সিরিয়ায় সুদূর পরাহত শান্তি
আন্তর্জাতিক ডেস্ক: পাঁচ বছর ধরে সিরিয়ায় যুদ্ধ চলছে। এই দীর্ঘ সময় পর সিরিয়ার ভাগ্যে কি ঘটেছে? শত শত মানুষ দেশ ছেড়েছে। আর পেছনে রয়ে গেছে আল-কায়েদা- আইএস’র মতো নানা সংগঠন। তবে একটা বিষয় চোখে পড়ার মতো। সিরিয়ার শান্তি আলোচনা ও নির্বাচন প্রকৃত অর্থেই প্রেসিডেন্ট আসাদের আস্থা ফেরানোর মতো ঘটনা।
লন্ডনের টেমস তীরের বিশাল ভবনে ইন্টারন্যাশনাল ইনস্টিটিউট ফর স্ট্যাটেজিক স্টাডিজ-আইআইএসএস’র সদর দফতর। গত বুধবার এখানে সমবেত হয় কূটনীতিক ও মিডিয়া কর্মীরা । এখানে সিরিয়ার জন্য একটা শান্তি পরিকল্পনা ঘোষণা করা হবে-তাই তারা এসেছেন। শেষ পর্যন্ত সিরিয়া সংকটের একটা রাজনৈতিক সমাধানের রূপরেখা ঘোষণা করে উচ্চ ক্ষমতাসম্পন্ন দরকষাকষি কমিটি। এই রূপরেখার মতে একটা রাজনৈতিক চুক্তি বা সমঝোতাই পারে সিরিয়ার রক্তপাত ও বিভীষিকাময় পরিস্থিতির ইতি টানতে পারে। যে সমঝোতা আরও আগেই করা উচিৎ ছিল। সিরিয়ার সংঘাত ৬ বছর পার করছে। এই সংঘাত দেশটিকে বহুভাগে বিভক্ত করেছে। হাজার হাজার লোক দেশের ভিতরেই বাস্তচ্যুত হয়েছে। অনেকে দেশের বাইরে উদ্বাস্তু জীবনে যেতে বাধ্য হয়েছে। এখনো পর্যন্ত মৃত্যুসংখ্যা নিশ্চিত করা যায়নি।
হতাশার বিষয় হচ্ছে এই সংঘাত বন্ধ হওয়ার কোনো লক্ষণ দেখা যাচ্ছে না। এই যুদ্ধে রাশিয়া, ইরান ও তুরস্ক তাদের যুদ্ধবিমান ও সৈন্যদের নিয়োগ করেছে। এমনটাই বলছে পশ্চিমের ক্ষমতা ধররা। তবে তারা একথা উল্লেখ করেনি যে, পশ্চিমের কিছু দেশ এবং আরব বিদ্রোহীদের মদদত দিচ্ছে।
প্রেসিডেন্ট আসাদ এবং তার নিজের লোকদের একটি অংশের সংঘাত দিয়ে শুরু। এরপর এটা ছড়িয়ে পড়ে আঞ্চলিক সংঘাত হিসাবে। সিরিয়া সুন্নি আরব রাষ্ট্রগুলো এবং ইরানের মধ্যকার দ্বন্দ্বের জন্য একটা হুমকি হিসাবে আবির্ভূত হয়। হুমকি হিসাবে দেখা দেয় পশ্চিমা শক্তি ও তাদের আরব-তুর্কি মিত্র এবং আইএস এর জন্য। সিরিয়া হুমকি হয়ে উঠে তুরস্ক ও কুর্দিদের বিরোধের জন্য। আর তুরস্ক এই হুমকিকে দেখে তাদের ভৌগলিক অখ-তার বিরুদ্ধে হুমকি হিসাবে। তাহলে আইআইএসএস এর এ সমাবেশ সিরিয়াকে কি দেবে। কোনো পশ্চিমা কূটনীতিক এ প্রশ্নের যে উত্তর দেবে তাতে হতাশই হতে হবে। বলবে, উচ্চ দরকষাকষি কমিটি এইচএনসি সিরিয়ায় বিপ্লব শুরু হওয়ার পর গঠিত সবচেয়ে প্রতিনিসধিত্বমূলক কমিটি। এতে রয়েছে বেশিরভাগ রাজনৈতিক গ্রুপের প্রতিনিধি এবং বিশিষ্ট ব্যক্তিবর্গ। কেউ সন্দেহ করলে সঙ্গে সঙ্গে উত্তর আসবে, আমরা স্বীকার করি সিরিয়ায় অনেকে আছেন যারা এখনো এইচএনসিকে সমর্থন করে না। আমাদের বিশ্বাস নতুন পরিকল্পনা ওইসব লোকদের এইচএনসিকে সমর্থন যোগাতে অনুপ্রাণিত করবে।
পশ্চিমাদের কাছে এইচএনসি হলো সেই কুহেলিকা যাদের মধ্যদিয়ে তারা সিরিয়ায় শান্তি প্রতিষ্ঠা করতে চায়। সিরিয়ার গণতন্ত্রকামী মানুষ একটি বহুদলীয় রাষ্ট্র ব্যবস্থা চায়। চায় একটা প্রতিনিধিত্বমূলক সমাজ। আর এইচএনসি হলো ফ্রি সিরিয়ান আর্মি বিদ্রোহী গ্রুপের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট একটি অংশ, যারা পশ্চিমাদের সমর্থন পেয়েছে।
সিরিয়া সংকট এখন এমন এক জায়গায় এসে দাঁড়িয়েছে যে, এ বিষয়ে উন্নাসিক হওয়ার কোনো সুযোগ নেই। এইচএনসির প্রধান সমন্বয়ক ডক্টর রিয়াদ হিজাব বলে এমন ধারণাই পোষণ করেন। বলেন, আমাদের পরিকল্পনা খুবই ভালো। এই পরিকল্পনা একটা প্রতিনিধিত্বমূলক সমাজের জন্য উত্তম। নির্বাচন পর্যন্ত দেশ পরিচালনার জন্য একটা সরকারের পরিষ্কার রূপরেখা রয়েছে এতে। আরও অনেক ভালো প্রস্তাব আছে এতে। দলিল হিসাবে এটা অনন্য। কিন্তু আলেপ্পো এবং দেশটির অন্য স্থানে যে লড়াই চলছে, তা বন্ধে এটা কতটা বাস্তবসম্মত তা বিবেচনার দাবি রাখে।
একটা বড় প্রশ্ন হলো, প্রেসিডেন্ট আসাদের ভাগ্যে কি ঘটবে। এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত আসা জরুরি। ডক্টর হিজাব বলেন, এই চক্রকে বিদায় নিতে হবে। আর জোরালো দাবি আছে যে, তাদের বিচারের কাঠগড়ায় দাঁড়াতে হবে। একই সঙ্গে তিনি বলেন, তারা কাউকে বাদ দিতে চান না বা কোণঠাসা করতে চান না। তিনি উল্লেখ করেন সাদ্দাম পরবর্তী ইরাকের অভিজ্ঞতার কথা। তারা সামরিক বাহিনী থেকে ব্যাপক ছাঁটাইও চান না। কিন্তু যখনই প্রশ্ন উঠে আসাদ ও তার সমর্থকদের শেষ পর্যন্ত কী হবে? তখন তিনি কুটিল হয়ে উঠেন। বলেন, অনেক সামরিক কর্মকর্তা ইতোমধ্যেই আসাদের পক্ষ ত্যাগ করে বিদ্রোহীদের সঙ্গে যোগ দিয়েছে। এখনো যারা আসাদের পক্ষে কাজ করছে তাদের কী হবে? এমন পাল্টা প্রশ্ন করেন তিনি। বলেন, তাদের কী শোধন করা হবে, অবসরে পাঠনো হবে না-কি বিচারের মুখোমুখি করা হবে?
বাস্তবতা হলো এসব প্রশ্নের তীব্রতা কতটা তা এইচএনসি নেতারা জানেন। তারা জানে তাদের সমস্যার তীব্রতা সম্পর্কেও। তাদের মূল সমস্যা হলো তাদের পৃষ্ঠপোষকরা।
এইচএনসির পরিকল্পনার ভিত্তি হলো ২০১২ সালের জেনিভা ঘোষণা। যেখানে কূটনৈতিকরা সিরিয়া সংকট নিয়ে কিয়ৎকালের জন্য একমত হয়েছিলেন। এখন আর সেই সময় নেই। এরপর রাশিয়া ও ইরান আসাদ সরকারের পক্ষ নেয়। আর ধীরে ধীরে সিরিয়া সংকট একটা আঞ্চলিক সংকটে পরিনত হয়।
সবচেয়ে খারাপ দিক হলো সিরিয়া নিজেদের মধ্যেই ব্যাপকভাবে বিভাজিত হয়, উদ্ভব ঘটে অনেক যুদ্ধ-দলের। যারা ঘন ঘন মিত্র বদল করে। একটু বাড়িয়ে বললে, বলতে হয় সিরিয়া রাষ্ট্রের কোনো অস্থিত্ব থাকলেই কেবল কোনো নতুন গণতান্ত্রিক সরকারের কাছে তা তুলে দেওয়া যাবে।
এমন পরিস্থিতিতে এইচএনসি বলে, প্রেসিডেন্ট আসাদ যদি বিদায় না নেন, বা অন্তবর্তী ব্যবস্থা যদি দির্ঘায়িত হয় তবে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় তা দেখবে। তখন জাতিসংঘ তার ভূমিকা রাখবে। এইচএনসি, আসাদ সরকাররের বিরুদ্ধে ভূমিকা রাখতে ব্যর্থ হওয়ায় ্ওবামা প্রশাসনেরও সমালোচনা করে। প্রশ্ন হলো নতুন মার্কিন প্রশাসন কি ভিন্ন চিন্তা করবে?
এখন বিবেচনার বিষয় কোন বিন্দুতে দাঁড়িয়ে আছে সিরিয়া সংকট? অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে আসাদ সরকার শক্তিশালী হচ্ছে। সরকারি বাহিনী আলেপ্পোর দিকে অগ্রসরমান। মনে হচ্ছে মস্কো ও তেহরান চায় আসাদ সরকার টিকে থাকুক। হয়তো এই সরকার ঠুনকো। তারপরও জাতীয়ভাবে জনসমর্থন আছে এমন বিকল্প শক্তিকেন্দ্র তো নেই!
এইচএনসি মনে করে তারাই হয়ে উঠবে বিকল্প শক্তি। এখনতো ঘটনা প্রবাহ আর কূটনৈতিক পর্যায়ে নেই। পুরো বিষয়টাই অকার্যকর হয়ে যাচ্ছে সামরিক জালে আটকে। এইচএনসির পরিকল্পনা সম্পর্কে কেবল একথাই বলা যায়, এতে অনেক ভালো দিক আছে। এতে অনেক সমস্যা অনুধাবনের কথা প্রতিফলিত হয়েছে। তার পরও এই দলিল আলমারিতে বন্ধ থাকবে অনেক দিন। তার পর এই দলিলের উপর ধূলা জমবে। আর আশা থাকবে, যদি কোনো দিন সিরিয়ায় শান্তি প্রতিষ্ঠার জন্য সত্যি উদ্যোগ নেয়া হয়, তবে সেদিন ধূলো ঝেড়ে এই দলিল দেখানো হবে। আর শান্তিকর্মীদের পথ দেখাবে সামনে এগিয়ে যাওয়ার জন্য। বিবিসি। সম্পাদনা : রিকু আমির