যাতে অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয় তা অনুসরণ করতে পারে।
জানা গেছে, বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় যোগাযোগ করেছে, বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান যোগাযোগ করেছে, সরকারও যোগাযোগ করছি কী করা যায়, কীভাবে পদক্ষেপ নেওয়া যায়।
জঙ্গিবাদের সঙ্গে শিক্ষার্থীদের জড়ানো ঠেকাতে শিক্ষা
প্রতিষ্ঠানের পরিচালনা কমিটি, জনপ্রতিনিধি, বিশিষ্ট ব্যক্তিসহ সংশ্লিষ্ট সবাইকেই ভূমিকা রাখার অনুরোধ জানিয়েছে শিক্ষা মন্ত্রণালয়। জানা যায়, জঙ্গিবাদী কর্মকা-ের দায়ে এখন পর্যন্ত নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয় থেকেই বহিষ্কৃত হয়েছেন পাঁচজন শিক্ষক ও ১৪ জন শিক্ষার্থী। তবে অন্যান্য বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় থেকেও শিক্ষার্থীরা জঙ্গি কার্যক্রমে জড়িত থাকার অভিযোগে বহিষ্কার হয়েছে। তবে প্রতিষ্ঠানের ভাবমূর্তি নষ্ট হওয়ার ভয়ে তা প্রকাশ করা হয় না। পরীক্ষা না দেওয়া, অনিয়মিত থাকা, খারাপ ফলসহ নানা কারণ দেখিয়ে ছাত্রত্ব বাতিল করা হয়। ফলে ঠিক কতজন জঙ্গিসংশ্লিষ্টতার কারণে বহিষ্কৃত হলো, তা আড়ালেই থেকে যায়। পূর্ণাঙ্গ তথ্যসহকারে শিক্ষক-শিক্ষার্থীর ডাটাবেস করার কথা থাকলেও তা এখনো করেনি কোনো বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়। ফলে প্রকৃত তথ্য পাওয়া যাচ্ছে না এবং জঙ্গি সংশ্লিষ্টতা বা নেতিবাচক এ ধরনের বিষয়ে তথ্য অপ্রকাশিত বা গোপন থাকছেই। সম্পাদনা: মোরশেদ