আলুশত্রু বনাম কাঁঠালশত্রু
রণজিৎ বিশ্বাস
শিক্ষার্থীদের যদি বলিÑ ‘সংসারের সকল প্রাণীই জন্মমাত্র সে প্রাণীটি, কিন্তু মানুষ জন্মমাত্রই মানুষ নয়। তাকে আবার মানুষ হতে হয়। হতে হয় ধাপে ধাপে, ঘাটে ঘাটে, সোপানে সোপানে, প্রয়োজনে প্রয়োজনে’Ñ তখন দেখি, কথাগুলো ওদের মনে ভার চাপাচ্ছে। নীতিকথার ভার, উপদেশ’ এর ভার। ভার এমন এক জিনিস যা কেউ বইতে চায় না।
কিন্তু, যখন বলিÑ মানুষ হতে হবে গোল আলুর মতো, মানুষ হতে হবে কাঁঠালের মতো, তখন ওরা বেশ আনন্দ পায়। জোড়া জোড়া কানগুলো প্রায় শর্তহীনভাবেই আমাকে দিয়ে দেয়। গোল আলুর ব্যাপারে ওদের তেমন কোনো প্রশ্ন থাকে না। চটজলদি করে ওরা বুঝে নিতে পারে ওটি মাছে যায়, মাংসে যায়, ডিমে যায়, ডালে যায় (আলুর ডাল), শুটকীতে যায়, সবজিতে যায়, লাবড়ায় যায়, ঘন্টে যায়, খিচুড়িতে (জোলো খিচুড়ি) যায়, তেলাভাতে (বিরানি) যায়, ভাজায়-ভাজিতে যায়, ভর্তায় যায়, চিপস-এ যায়, দম’এ যায়, চাট’এ যায় এবং কিসে যায় না! আলু বাঙালির সর্বব্যঞ্জনের সঙ্গী। আলু সঙ্গী বঙ্গসন্তানের হরেক রসিকতার।
প্রশ্নের পর প্রশ্ন আসে কাঁঠালের বেলায়। কেন স্যার, এমন কেন বললেন! আমরা কাঁঠাল কেন হতে যাব! কাঁঠালের কী গুণ যে আমরা সেটির মতো হওয়ার জন্য আঠালো ইচ্ছে নিয়ে পড়ে থাকব! তখন বিষয়টি আমাকে ভোটাভুটিতে পাঠাতে হয়। তখন আমার যুক্তিঝাঁপির ডালাটি সরাতেই হয়। আমি বলি, কাঁঠালের উপকারিতা মাত্র তিনশ’ সাঁইত্রিশ রকম। কাঁঠালের ফুলফল পাতা কাঠ বোঁটা বিচি আঠা ভুতি মাজা সবই মানুষের কাজে লাগে। তারপর বললামÑ হাত তোলো, দেখি কারা হতে চাও আলুর মতো, কারা কাঁঠালের মতো। ছাব্বিশ জনের মধ্যে বারোজন হাত তুললো আলুর পক্ষে, বারোজন কাঁঠালের পক্ষে। দু’জন অন্যরকম আচরণ করল। একজন দু’টোর মতোই হতে চায়, আলু-কাঁঠালের মিকশ্চার। আরেকজন কিছুর মতোই হতে চায় না। ওধরনের কোনো কিছু হওয়ায় সে বিশ্বাস করে না। যখন বললাম, কাঁঠালের কী দোষ? একটি মেয়ে বললÑ কাঁঠাল কেন হতে চাও নাÑ এইতো স্যার বলতে চাচ্ছেন?
: হ্যাঁ তাই।
: কাঁঠাল না এলে মানুষ অন্যের মাথায়, কাঁঠাল ভাঙতো না। পাকা কাঁঠাল যেমনতেমন, কাঁচা কাঁঠাল ভাঙার চেষ্টায় মানুষের প্রাণসংশয় উপস্থিত হয়। কাঁঠাল হাতের কাছে না থাকলে বোকাশোকা মানুষকে কেউ ‘কাঁডল’ ডাকার কাজটি করতে পারত না। কাঁঠাল আমাদের ফ্রুট-ভুবনে ল্যান্ড না করলে ‘কাঁঠালের আমসত্ত্ব নামের অবাস্তব বস্তুটির সৃষ্টি হতো না।
যখন বললাম, বলো দেখি আলুতে কী অসুবিধে, তখন একটি ছেলে একই জোরে বললÑ আলু হাতের কাছে থাকে বলেই গাবদুগুবদু ছেলেদের তাদের কাউন্টারপার্টরা ‘আলু’ ডাকে। লাল টকটকে আনস্মার্ট ছেলেদের ‘রাঙা আলু’ ডাকে আর হাসাহাসি করে। থিয়েটারে পচা আলু, পচা ডিম ও পচা টমেটোর বিকল্প হিসেবে ব্যবহৃত হয়। জ্যাক অভ্ অল ট্রেইডসকে অবমূল্যায়ন করে আলু ডেকে ব্যঙ্গ করে; আলুপালং, আলুগোবি, আলুপনির, আলুপরোটা ইত্যাদি পছন্দ-অপছন্দের খাবার আমাদের গিলতে হয়। কথা সেদিন আর বাড়ল না। সিদ্ধান্ত হলো, পরের দিন সিদ্ধান্ত হবে।
ছ’মাস পর আমার কুলায় এসে কেউ বেল টিপলো। ডোর-ভিউতে দেখলাম দু’জন দু’লিঙ্গের। ভিতরে ঢোকালাম। দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়েই ওরা, আমার ক্লাস রুমের আমশত্রু ও কাঁঠালশত্রু। আমার হাতে একটি চমৎকার কার্ড তুলে দিয়ে বললÑ আসতে হবে স্যার আলু-কাঁঠালের ভর্তা হবে।
লেখক: প্রয়াত সাবেক সচিব / সম্পাদনা: জব্বার হোসেন