শিশুর বিকাশে চাই নিরাপদ পৃথিবী
মাহফুজ তানিম
শিশুরা স্বর্গের অতিথি, স্রষ্টার পক্ষ থেকে পৃথিবীর জন্য আশীর্বাদ। তাই প্রতিটি শিশুই পবিত্র স্বভাব নিয়ে জন্মায়। রাসুল সা. বলেন, ‘প্রতিটি শিশুই স্বভাবধর্ম নিয়ে জন্মায়।’ তিরমিজি : ২১৮৩
অন্য হাদিসে বর্ণিত আছে, রাসুল সা. এর কাছে এক শিশুকে আনা হলে তিনি তাকে চুম্বন করলেন এবং বললেন, ‘এরা হলো আল্লাহর ফুল’। -তিরমিজি
অথচ এ ফুলগুলো আমাদের অযতœ অবহেলায় নষ্ট হচ্ছে। বর্তমানে একের পর এক বীভৎস কায়দায় শিশুহত্যা ও নির্যাতনের ঘটনা ঘটছে। অন্তরের সত্যিকার মায়া-মমতা দিয়ে শিশুদের লালন-পালন করা এবং তাদের আদর্শ জীবন গঠন করা সবার কর্তব্য। এ ক্ষেত্রে ইসলামের অনুপম শিক্ষা ও নীতিমালা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এক হাদিসে রাসুল সা. বলেন, ‘মানুষের পাপী হওয়ার জন্য এতটুকুই যথেষ্ট যাদের ভরণপোষণ তার দায়িত্বে, সেই পোষ্য লোকেরা তার খামখেয়ালির কারণে ক্ষতিগ্রস্ত হয়।’ আবু দাউদ : ১৬৮৯
বিখ্যাত আলেম ও দার্শনিক ইবনে কায়্যিমিল জাওজিয়া বলেন, ‘শৈশবের সময়টা একজন মানুষের জন্য সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। এ সময়ে তার মনস্তাত্ত্বিক বিকাশের ভিত্তি গড়ে ওঠে, তাই শিশুর প্রতি আদর-স্নেহ ও ভালো আচরণের মাধ্যমে তার মানসিক বিকাশ ঘটাতে হবে। অহেতুক শারীরিক ও মানসিক শাস্তি প্রদান ও শিশু নির্যাতন করলে তার মেধাগত দক্ষতার বিকাশ মারাত্মকভাবে ব্যাহত হয়।’ -তুহফাতুল মাওদুদ বি আহকামিল ওয়াদুদ ১৫৬ পৃ.
রাসুল সা. শিশুদের সঙ্গে অত্যন্ত সুন্দর আচরণ করতেন। হাদিসে এসেছে, ‘একবার রাসুল সা. তাঁর নাতি হাসান রা. কে চুম্বন করলেন। তাঁর কাছেই সাহাবি আকরা বিন হাবিস রা. বসা ছিলেন। তিনি বললেন, আমার দশটি সন্তান আছে। আমি কোনো দিন তাদের কাউকে চুম্বন করিনি। তখন রাসুল সা. তার দিকে তাকিয়ে বললেন, যে কারও ওপর দয়া করে না, তার ওপরও দয়া করা হয় না।’ বুখারি : ৬০১৩; মুসলিম : ২৩১৮
আরেকবার কিছু বেদুইন রাসুল সা. এর দরবারে এসে জিজ্ঞেস করল, তোমরা কি তোমাদের শিশুদের চুম্বন করো? বলা হলো, হ্যাঁ! বেদুইনরা বলল, আল্লাহর কসম, আমরা কখনও আমাদের শিশুদের চুম্বন করি না। তখন রাসুল সা. বললেন, আল্লাহ যদি তোমাদের অন্তর থেকে রহমত উঠিয়ে নেন, তাহলে আমার কী করার আছে? মুসলিম : ১৯৫২
রাসুল সা. সন্তানকে শিষ্টাচার শিক্ষাদানে উদ্বুদ্ধ করে বলেন, বাবা নিজ সন্তানকে যে উপঢৌকন দান করেন তাতে সর্বোত্তম উপঢৌকন হলো সুন্দর শিষ্টাচার। তিরমজি : ৯৫২
এভাবেই রাসুল সা. শিশুদের অধিকারের প্রতি বিশ্ববাসীকে সচকিত করেন। এমনকি রাসুল সা. শিশুদের কান্নাও সহ্য করতে পারতেন না। তিনি বলতেন, যদি কোনো মা নামাজে দাঁড়ায় আর তার শিশু কাঁদতে থাকে তাহলে তার দায়িত্ব হলো, আগে শিশুর কান্না থামানো। (মুসলিম)। কিন্তু সম্প্রতি শিশুদের প্রতি নিষ্ঠুরতা ও অনাচারের মাত্রা ভয়াবহভাবে বেড়ে গেছে। গত দেড় মাসে প্রতিদিন গড়ে একটি শিশুকে বিভিন্ন কারণে প্রাণ দিতে হয়েছে।
চিন্তা করার বিষয়, যে রাসুল সা. শিশুর কান্না সহ্য করতেন না, আমরা তার উম্মত হয়ে শিশুদের ওপর কীভাবে অবিচার করছি! দেখা যাচ্ছে, আমাদের পারস্পরিক স্বার্থ ও দ্বন্দ্বের বলি হয়ে হয়ে ঝরে যাচ্ছে অনেক শিশু। তারা তো নিষ্পাপ, বড়দের সংঘাতের বোঝা তারা বইবে কেন। এ ধরনের অন্যায়-অবিচারের প্রতি হুশিয়ারি উচ্চারণ করে আল্লাহ বলেন, কোনো ব্যক্তি অন্যের অপরাধের বোঝা বহন করবে না। সুরা আনআম : ১৬৪
শিশুরা শক্তিহীন-দুর্বল। তাই সমাজের অনেকেই তাদের ওপর নিজের প্রতিহিংসা চরিতার্থ করে। এ ব্যাপারে বিখ্যাত হাদিস বিশারদ সাহাবি হজরত আবু হুরায়রা রা. বলেন, বিধবা ও অসহায়দের যারা অভিভাবক হবে এবং দায়দায়িত্ব পালন করবে তাদের সম্পর্কে রাসুল সা. বলেন, ‘বিধবা ও অসহায়দের তত্ত্বাবধানকারী ব্যক্তি আল্লাহর রাস্তায় জেহাদকারীর মতো।’ হাদিস বর্ণনাকারী সাহাবি বলেন, আমার ধারণা রাসুল সা. এও বলেছেন যে, (বিধবা ও অসহায়দের তত্ত্বাবধানকারীর মর্যাদা) ওই ব্যক্তির মতো, যে অলসতা না করে সারা রাত জেগে ইবাদত করে এবং ধারাবাহিকভাবে প্রতিদিন রোজা রাখে। বুখারি ও মুসলিম।