গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে জনপ্রতিনিধি এবং জনপ্রশাসনের সম্পর্ক
অধ্যাপক মো. আলী আশরাফ, এমপি
মানব সভ্যতার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অবদান হচ্ছে গণতন্ত্র। পাশ্চাত্যে এর সূচনা হলেও বর্তমানে পৃথিবীর সর্বত্রই এর বিকাশ ঘটেছে। বর্তমানে গণতন্ত্রের বিকাশ কেবল রাষ্ট্র পরিচালনার মধ্যেই সীমাবদ্ধ নেই বরং মানব সভ্যতার সামাজিক, সাংগঠনিক প্রক্রিয়ায় গণতন্ত্রের প্রয়োগ আমরা দেখতে পাই। গণতন্ত্রের মাধ্যমে মানুষ তথা জনগণ তার নিজের অধিকার প্রতিষ্ঠা করতে পারে যথার্থ অর্থে জনগণের মধ্য থেকে এবং জনগণের দ্বারা জনগণের জন্যে সরকারই হচ্ছে গণতান্ত্রিক সরকার। গণতন্ত্র ভালো কি মন্দ এ তুলনায় গেলে এর ভালো দিকটিই বেশি সমাদৃত হয়। গণতন্ত্রের প্রতি মানুষের আকর্ষণের অনেক কারণ আছে। গণতন্ত্র শাসন কাঠামোতে জন মানুষের স্থান আছে এবং তাদের প্রতিনিধিত্বের বক্তব্য আছে। শাসিতের নিকট শাসক শ্রেণি দায়িত্বশীল, সংবেদনশীল ও দায়বদ্ধ থাকে। তাতে আইনের শাসন, ব্যক্তি স্বাধীনতা ও মৌলিক অধিকারের স্বীকৃতি থাকে। গণতান্ত্রিক সরকার ব্যবস্থায় জবাবদিহিতার গুরুত্ব অপরিসীম। জবাবদিহিতাবিহীন সমাজে স্বৈরাচারী, অনৈতিকতা, একচ্ছত্র প্রভুত্ববাদী, দুর্নীতি শিকড় গেড়ে বসে। আমলাগণ লাগামহীন ক্ষমতার চর্চা করেন। জবাবদিহিতা ব্যবস্থা মজবুত হলে জনগণের আশা আকাক্সক্ষার বাস্তবায়ন ঘটে, সুশাসন নিশ্চিত হয়। জনগণই যে সকল ক্ষমতার উৎস এ ধারণাটি বাস্তব বলে বিবেচিত হয়। সরকার তথা নির্বাহী বিভাগের জবাবদিহিতা নিশ্চিত করা গেলে জনগণের মৌলিক চাহিদাবলি মিটানোতে সরকার সচেষ্ট থাকে। দুর্নীতি, অরাজকতা, অস্বচ্ছতা, অনৈতিকতা স্থান পায় না। জনগণের অর্থের সঠিক ও কল্যাণমূলক ব্যবহার নিশ্চিত হয়। জনগণ সবসময়ই জানতে পারে সরকার কখন কি করছে। অর্থাৎ সরকার ইচ্ছা করলেই স্বেচ্ছাচারী হয়ে উঠতে পারে না।
গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র ব্যবস্থা: রাষ্ট্রে পরিচালনায় গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় সরকার গঠনের দুটি পদ্ধতি চালু রয়েছেÑ
এক. রাষ্ট্রপতি শাসিত সরকার : যেমনÑ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ফ্রান্স, শ্রীলঙ্কা। রাষ্ট্রপতি শাসিত সরকার ব্যবস্থায় রাষ্ট্র পরিচালনার ক্ষমতা রাষ্ট্রপতির নিকট ন্যস্ত থাকলেও সেখানে জনগণের নির্বাচিত আইন সভার ভূমিকা অনেক সুদৃঢ় এবং কার্যকর। এ ব্যবস্থায় রাষ্ট্রপতি এবং জন প্রতিনিধিদেরকেও জনগণের নিকট জবাবদিহি করতে হয়। রাষ্ট্রপতি শাসিত গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় নির্বাচিত আইনসভার পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে ভিন্ন ভিন্ন নাম রয়েছে। আধুনিক রাষ্ট্রব্যবস্থায় সরকারের তিনটি মৌলিক অঙ্গ রয়েছে। এগুলো হলোÑ আইনসভা, নির্বাহী বিভাগ এবং বিচার বিভাগ। প্রতিটি বিভাগের সুষ্ঠু ও ভারসাম্যপূর্ণ পরিচালনার উপর রাষ্ট্রের উন্নয়ন নির্ভর করে। যেকোনো একটি উপাদানের কার্যাবলি অপর দুটো উপাদানের কার্যাবলির উপর নির্ভরশীল হয়ে রাষ্ট্রে একটি ভারসাম্যপূর্ণ অবস্থার সৃষ্টি করে। একটি উপাদান আংশিক বা পূর্ণভাবে ব্যহত হলে বাকি দুটোর কার্যাবলিও ব্যহত হয়।
রাষ্ট্রের তিনটি উপাদানের মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছেÑ নির্বাহী বিভাগ। মূলত সরকারের নীতি, সিদ্ধান্ত এবং কর্মসূচি বাস্তবায়নের জন্য দায়িত্বশীল অঙ্গ হচ্ছে এই নির্বাহী বিভাগ। সেজন্য বর্তমান বিশ্বে নির্বাহী বিভাগই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। কারণ এ কথা বলা হয়ে থাকে, ‘নির্বাহী বিভাগই হচ্ছে শাসনকার্যের মূল উৎস। অতএব একথা অনস্বীকার্য যে নির্বাহী বিভাগ যদি সুষ্ঠু ও কার্যকরভাবে পরিচালিত না হয় তবে দেশ ও জাতির কল্যাণ সাধিত হতে পারে না। আর সেখানেই আসে জবাবদিহিতার প্রশ্ন নির্বাহী বিভাগের কাজের জন্য কোথাও না কোথাও জবাবদিহিতার ব্যবস্থা না রাখলে প্রশাসনে স্বেচ্ছাচারিতা আসে। এবং দেশের কল্যাণ ব্যহত হয়। জবাবদিহিতার আভিধানিক অর্থ হলোÑ কৈফিয়ত। প্রশাসনিক কাজে যে কেউ তার কাজের জবাবদিহিতা প্রদানে ব্যর্থ হলে তাকে শাস্তি পেতে হয়। দক্ষ ও উন্নত প্রশাসনের জন্য জবাবদিহিতার কোনো বিকল্প নেই।
দুই. সংসদীয় গণতন্ত্র: যুক্তরাজ্য, ভারত, বাংলাদেশ, জাপানসহ পৃথিবীর আরও অনেক দেশে সংসদীয় গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় রাজনৈতিক কর্তৃত্ব প্রয়োগে সরকারের পন্থা সুনির্দিষ্ট এবং সংবিধানকর্তৃক সুনিয়ন্ত্রিত। রাষ্ট্র পরিচালনার নির্বাহী কর্তৃত্ব ন্যস্ত থাকে মন্ত্রী পরিষদের উপর এবং মন্ত্রী পরিষদের সদস্যগণ সরকারের নীতি এবং কর্মসূচি বাস্তবায়নের জন্য ব্যক্তিগতভাবে এবং যৌথভাবে দায়ী থাকে সংসদের নিকট এবং চূড়ান্ত পর্যায়ে দায়ী থাকে জনগণের নিকট সরাসরি জবাবদিহিতার এ ব্যবস্থার জন্য সংসদীয় গণতন্ত্র বর্তমান বিশ্বে অত্যন্ত জনপ্রিয়। সংসদীয় ব্যবস্থায় সরকারের কর্মকা-ের সামগ্রিক কেন্দ্রবিন্দু হলো সংসদ। এ ব্যবস্থায় রাজনীতির কেন্দ্রবিন্দুও সংসদ। তবে জনগণের দ্বারা নির্বাচিত আইন সভার নিকট নির্বাহী বিভাগকে সরাসরি এবং সামষ্টিকভাবে দায়বদ্ধ রাখার বিধান সংসদীয় ব্যবস্থারই একক এবং অনন্য বৈশিষ্ট্য। এই ব্যবস্থায় সরকারি নীতি নির্ধারিত হয় সংসদে এবং তা বাস্তবায়নে মন্ত্রীপরিষদ সংসদের নিকট দায়ী থেকে কর্তৃত্ব প্রয়োগ করে থাকেন। সংসদ প্রসঙ্গে তাই খরড়ুফ এবড়ৎমব বলেন, ‘ঞযব যড়ঁংব রং ঃযব ংড়ঁহফরহম নড়ধৎফ ড়ভ ঃযব হধঃরড়হ; রঃ নড়ঃয ংঢ়বধশং ভড়ৎ ধহফ ংঢ়বধশং ঃড় ঃযব ঢ়বড়ঢ়ষব’.
গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় রাজনৈতিক কর্তৃত্বের মতো প্রশাসনিক কর্তৃত্বের উৎসও হলো সংসদ। ১৯৮১ সালে আমেরিকার সিনেট কমিটির এক রিপোর্টে উল্লেখ করা হয়েছে, বিভাগ এবং বিভাগীয় কর্মকর্তারা কোনো অর্থেই প্রশাসনিক কর্তত্বের অধিকারী নয়; তারা কংগ্রেস প্রণীত আইনের সৃষ্টি। জাতীয় অর্থেল উপর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠাকল্পে গ্ল্যাডস্টোনের নেতৃত্বে কমন্স সভায় ১৮৬২ সালে যে আইন প্রণীত হয় তারও মূল লক্ষ্য ছিল প্রশাসনিক কর্মকর্তাদের ক্ষমতা সংসদের আইন থেকে উদ্ভুত। তখন থেকেই গণতান্ত্রিক বিশ্বে প্রশাসনিক কর্মকর্তাদের দায়িত্ব সুনির্দিষ্ট হয়েছে। বাংলাদেশের সংবিধানেও এ সুর পরিলক্ষিত হয়। সংবিধানের ১৩৩ অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, ‘এই সংবিধানের বিধানাবলি সাপেক্ষে সংসদ আইনের দ্বারা প্রজাতন্ত্রের কর্মে কর্মচারীদের নিয়োগ ও কর্মের শর্তাবলি নিয়ন্ত্রণ করতে পারবেন।’ এখানেও প্রজাতন্ত্রের কর্মকর্তাদের নিয়োগ এবং তাদের কর্মের শর্তাবলি নির্ধারণের দায়িত্ব সংসদের নিকট ন্যস্ত আছে।
গণতন্ত্রের প্রকৃত শাসন হলোÑ আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা। গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় আইন/নীতি প্রণীত হয় সংসদে এবং তা বাস্তবায়নের দায়িত্ব থাকে জন প্রশাসনের উপর। নীতি প্রণয়নের লক্ষ্যে প্রয়োজনীয় তথ্য/উপাত্ত সংগ্রহ, সমন্বয় এবং সরবরাহ করে থাকেন প্রশাসনগণ। অন্য কোনো বিকল্প থাকলে তাও জনপ্রশাসকগণ তুলে ধরেন। মাঠ পর্যায়ে এ সকল নীতিমালা বাস্তবায়ন করে জন প্রশাসকগণ।
এখানে লক্ষ্যণীয় যে, গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় সংসদ যেহেতু নীতি নির্ধারক হয়ে থাকেন দলীয় দৃষ্টিকোণ থেকে কিন্তু তার প্রয়োগকারীগণ অর্থাৎ প্রশাসকগণ থাকেন সম্পূর্ণ নিরপেক্ষ। তাই গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে আইনের শাসন প্রতিষ্ঠার জন্য প্রয়োজন কার্যকর সংসদ এবং দক্ষ ও নির্দলীয় প্রশাসনিক ব্যবস্থা। সরকারের জবাবদিহিতা এবং স্বচ্ছতা নিশ্চিত করণের জন্যও প্রয়োজন কার্যকর সংসদ এবং দক্ষ ও নির্দলীয় প্রশাসন ব্যবস্থা। একটির অভাবে অন্যটির কার্যক্রম কাক্সিক্ষত লক্ষ্যে পৌঁছাতে পারবে না। সরকারি কর্মকা- বাস্তবায়নে চাই এ দুয়ের মধ্যে সমন্বয় এবং সুসম্পর্ক যা আইন দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হতে হবে। বাংলাদেশের মতো সীমিত সম্পদের সুষ্ঠু ব্যবহার নিশ্চিত করণের মাধ্যমে জনগণের ভাগ্য উন্নয়নের জন্য এর প্রয়োজন আরও বেশি। আমাদের আজকের আলোচনাটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের প্রেক্ষাপটে হলেও এ লেখাটি উপস্থাপন করা হলো মূলত বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে।
বাংলাদেশের গণতন্ত্রের বিকাশ ঃ দীর্ঘ রক্তাক্ত সংগ্রামের পর ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর বাংলাদেশ স্বাধীনতা লাভ করে। স্বাধীনতা লাভের সূচনালগ্নে ১৯৭২ সালের ১৪ এপ্রিল নির্বাচিত গণপরিষদে গৃহিত হয় বাংলাদেশের সংবিধান আর ১৮৭২ সালের সাময়িক সাংবিধানিক আদেশ বলে বাংলাদেশে প্রতিষ্ঠিত হয় সংসদীয় গণতন্ত্র। রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের পর স্বাধীনতা লাভের সূচানাতেই সংবিধান এবং সংসদীয় গণতন্ত্র লাভের এরূপ দৃষ্টান্ত পৃথিবীর ইতিহাসে বিরল। বাংলাদেশের ১৯৭২ সালের সংবিধানকে অত্যন্ত যুগোপযোগী এবং শ্রেষ্ঠ সংবিধানসমূহের একটি বলে আখ্যায়িত করা হয়। এ সংবিধানের মূল বক্তব্যই হচ্ছে সংসদীয় গণতন্ত্র। প্রাপ্ত বয়স্কদের প্রত্যক্ষ ভোটে নির্বাচিত জাতীয় সংসদ এবং জাতীয় সংসদের নিকট দায়ী মন্ত্রীপরিষদÑ এটাই হচ্ছে সংবিধানের মূল বক্তব্য। (চলবে)
লেখক: সাবেক ডেপুটি স্পিকার / সম্পাদনা : আশিক রহমান