মানুষের আনন্দের কথকতা ও কুরবানি
কদিন আগে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে একটি ‘ভিডিও ক্লিপ’ খুব জনপ্রিয় তথা ‘ভার্চ্যুয়াল’ জগতে ‘ভাইরাল’ হয়েছিল। ক্লিপটিতে এক যুবক নিজে হোটেলে খেতে যাবার সময় হোটেলের সামনে একটি বাচ্চা ও তার মাকে সাহায্য চাইতে দেখে। অবশেষে সেই যুবক হোটেলে নিয়ে বাচ্চা ও তার মাকে পেটপুরে খাইয়ে দেয়। তার এই মানবিকতাকে সম্মান জানিয়ে হোটেলের ম্যানেজার খাবার বিল নেওয়া থেকে বিরত থাকেন।
ঢাকায় একটি সংগঠন রয়েছে, যারা বিভিন্ন অনুষ্ঠানে বেঁচে যাওয়া খাবার ফেলে না দিতে অনুরোধ করেন এবং তাদের জানাতে বলেন। কারণ সেই খাবারে কিছু দরিদ্র মানুষের একবেলার ভালো খাবার হয়। সংগঠনটির নাম ভুলে গেছি। কিন্তু সেই সংগঠন এবং ভিডিও ক্লিপের ধারণাটি যাদের মস্তিষ্ক প্রসূত, তাদের সশ্রদ্ধ সালাম জানাই। মানুষকে ছোট ছোট এমন মানবিক আনন্দ দেওয়াই মানবতা, মানুষের প্রতি মানবিক কর্তব্য। অনেকে এটাকে আনন্দ বলাতে বিস্মিত হতে পারেন। কষ্টের বিপরীত শব্দটিই ‘আনন্দ’। আর পেটের ক্ষুধার চেয়ে বড় কষ্ট পৃথিবীতে আর কী আছে?
এদেশের কতজন মানুষ দরিদ্রসীমার নিচে বসবাস করেন এ নিয়ে বিতর্ক রয়েছে। বিতর্ক রয়েছে সম্প্রতি পাওয়া নিম্ন-মধ্যম আয়ের দেশের তকমা নিয়েও। আমি সে বিতর্কে যাচ্ছি না, কিন্তু চারিপাশে চোখ মেলে তাকালে আমরা দেখতে পাই, অসংখ্য ক্ষুধার্ত মানুষের মুখ। সকালে ‘সুখী’ প্রাতভ্রমণে বের হবেন, দেখবেন দশ বছরের একটি বাচ্চা আপনার সামনে দিয়ে বস্তা কাঁধে নিয়ে হেটে যাচ্ছে, আর সামনের ময়লার স্তুপ থেকে তুলে নিচ্ছে ময়লা কাগজের টুকরো। সকালে তার নাওয়া খাওয়ার হয়তো কিচ্ছু হয়নি।
দুপুরে অফিস থেকে বেরুবেন, দেখবেন বাচ্চা কোলে করুণ মুখের একজন মা আপনার সাহায্য প্রার্থী। ছুটির বিকেলে নিজ সন্তানকে নিয়ে ফ্যান্টাসি কিংডমে ‘আনন্দিত ফ্যান্টাসি’ সেরে বাচ্চার হাতে একটি দামি আইসক্রিম ধরিয়ে দিয়ে গাড়িতে উঠতে যাবেন, দেখবেনÑ গেটের পাশে আপনার বাচ্চার বয়সী আরেকটি বাচ্চার চকচকে চোখ চেয়ে আছে আপনার বাচ্চার হাতে ধরা আইসক্রিমটির দিকে।
একদিন একটু কষ্ট করে একটি এতিমখানায় যান। পনেরো দিন কিংবা মাসে একবার গরুর গোশতের ভুনা খিঁচুড়ি খায়। আর সেই দিনটির আশায় বসে থাকে সেখানে বসবাসরত অনেকগুলো শিশু। এই একটি দিনের ভালো খাওয়া তাদের কাছে কতটুকু প্রত্যাশিত ‘প্রতিদিনের ভালো খাওয়ার সুবিধাপ্রাপ্ত’ আপনি হয়তো বুঝবেন না। কিন্তু মাসের ওই দিনটি ওই বাচ্চাদের কাছে ঈদের দিনের কাছাকাছি আনন্দের।
এই যে ‘ঈদের দিন’ শব্দটি, এই শব্দটি যুক্ত থাকে প্রতিটি আনন্দের সঙ্গে, প্রতিটি অপ্রত্যাশিত প্রাপ্তির সঙ্গে। আমরা কথায় কথায় বলি ‘এক্কেবারে ঈদ লাগছে’। একদিনের ভালো খাওয়া মানে ঈদের আনন্দ। একটি অপ্রত্যাশিত ভালো জামা মানে ঈদের আনন্দ। চরম দারিদ্র্যতার মধ্যে একটু ভালো কিছু মানেই, ঈদ। আর আল্লাহ তায়ালা সম্ভবত ভালো জিনিসের আনন্দ বোঝাতেই ঈদের দিন দুটি দিয়েছেন। ঈদুল ফিতর আর ঈদুল আযহাÑ এই দিন দুটির সঙ্গে যুক্ত রয়েছে তিনটি শব্দ ফিতরা, যাকাত, কোরবানি। ‘যাদের আছে’ তাদের কাছ থেকে ‘যাদের নেই’ তাদের পাওয়ার দিন এই দুই ঈদ। যাদের আছে তারা এই পাওয়ার বিষয়টির মর্ম খুব একটা বুঝতে পারবেন না। তাদের বুঝতে হলে মানবিক বোধটা জাগ্রত করতে হবে। একটু কষ্ট করে মানুষকে বুঝতে চেষ্টা করতে হবে, একটু পড়াশোনা করতে হবে। কিন্তু যারা অর্থেবিত্তে সামর্থ্যবান তাদের বেশির ভাগই কেন যেন এই কষ্টটুকু করতে চান না। সামর্থ্যবানেরা অন্যের কষ্ট বোঝার চেয়ে নিজের সামর্থ্য প্রমাণে বড় বেশি ব্যস্ত হয়ে পড়েন। কোরবানির পশুÑ কে কতো দামে কিনতে পারেন তার প্রতিযোগিতায় নেমে পড়েন। যেখানে ইসলাম অনুযায়ী যাকাত দিতে হয় অর্থে, সেখানে সামর্থ্যবানেরা ‘কোয়ান্টিটি’তে বেশি ‘কোয়ালিটি’তে কম এমন শাড়ি লুঙ্গির বিতরণ প্রতিযোগিতায় ব্যস্ত হয়ে পড়েন। আর তাদের এই ‘অসভ্য’ প্রতিযোগিতায় ধর্ম আর মানবতা উভয়েই বিপর্যস্ত হয়, বিপদগ্রস্ত হয়।
ধর্ম নিয়ে এমন বালখিল্যতা ধর্মকেই অপমানিত করে, মানবিকতাকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখায়। অনেকে প্রশ্ন করতে পারেন, এখানে মানবিকতা পেলেন কোথায়? কোরবানির নামে অবাধ পশু হত্যা তো অমানবিক, ধর্মের নামে কত পশু সারাবিশ্বে নিধন হয় তার ধারণা কি আপনার আছে? ধর্মের নামে পশু নিধন (?) কোনোভাবেই সমর্থন যোগ্য নয়! এমন প্রশ্ন উঠতেই পারে এবং এর জবাব দেওয়াও খুব কঠিন কাজ নয়।
কোনো নিগূঢ় তত্ত্ব আলোচনা নয়, সোজা জবাব। মানুষ যখন সভ্যতার স্বাদ পায়নি তখন কাঁচা গোশত খেয়ে তাদের জীবনধারণ করতে হয়েছে। আগুন আবিষ্কৃত হবার পর পুড়িয়ে খেয়ে। তখন ধর্ম আসেনি কিন্তু মানুষকে উদরপূর্তির জন্য পশুহত্যা করতে হয়েছে। সারাবিশ্বে প্রতিদিন কত পশু মানুষের খাদ্যের জন্য হত্যা করা হচ্ছে তার হিসাব কি কারও কাছে আছে! বছরে একদিনের কোরবানিতে সব পশু শেষ হয়ে যাবে? আর পশুহত্যা কি শুধু মুসলিম উৎসবেই হয়? এসব ভেবে দেখার মতো মেধা থাকলে এমন বোকার মতো প্রশ্নের উৎপত্তি হতো না।
বোকার মতো প্রশ্ন নয়, বরং কোরবানির পর দরিদ্র মানুষের আনন্দিত চোখগুলোর দিকে তাকান, যাদের কাছে ঈদ মানেই বছরে একটা দিন প্রত্যাশিত পেটপুরে খাওয়া। দেখুন, একটি পশু থেকে প্রাপ্ত গোশতের একটি অংশ দরিদ্র মানুষকে দেওয়ার পর তাদের চোখে তারার মতো ফুটে উঠা আনন্দের দ্যুতি। পরিবার পরিজন নিয়ে পেটপুরে খাওয়ার একটি আনন্দময় সময় তাদের চোখকে এমন দ্যুতিময় করে তোলে।
এই ‘পশুহত্যা’ মানে নিষ্ঠুরতা নয়। মানুষের খাদ্য তালিকায় থাকা পশুদের হত্যা করা হয় মানুষের জন্যই। একশ্রেণির মানুষ আছেন যারা গোশত খান না, মাছ খান না। অর্থাৎ তারা প্রাণী হত্যা করেন না। কিন্তু তারা তো নিরামিষ খান। গাছেরও তো প্রাণ আছে এমন তর্কে না হয় নাই গেলাম। কিন্তু পৃথিবীতে মানুষের জীবনধারণের জন্য সবচেয়ে প্রয়োজনীয় অক্সিজেন এবং তার প্রাপ্তি নির্ভর করে উদ্ভিদের উপরেই। সুতরাং প্রাণী হত্যা নিষ্ঠুরতা এমন হাস্যকর যুক্তির বিপরীতে যুক্তি দিতে ‘প্রাণী হত্যা নিষ্ঠুরতা’ এমন বিষয়টিই হাস্যকর হয়ে উঠে। ইসলামে কোরবানি কী এবং কেন তা নিয়ে অনেক লেখা হয়েছে, ধর্ম বিষয়ের বিজ্ঞজনেরা এ নিয়ে ব্যাখ্যা করেছেন। আমি ধর্মের ব্যাখ্যা বিশ্লেষণে যাইনি এবং যাব না। তবে যারা অহেতুক পশুহত্যা বিষয়ে কথা বলেন এবং নিরামিষ ভোজে তৃপ্তির ঢেকুর তুলতে চান তাদের জন্য একটি কুরআনের আয়াত রয়েছে এরকম, ‘যখন সে প্রস্থান করে, তখন সে বিশ্বজুড়ে অনিষ্ট করে এবং শস্যক্ষেত্র ও জীবজন্তুর বংশ নিপাতের চেষ্টা করে। আল্লাহ অশান্তি পছন্দ করেন না। সুরা বাকারা, আয়াত, ২০৫’
আল্লাহ তায়ালা অপ্রয়োজনীয় কারণে উদ্ভিদ এবং জীবজন্তুর বংশ নিপাতের চেষ্টা পছন্দ করেন না তা তিনি তার কুরআনের মাধ্যমেই মানুষকে পরিষ্কারভাবে জানিয়ে দিয়েছেন এবং এমন কাজ থেকে বিরত থাকতে বলেছেন।
আল্লাহ তায়ালা খাদ্য হিসেবে মানুষের জন্য দিয়েছেন উদ্ভিদ ও প্রাণী। তবে সব উদ্ভিদ ও প্রাণীই মানুষের খাদ্য নয়। আল্লাহ তায়ালা শুধু খাদ্যের জন্যই নয়, মানুষের অন্যান্য প্রয়োজনেও উদ্ভিদ ও প্রাণীর সৃষ্টি করেছেন। তাই হালাল ও হারামের মাধ্যমে ভাগ করে দিয়েছেন তিনি কোনটা খাবার উপযোগী, কোনটা নয়। কুকুর মানুষের খাদ্য নয়, তারপরও পৃথিবীতে কুকুর খাওয়া হয়। ইসলামে হারাম শূকর, যা খেলে রক্তবাহী শিরা বন্ধ হয়ে যায়, চর্বি জমে, মানুষের কষ্ট অবধারিত হয়ে উঠে, তাও মানুষ খায়। ঘোড়া এবং বিষাক্ত সাপও খাদ্য হয় কিন্তু এগুলো নিয়ে কথা হয় না, কথা হয় গরু নিয়ে, কোরবানি নিয়ে। অথচ দরিদ্র মানুষের পেটপুরে ভালো খাবার সবচেয়ে উৎকৃষ্ট আনন্দ জড়িত রয়েছে যার সঙ্গে। বিচিত্র সব সমীকরণ! এমন সমীকরণে বিস্মিত হয় বোধহয় সৃষ্টিকর্তাও।
আল্লাহ তায়ালা কোরবানি সম্পর্কে বলেছেন, ‘কোরবানির জন্তুকে আমি তোমাদের জন্য একটি নিদর্শন করেছি। এতে তোমাদের জন্য কল্যাণ রয়েছে।’ এ কথাটি আমি নিছক ধর্মীয় দৃষ্টিকোণ থেকে না দেখে যদি দেখি বিশ্বের কোটি কোটি দরিদ্র মানুষকে একটু আনন্দ দেওয়ার বিষয় হিসেবে, একটি ভালো থাকার দিন হিসেবে। তাহলে ফেলে দেওয়া খাবার বাঁচিয়ে কিছু অসহায় মানুষের উদরপূর্তির আনন্দ দেওয়াতে অনেকের প্রশংসা পেলে কোরবানির ত্যাগের মাধ্যমে অনেক মানুষকে আনন্দিত করার প্রশংসা কেন পাওয়া যাবে না? রাসুল (স.) বলেন, ‘সামর্থ্য থাকতে যারা কোরবানি করে না, তারা যেন আমাদের ঈদগাহের কাছেও না আসে। ইবনে মাজা’
ইসলামে ঈদের নামাজ হলো, একটি মানবসম্মেলন, যেখানে বিশেষ ব্যক্তিদের জন্য আলাদা ‘মঞ্চ’ নেই, গদিআটা ‘প্রধান’ বা ‘বিশেষ’ অতিথির চেয়ার নেই। যেখানে ‘দেশের প্রধান’ থেকে শুরু করে ‘দেশের শেষ’ সবাই কাঁধে কাঁধ রেখে একসঙ্গে দাঁড়াতে পারেন। বুকে বুক মেলাতে পারেন। মানবতার এমন মহামিলন ক্ষেত্র আর কোথায় আছে? আর এমন একটি সম্মেলনে অংশ নেওয়ার শর্ত হিসেবে রাসুল (স.) বলেন কোরবানির কথা। যারা নিজের সামর্থ্য থাকতেও কোরবানি দেয়নি অর্থাৎ মানুষকে ভালো খাবার দেবার শর্তটুকু পূরণ করেনি, মানুষকে আনন্দ দেওয়ার শর্তটুকু পূরণ করেনি, তারা যেন সেই মানবতার সম্মেলনে না আসে। যারা মানুষকে খাবার দেয় না, আনন্দ দিতে পারে না একটু সময়ের জন্যও, একটা দিনের জন্যও মানুষকে মানবেতর জীবনের বাইরে, একটি ভালো দিন উপহার দিতে পারে না, তারা কোনোভাবেই এমন মহৎ মানবতার সম্মেলনে অংশগ্রহণের যোগ্যতা রাখে না।
এর চেয়ে বড় মানবতার বার্তা আর কী হতে পারে। যারা পশুহত্যায় ব্যথিত হন, তাদের প্রতি শ্রদ্ধা রেখেই বলছিÑ ইসলাম বলে, মানুষ সৃষ্টির সেরা জীব। সনাতনীরাও বলেন, মানুষ অমৃতের সন্তান। আর যারা ‘মানবতা’র জন্য কাজ করেন, তাদের বলি, ‘মানবতা’ শব্দটির উৎপত্তি কিন্তু ‘মানব’ থেকেই, পশু থেকে আসলে হতো ‘পাশবতা’। আপনার যদি ‘মানবতা’কে ‘পাশবতা’য় প্রতিস্থাপন করতে চান করতে পারেন। আল্লাহ তায়ালা সুরা হজের ৩৭ আয়াতে কোরবানি সম্পর্কে বলেন, ‘এগুলোর গোশত ও রক্ত আল্লাহর কাছে পৌঁছে না, কিন্তু পৌঁছে তার কাছে তোমাদের মনের তাকওয়া।’
আল্লাহ তায়ালা মূলত দেখতে চান, মানুষ হিসেবে প্রভুর সন্তুষ্টির জন্য তারা কী করেছে। প্রশ্ন করতে পারেন, আল্লাহর সন্তুষ্টির বিষয়ে, বলতে পারেন মানুষের জন্য নয় আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্যই কোরবানি। আল্লাহ তায়ালা বারবার বলেছেন, মানুষের সন্তুষ্টিই তার সন্তুষ্টি। বিপদগ্রস্ত মানুষকে সহায়তা করা আল্লাহর সন্তুষ্টি, ক্ষুধার্ত মানুষকে খাবার দেওয়া আল্লাহর সন্তুষ্টি, অসুস্থ মানুষকে চিকিৎসা দেওয়া আল্লাহর সন্তষ্টি, মানুষের জন্য প্রয়োজনী দ্রব্য, পণ্য, জীবজন্তু, উদ্ভিদ গুল্মরাজি রক্ষা করা আল্লাহর সন্তুষ্টি।
সুতরাং কোরবানিতে আল্লাহর সন্তুষ্টি মানেই মানুষের সন্তুষ্টি, এতটুকু বোঝার জন্য খুব বেশি জ্ঞানের দরকার নেই। আর যারা বোঝেন না অথবা চেষ্টা করেন না, তাদের ‘জ্ঞান’ নেই তবে ‘গরিমা’টুকু রয়েছে।
আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘জ্ঞানীদের জন্য নিদর্শন রয়েছে’। নিদর্শন আল্লাহ তায়ালা জ্ঞানীদের জন্যই রেখেছেন ‘গরিমা’ আক্রান্তদের জন্য নয়।
সম্পাদনা: আশিক রহমান