সন্তানকে তার মতো করে বেড়ে উঠার সুযোগ দিন
জুলফিয়া ইসলাম
লেখক: কলামিস্ট
সন্তানের প্রতি মা-বাবার মনোভাব, বিভিন্ন শাসন ও পরিচালনা সন্তানের মনোযোগের হ্রাস বৃদ্ধিতে প্রভাব বিস্তার করে। যেমনÑ অতিরিক্ত রক্ষণশীল মা বাবা বলতে যারা সবসময় তাদের সন্তানদের জন্য উদ্বিগ্ন থাকেন তাদেরকে বোঝায়। এই ধরনের মা-বাবা সন্তানদের যতœ ও স্বাস্থ্যবিধি পালনে কঠোর মনোভাব পালন করে থাকেন। তারা সন্তানদেরকে অন্ধভাবে ভালোবাসেন। সাধারণত যেসব মা বাবা অনেক সাধ্য সাধনার পর সন্তান লাভ করে থাকেন তাদের ক্ষেত্রে এরূপ বেশি দেখা যায়। আবার যেসব মা-বাবা তাদের সন্তানদের নিয়ে অতিরিক্ত উচ্চাশা কিংবা সন্তানদের ওপর অতিরিক্ত নির্ভরশীল হন তাদের ক্ষেত্রেও অন্ধ ভালোবাসা পরিলক্ষিত হয়ে থাকে। এই অন্ধ ভালোবাসা এক সময় অস্বাস্থ্যকার পরিস্থিতির সৃষ্টি করে। অন্ধ ভালোবাসার ফলে সন্তান তার স্বাধীন আগ্রহ ও ইচ্ছা প্রকাশে অক্ষম হয়, মা বাবার ওপর অতিরিক্ত নির্ভরশীল হয়ে পড়ে। সিদ্ধান্তহীনতায় ভোগে এবং ভীতু প্রকৃতির হয়ে থাকে। অতিরিক্ত আগলে রাখার ফলে সামাজিক বিকাশে বাধাপ্রাপ্ত হয় এবং স্কুলে নানাপ্রকার সমস্যার সম্মুখীন হয়। নিজের শক্তি সামর্থের ওপর আস্থা হারিয়ে ফেলার ফলে কোনো কাজে চ্যালেঞ্জ নিতে অক্ষম হয়। নিজের প্রতি আস্থা না থাকার ফলে দেখা যায় এরা অমনোযোগী হয়ে পড়ে।
এ ধরনের মা বাবা হচ্ছেন রক্ষণশীলতার বিপরীত। এরা তাদের সন্তানদের অতিরিক্ত স্বাধীনতায় বিশ্বাসী। এছাড়াও সন্তানদের আচরণ নিয়ন্ত্রণের জন্য কোনোরকম দায়িত্ব বা বিধিনিষেধ আরোপ করেন না। সন্তানদের ইচ্ছা এবং চাহিদা যখন তখন পূরণ করেন। অর্থাৎ সন্তানকে তার মতো করে বেড়ে ওঠার সুযোগ দিন। ফলে সন্তানেরা বেশি প্রশ্রয় পেয়ে স্বার্থপর ও জেদি হয়ে ওঠে। নিজেকে পরিবারের মধ্যমণি ভাবে। একসময় দেখা যায় অবাধ্য, দায়িত্বহীন, স্বাধীনচেতা ও দুর্বোধ্য হয়ে ওঠে। মা বাবার উদাসীনতা সন্তানদেরকে নিরাপত্তাহীন, অসহায় এবং আস্থাহীন করে গড়ে তোলে। যেসব পরিবারে স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে অসন্তোষ থাকে অথবা তাদের পারিবারিক জীবনে বিশৃঙ্খলা থাকে কিংবা অর্থনৈতিকভাবে অস্বচ্ছল থাকে সেসব পরিবারের সন্তানেরা মা বাবার নিকট বেশি অবহেলিত থাকে। ফলে তাদের জীবনে নানারকম সমস্যা দেখা দেয়।
এ ধরনের মা বাবা সন্তানদের ওপরে কিছু বাধা-নিষেধ এবং নিয়ন্ত্রণ আরোপ করে থাকেন। এই নিয়মনীতির অবাধ্য যদি সন্তানেরা হয়ে থাকে, তবে তাদের ওপর শাস্তি প্রয়োগ করা হয়। এ রকম সন্তানেরা তাদের আশা-আকাক্সক্ষা এবং ক্রোধ প্রকাশ করতে পারে না বিধায় এদের চরিত্রে নানারকম জড়তা, ভীরুতা ও নিরাপত্তাহীনতা দেখা দেয়। এরা খুবই অনুভূতিপ্রবণ হয়ে থাকে। পরিবেশের দ্বারা প্রভাবিত হয়ে পড়ে। এবার দেখা যাক, সন্তানদের ওপর কোনো ধরনের আচরণ করলে তাদের মানসিক স্থিতিশীলতা বিরাজ করবে এবং তারা প্রতিটি কাজে সহজ ও সুন্দরভাবে মনোনিবেশ করতে পারবে।
যে সন্তানের স্বাধীন স্বতঃস্ফূর্ত গতিবিধিতে বাধাদান করা হয় সে সন্তান অনমনীয়, অসহনীয় এবং অবাধ্য হয়ে গড়ে ওঠে। যে সন্তানকে অতিরিক্ত প্রশ্রয় দেওয়া হয় সে সন্তান স্বার্থপর হয়ে গড়ে ওঠে। সে সারাক্ষণ মা বাবার দৃষ্টি আকর্ষণ করতে চায়। এছাড়া তার মাত্রাতিরিক্ত মেজাজী হয় এবং নিয়মকানুনের তোয়াক্কা করে না। আবার যেসব মা বাবা সন্তানকে অতিরিক্ত শাসন করেন সেসব সন্তানেরা লাজুক ও নম্র স্বভাবের হয়ে থাকে। এরা সহজেই অপরের দ্বারা প্রভাবিত হয়ে পড়ে। অপরদিকে দেখা যায়, যে শিশু গণতান্ত্রিক এবং স্নেহপূর্ণ পরিবেশে মানুষ হয় তাদের মধ্যেই মানসিক স্থিতিশীলতা বেশি থাকে। এরা অপরকে সহযোগিতা করতে দ্বিধাগ্রস্থ হয় না।
প্রকৃতপক্ষে সন্তানদেরকে যে শাস্তি ওেয়া হয় অধিকাংশ ক্ষেত্রেই এর কোনো সুফল নেই। এতে সন্তানদের সমস্যা তো দূর হয়-ই না, উপরন্তু সমস্যার আরও উদ্ভব হয়। এ ধরনের সন্তনেরা অধিকাংশ ক্ষেত্রেই অসামাজিক এবং ভীতু প্রকৃতির হয়ে থাকে। অপরদিকে গণতান্ত্রিক পরিবেশে লালিত সন্তানেরা প্রতিটি কাজেই সক্রিয়, উদ্যোগী ও মিশুক হয়। পরিবারে স্নেহ-মায়া-মমতার ছায়ায় নিরাপত্তার সুদৃঢ় হয়। এদের মাঝে আরও কিছু গুণ লক্ষ্য করা যায়। যেমনÑ এরা আত্মবিশ্বাসী হয়ে থাকে, মানুষের প্রতি এদের মমত্ববোধ দেখা যায়। যেকোনো ব্যাপার নিয়ে উদ্যোগ কম থাকে। সহজে উত্তেজিত হয় না। এসব সন্তান সবসস্থানেই নিজের প্রভাব বিস্তারে সক্ষম হয়। কিন্তু তাদের মধ্যে সমঝোতা বিরাজমান হয়। প্রতিটি সন্তানই স্বাধীন ও স্বাবলম্বী হতে চায়। সন্তানরা স্বাধীন ও স্বাবলম্বী হলে মা বাবার সঙ্গে সম্পর্ক স্বচ্ছল ও দৃঢ় হতে দেখা যায়। স্ববলম্বী সন্তানদের মাঝে প্রতিটি কাজেই আগ্রহ দেখা যায়। কাজ করতে তারা ভয় পায় না। নিজের কাজ নিজে করে ফেলে এবং সেই সঙ্গে সাহসীও হয়।
অধিকাংশ ক্ষেত্রে দেখা যায়, যেসব সন্তানেরা গণতান্ত্রিক পরিবেশে মানুষ হচ্ছে, এরাই উপযুক্ত বিকাশ লাভে সক্ষম হয়। একটি সন্তানের শুধুমাত্র দৈহিক চাহিদা পূরণই যথেষ্ট বলে বিবেচিত নয়। সন্তানের সঙ্গে কথা বলা, খেলা, গল্প করা, বেড়াতে যাওয়া মোট কথা তাকে সঙ্গ দেওয়া , মার সামাজিক ও মানসিক বিকাশের জন্য অতি প্রয়োজনীয়। সন্তানের মনোযোগ বৃদ্ধিতে একটি পরিবারের ভূমিকা অত্যন্ত বেশি। পরিবারের মধ্যে মা বাবার শাসন এবং নিয়ম শৃঙ্খলার প্রভাব একজন সন্তানের মনোযোগকে বিঘিœত অথবা বৃদ্ধি করতে পারে। সুতরাং, সন্তানদের শাসন পরিচালনার ক্ষেত্রে উপযুক্ত ব্যবস্থাটিই গ্রহণ করে তাদেরকে প্রতিটি ক্ষেত্রে মনোযোগী করে গড়ে তুলতে সহায়ক ভূমিকা গ্রহণ করুন।
পারিবারিক সঙ্কট আপনার সন্তানের অমনোযোগিতার জন্য অনেকাংশে দায়ী। প্রায় সব পরিবারেই কম বেশি পারিবারিক সঙ্কট এসে উপস্থিত হয়। ফলে পারিবারিক জীবনে বিশৃঙ্খলার সৃষ্টি হয়্ পরবর্তী সময়ে বিভিন্ন সমস্যার উদ্ভব হয়। তখন পরিবারে অস্থিতিশীল পরিবেশ বিরাজমান হতে দেখা যায়। সন্তানদের ওপর এর প্রতিক্রিয়া মারাত্মকভঅবে দেখা দেয়। যেসব পরিবারে মায়া মমতার বন্ধন দৃড় থাকে, সেসব পরিবারে সঙ্কট সৃষ্টি হলে সন্তানদের ওপর এর প্রভাব পড়ে না। আজকে পরিবর্তনশীল সমাজে পরিবারের ওপর সামাজিক ও অর্থনৈতিক চাপের ফলে বিভিন্ন রকম সমস্যার সৃষ্টি হচ্ছে। দেখা দিচ্ছে পারিবারিক ক্ষেত্রে বিশৃঙ্খলা। পারিবারিক বিশৃঙ্খলা পরবর্তীতে সমাজ জীবনের ওপর প্রভাব বিস্তার করে থাকে।
সাধারণত দেখা যায় নিম্নবিত্ত পরিবারগুলোতে বেকারত্বে প্রভাব বেশি পড়ে না। কারণ, তারা সব সময়ই অভাব অনটনের মধ্যে থেকে যেকোনো কাজ করায় অভ্যস্থ হয়ে পড়ে কিন্তু উচ্চবিত্ত বা মধ্যবিত্ত পরিবারে যখন বেকারত্ব এসে উপস্থিত হয় তখন পরিবারের মধ্যে বিভিন্ন ধরনের হতাশা, অনিশ্চয়তা, সম্পর্কের অবনতি ইত্যাদি দেখা যায়। সন্তানেরা বাবার বেকারত্বে অসহায় বোধ করে। মাকে তখন অর্থ উপার্জনের জন্য নান জায়গায় ছোটাছুটি করতে হয়। ওই সময় ছোট ছেলেমেয়েদেরকে দেখাশোনার জন্য অন্য কারও সাহায্যের প্রয়োজন হয়ে পড়ে। আর্থিক টানাটানির জন্য কিশোর কিশোরীরা অসামাজিক, অমিশুক ও অন্তর্মুখী ব্যক্তিত্বে পরিণত হতে থাকে। (চলবে)
সম্পাদনা: জব্বার হোসেন