দেশের ৬৫তম জেলা : আমতলী নাকি কলাপাড়া?
মেহেদী হাসান মহসিন
দক্ষিণাঞ্চলের গুরুত্বপূর্ণ দুই জনপথ বরগুনা জেলার আমতলী ও পটুয়াখালী জেলার কলাপাড়াকে জেলায় রূপান্তরের দাবিতে বাসিন্দারা আন্দোলন চালিয়ে যাচ্ছে। গঠন করেছে পৃথক পৃথক জেলা বাস্তবায়ন কমিটি। কলাপাড়া জেলা বাস্তবায়ন কমিটির আহ্বায়ক মুক্তিযোদ্ধা সংসদের কমান্ডার বদিউর রহমান বন্টিন এবং আমতলী জেলা বাস্তবায়ন কমিটির আহ্বায়ক পৌর মেয়র মতিয়ার রহমান, স্ব স্ব জনপথের জনগণকে নিয়ে আন্দোলন চালিয়ে যাচ্ছে।
ইতিহাস থেকে জানা যায়, আমতলী দক্ষিণাঞ্চলের একটি প্রাচীন জনপদ। ব্রিটিশ শাসনামলে ১৮৫৯ খ্রিস্টাব্দে আমতলীর গুলিশাখালীতে একটি প্রশাসনিক থানা স্থাপন করা হয়। এই থানার অধীনে ছিল আমতলী, খেপুপাড়া, গলাচিপা ও বরগুনা। ১৯০১ সালে নদী ভাঙনের কারণে থানা সদর বর্তমান আমতলীতে স্থানান্তর করা হয়। ১৯০৪ সালে গুলিশাখালী থানা আমতলী থানায় রূপান্তরিত করা হয়। ব্রিটিশ সরকারের শেষের দিকে গুলিশাখালী থানা বিভক্ত হয়ে আমতলী, খেপুপাড়া, গলাচিপা, পাথরঘাটা ও বরগুনা থানার সৃষ্টি হয়। ১৯৬৫ সালে মৌলিক গণতন্ত্রের অধিনে জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আমতলীর প্রার্থী ডা. ফজলুর রহমান ১ ভোটে হেরে যান। ১৯৬৯ সালে তৎকালীন এমএনএ আবদুল আজিজ আমতলীর পরিবর্তে বরগুনা সদরকে মহাকুমায় উন্নীত করেন।
তখন আমতলীবাসীর স্বপ্নপূরণ হয়নি অথবা আত্মসমর্পণ করেছিল আমতলীর অদূরদর্শী নেতৃত্ব। ১৯৮২ সালের ৩ নভেম্বর আমতলী থানা থেকে উপজেলায় রূপান্তরিত হয়। আন্দোলনের শুরু যেভাবে: বরগুনা জেলার সর্ববৃহৎ উপজেলা আমতলী। এই উপজেলাবাসীর দীর্ঘদিনের দাবি ভৌগোলিক অবস্থানের কারণে আমতলী উপজেলাকে জেলা ঘোষণা করা। এই দাবি বাস্তবায়নে নাগরিক সমাজ সোচ্চার হয়ে উঠেছে। জেলা বাস্তবায়নের দাবিতে আন্দোলনের শুরুটা হয় ১৯৯২ সালে। তখন আওয়ামী লীগের সাবেক সংসদ সদস্য মরহুম মো. মজিবর রহমান তালুকদারকে আহ্বায়ক করে সাবেক এমএনএ মফিজ উদ্দিন তালুকদার, সাবেক সাংসদ মতিয়ার রহমান তালুকদার, সাবেক উপজেলা চেয়ারম্যান সামসুল আলম তালুকদার, বর্তমান উপজেলা চেয়ারম্যান ও আওয়ামী লীগ সভাপতি জিএম দেলওয়ার হোসেনসহ সর্বদলীয় জেলা বাস্তবায়ন কমিটি গঠন করা হয়। ২০০৬ সালের ১ অক্টোবর জাতীয় সংসদে দাঁড়িয়ে মতিয়ার রহমান তালুকদার আমতলীকে জেলা ঘোষণার যুক্তি তুলে ধরে বক্তব্য রাখেন। সম্প্রতি জেলা বাস্তবায়নের দাবিতে ১০ আগস্ট নাগরিক ফোরামের সভাপতি অ্যাড. এম এ কাদের মিয়ার সভাপতিত্বে উপজেলা পরিষদ চত্বরে সহস্রাধিক মানুষ মানববন্ধন করে। জেলা বাস্তবায়ন কমিটির উদ্যোগে ১ সেপ্টেম্বর উপজেলার ফায়ার সার্ভিস স্টেশন থেকে ছুরিকাটা পর্যন্ত ৫ কিলোমিটার দীর্ঘ মানববন্ধন করেছে উপজেলাবাসী। পরদিন ২ সেপ্টেম্বর আমতলী উপজেলা কল্যাণ সমিতি একই দাবিতে জাতীয় প্রেসক্লাবের সামনে মানববন্ধন করে। আমতলীর পাশাপাশি কলাপাড়াও স্থানীয় পর্যায়ে এবং রাজধানীতে জেলা বাস্তবায়নের দাবিতে মানববন্ধন করেছে।
যেসব কারণে জেলা ঘোষণার দৌড়ে আমতলী এগিয়ে: এক. ভৌগলিক: ভৌগলিক দিক থেকে বিবেচনা করলেও গলাচিপা, খেপুপাড়া, তালতলী ও রাঙাবালি উপজেলার মধ্যবর্তী স্থান আমতলী। দুই. উন্নয়নবঞ্চিত আমতলী: পায়রা সমুদ্র বন্দর, শের-ই-বাংলা নৌঘাঁটি, পায়রা তাপ বিদ্যুৎকেন্দ্র, দ্বিতীয় সাবমেরিন ক্যাবল ল্যান্ডিং স্টেশনসহ সরকারের বেশকিছু মেঘা প্রকল্প কলাপাড়াতে হয়েছে। কিন্তু আমতলী সবদিক থেকেই উন্নয়নবঞ্চিত। তিন. নৌ-যোগাযোগ: সড়কপথের পাশাপাশি নৌ-পথের যোগাযোগ ব্যবস্থায় কলাপাড়ার চেয়ে এগিয়ে আছে আমতলী। চার. প্রধানমন্ত্রীর নির্বাচনি এলাকা: ২০০১ সালে জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আমতলী-তালতলী নির্বাচনি এলাকা থেকে বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। বর্তমান প্রধানমন্ত্রীর নির্বাচনি এলাকা হিসেবে আমতলীবাসীর প্রত্যাশা একটু বেশিই। পাঁচ. জমি অধিগ্রহণের স্বল্পতা: জেলায় রুপান্তরের সঙ্গে সঙ্গে দরকার হবে অনেক জমি অধিগ্রহণের। কলাপাড়ার জনগণ জেলা চাইলেও তারা জমি দিতে নারাজ। অপরদিকে আমতলীর জনগণ শুধু জেলা নয়, যেকোনো উন্নয়নের স্বার্থে সর্বোচ্চ ত্যাগ স্বীকার করতে প্রস্তুত।
দুই জনপথের জনগণ আন্দোলন চালিয়ে যাচ্ছে আর অপেক্ষার প্রহর গুনছে তাদের বহুকাক্সিক্ষত দাবি বাস্তবায়নের জন্য। তবে তুলনামূলক বিশ্লেষণে এখন পর্যন্ত জেলা ঘোষণার দৌড়ে এগিয়ে আছে আমতলী।
লেখক: চলচ্চিত্র ও জলবায়ুকর্মী / সম্পাদনা: আশিক রহমান