টঙ্গীতে কারখানায় আগুন ও ভবন ধসে নিহত ২৬, আহত অর্ধশতাধিক ঈদের আনন্দ পুড়ল আগুনে
সুজন কৈরী, নাঈমুল হাসান ও জাকারিয়া চৌধুরী, টঙ্গী থেকে : টঙ্গীর একটি কারখানায় গতকাল অগ্নিকা- ও ভবন ধসের ঘটনায় ২৬ জন নিহত ও অর্ধশতাধিক আহত হয়েছে। মর্মান্তিক এ ঘটনায় হতাহতদের পরিবারসহ পুরো দেশবাসীর ঈদ আনন্দ এবার অনেকটাই ম্লান হয়ে গেল।
গাজীপুরের টঙ্গী বিসিক শিল্প নগরীতে টাম্পাকো ফয়েল লিমিটেড প্রিন্টিং অ্যান্ড প্যাকেজিং নামের ওই কারখানায় সকাল ৬টার দিকে এ দুর্ঘটনা ঘটে। সেখানে ফয়েল পেপার ও কেমিক্যাল-জাতীয় দ্রব্য প্রস্তুত করা হতো বলে জানা গেছে। আগুনে পাঁচতলা ভবনটির উপরের তিনতলার অনেকটাই ধসে পড়ে। দুপুরের পর আগুন নিয়ন্ত্রণে আনা সম্ভব হয়। ভবনের ভিতরে আরও লাশ থাকতে পারে বলে আশঙ্কা ফায়ার সার্ভিসের।
ঘটনাস্থলে উপস্থিত ফায়ার সার্ভিসের কর্মকর্তা আক্তারুজ্জামান বিবিসিকে বলেছেন, নিহতদের মধ্যে ১০-১২ জন বিস্ফোরণের সময় সামনের রাস্তা দিয়ে হেঁটে যাওয়া পথচারী। এদের মধ্যে রিকশাওয়ালা, দিনমজুর, পাশের কারখানার শ্রমিকও রয়েছেন।
নিহতরা হলেনÑ প্রকৌশলী আনিসুর রহমান, আল-মামুন, ইদ্রিস আলী, জাহাঙ্গীর আলম, নয়ন, আব্দুল বাছেদ, ইমান হোসেন, মো. আলম, পথচারী আসমা আক্তার, আনোয়ার হোসেন, দেলোয়ার হোসেন, কারখানার শিফট ইনচার্জ শুভাষ, প্রিন্টিং হেলপার রফিকুল ইসলাম, সিকিউরিটি গার্ড হান্নান, অপারেটর মামুন, অপারেটর জয়নুল, ক্লিনার শংকর ও ক্লিনার রেদোয়ান।
গুরুতর আহতদের মধ্যে রয়েছেনÑ আসিফ, রোকন, দিলিপ চন্দ্র রায়, ফেরদৌস আলম, আবু সাঈদ, আকবর আলী, শহিদুল ইসলাম, আব্দুর রাজ্জাক, লিটন, মাহবুব, কামরুল ইসলাম, জাকির হোসেন, মিজানুর রহমান, নিজামউদ্দিন, শহিদুল, জাহাঙ্গীর আলম, শাহ আলম প্রমুখ। আহতদের ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, টঙ্গী সরকারি হাসপাতাল, কুর্মিটোলা মেডিকেল কলেজসহ বিভিন্ন হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে। এছাড়া নিহতদের লাশ ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের মর্গে রাখা হয়েছে।
কারখানার বয়লার বিস্ফোরণে এ ঘটনা ঘটেছে বলে গতকাল সকাল থেকে বিভিন্ন টিভি চ্যানেল ও অনলাইনে সংবাদ প্রচার হয়। তবে সন্ধ্যা পৌনে ৬টার দিকে ক্ষতিগ্রস্ত কারখানা পরিদর্শন শেষে ঢাকা অঞ্চলের বয়লার পরিদর্শক ও তথ্য কর্মকর্তা মো. শরাফত আলী বলেন, গ্যাসরুম থেকে বিস্ফোরণে অগ্নিকা-ের ঘটনা ঘটেছে। বয়লার রুম অক্ষত রয়েছে। তবে সেটি ঝুঁকির মধ্যে আছে। আগুন আরও ছড়িয়ে পড়লে বয়লার রুম বিস্ফোরণের আশঙ্কা ছিল। তিনি বলেন, এ ধরনের বিস্ফোরণ ঘটলে মিডিয়াগুলো সাধারণত বয়লার বিস্ফোরণ বলে চালিয়ে দেয়, যা উচিত নয়। কারখানার বয়লার হেলপার মোহাম্মদ ইমাম উদ্দিনও বলেন, বয়লার রুম অক্ষত রয়েছে। এই আগুন গ্যাসরুম থেকে হয়েছে।
ফায়ার সার্ভিসের উপ-পরিচালক আক্তারুজ্জামান জানান, বিস্ফোরণের খবর পেয়ে ঘটনাস্থলে পৌঁছে আগুন নিয়ন্ত্রণে আনার চেষ্টা শুরু করা হয়। আগুনের ভয়াবহতা দেখে পর পর সদর দফতরসহ জয়দেবপুর, কুর্মিটোলা, মিরপুর, উত্তরা, আশুলিয়া, ঢাকা ক্যান্টনমেন্টসহ প্রায় ২৫টি ফায়ার স্টেশনের কর্মীরা তাদের ইউনিট নিয়ে সেখানে আসেন। আগুন নিয়ন্ত্রণে আনার প্রাণপণ চেষ্টা চালিয়ে যান। কিন্তু ভবনের ৩য় ও চতুর্থ তলা অকস্মাৎ ধসে পড়ায় আগুনের লেলিহান শিখা আরও বেড়ে আশপাশে ছড়িয়ে পড়ে।
নিহত প্রকৌশলী আনিসুর রহমানের স্ত্রী নিগার সুলতানার বাসা কারখানার পাশে গোপালপুর এলাকায়। পৌনে ৬টার কিছুক্ষণ পর একটি বিকট বিস্ফোরণের শব্দ শুনে বের হন তিনি। কারখানা থেকে কালো ধোঁয়া বের হতে দেখে ছুটে যান নিগার। গিয়ে দেখেন তার স্বামীসহ কয়েকজনের লাশ বের করা হচ্ছে।
টঙ্গী রেলস্টেশনের কর্মী লিখন জানান, পাঁচতলা কারখানার চতুর্থ তলায় বেশকিছু শ্রমিক জানালা দিয়ে হাত নেড়ে তাদের বাঁচানোর আকুতি জানাচ্ছিলেন। এসময় স্থানীয়রা মই নিয়ে শ্রমিকদের উদ্ধারের চেষ্টা চালায়। কিন্তু ধোঁয়া ও তাপের কারণে ওই চেষ্টা ব্যর্থ হয়। কিছুক্ষণ পর ওই শ্রমিকদের আর কোনো সাড়া পাওয়া যায়নি। ততক্ষণে আগুন পুরো কারখানায় ছড়িয়ে পড়ে। কালো ধোঁয়ার কু-লীতে আশপাশের এলাকাও অন্ধকারাচ্ছন্ন হয়ে পড়ে। দুপুর সাড়ে ১২টার দিকেও কারখানায় আগুন জ্বলছিল। আগুন নেভাতে গিয়ে সোহেল নামে ফায়ার সার্ভিসের এক কর্মী আহত হন।
ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের বার্ন ইউনিটে রিপন দাশ (৩৫) ও দিলীপ চন্দ্র দাশের (৩৬) চিকিৎসা চলছে। রিপন দাশের ৯০ শতাংশ পুড়ে গেছে। তার অবস্থা আশঙ্কাজনক। দিলীপ চন্দ্র দাশের ৮ শতাংশ পুড়েছে। বাকিরা জরুরি বিভাগের বার্ন ইউনিটে ভর্তি রয়েছেন। তাদের বেশিরভাগই মাথায় আঘাতপ্রাপ্ত।
টঙ্গী ৫০ শয্যা হাসপাতালের আবাসিক চিকিৎসক ডা. মো. পারভেজ জানান, আগুনে দগ্ধ ও শরীরের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ ছিন্ন-বিচ্ছিন্ন হয়ে আসা ৫৫ জন শ্রমিকের প্রাথমিক চিকিৎসা দেওয়া হয়। নিহতদের ময়নাতদন্তের জন্য লাশ শহীদ তাজউদ্দিন মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের মর্গে পাঠানো হবে।
আগুন লাগার খবর পেয়ে ঘটনাস্থল পরিদর্শনে আসেনÑ স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খাঁন কামাল, নৌপরিবহন মন্ত্রী শাজাহান খান, শ্রম প্রতিমন্ত্রী মজিবুল হক চুন্নু, আইজিপি একেএম শহীদুল হক, স্থানীয় সংসদ সদস্য মো. জাহিদ আহসান রাসেল, গাজীপুর জেলা প্রশাসক এস এম আলম, গাজীপুরের পুলিশ সুপার মোহাম্মদ হারুন-অর-রশিদ, গাজীপুর জেলা মহানগর আওয়ামী লীগের সভাপতি অ্যাডভোকেট মো. আজমতউল্লা খান, সিটি কর্পোরেশন মেয়র (ভারপ্রাপ্ত) আসাদুর রহমান কিরণ, ফায়ার সার্ভিসের যুগ্ম-সচিব (প্রশাসন) আনিস মাহমুদ, মহাপরিচালক লে. কর্নেল মোশারফ, ফায়ার হেড কোয়ার্টারের স্টেশন অফিসার সারোয়ার এ খান, ইন্ডাস্ট্রিয়াল পুলিশ সুপার সোয়েব আহম্মেদ প্রমুখ।
নিহত শ্রমিকদের পরিবারকে ২ লাখ টাকা করে আর্থিক সহযোগিতা দেওয়ার আশ্বাস দিয়েছেন শ্রম ও কর্মসংস্থান প্রতিমন্ত্রী মুজিবুল হক চুন্নু। প্রতিমন্ত্রী বলেন, নিহত শ্রমিকদের প্রত্যেকের পরিবারকে শ্রমিক কল্যাণ ফাউন্ডেশন থেকে ২ লাখ টাকা করে অনুদান দেওয়া হবে।
গাজীপুর জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে নিহতদের দাফন সম্পন্ন করতে প্রত্যেকের পরিবারকে ২০ হাজার টাকা করে দেওয়া হবে বলে জেলা প্রশাসক এস এম আলম জানিয়েছেন। আহতদের প্রত্যেকে ১০ হাজার টাকা করে পাবেন।
ঘটনা তদন্তে ৩টি কমিটি করা হয়েছে। গাজীপুরের অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট (এডিএম) রাহেদুল ইসলামকে প্রধান করে গঠিত কমিটিকে আগামী ১৫ দিনের মধ্যে প্রতিবেদন দিতে বলা হয়েছে। ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্সের উপ-পরিচালক (প্রশাসন ও অর্থ) মো. বদিউজ্জামানকে প্রধান করে ৫ সদস্যের তদন্ত কমিটিকে ১০ দিন সময় দেওয়া হয়েছে। কল-কারখানা ও প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন অধিদফতরের উপ-মহাপরিদর্শক মো. শামছুজ্জামান ভূঁইয়াকে প্রধান করে ৩ সদস্যের তদন্ত কমিটি করা হয়েছে।
সম্পাদনা : হাসিবুল ফারুক চৌধুরী