বাংলা ভাষার কত যে রূপ!
স্বকৃত নোমান
লেখক: কথাসাহিত্যিক
বাংলা ভাষার কত যে রূপ! বাঙালি মাত্রই বাংলা ভাষায় কথা বলে। কিন্তু সব বাঙালির বাংলা ভাষার রূপ কি এক? না, এক নয়। পশ্চিমবঙ্গের বাংলা ভাষার রূপ আর ঢাকার বাংলা ভাষার রূপের ফারাক আছে। বাংলাদেশের রাজশাহীর বাঙালিরা যে ভাষায় কথা বলে চট্টগ্রামের বাঙালিরা সে ভাষায় বলে না। চট্টগ্রাম ও রাজশাহীর দুজন মানুষকে যদি তাদের নিজ নিজ অঞ্চলের ভাষায় কথা বলার জন্য মুখোমুখি বসিয়ে দেওয়া হয়, কারও কথা কেউ বুঝবে না। একইভাবে সিলেটের বাংলা ভাষার সঙ্গে বরিশালের, যশোরের সঙ্গে খুলনার, নোয়াখালীর সঙ্গে কুমিল্লার বা রংপুরের সঙ্গে ময়মনসিংহের বাংলা ভাষার মিল নেই। বিশাল বাংলার একেক অঞ্চলের মানুষ বাংলা ভাষার একেক রূপে কথা বলে। কিন্তু যখন লিখে তখন এতটুকু অমিল থাকে না। বাংলা ভাষার রূপ তখন অখ-। অ-কে ঠিক অ লিখে, ক-কে ক। অর্থাৎ কথ্যরূপের বহুরূপ থাকলেও লেখ্যরূপের রূপ কিন্তু একটাই।
আসলেই কি তাই? লেখ্যরূপের রূপ কি একটাই? না, বাংলা ভাষার লেখ্যরূপের আরও একটা রূপ আছে। ‘আছে’ না বলে ‘ছিল’ বলাটাই বোধকরি যৌক্তিক। বৃহত্তর সিলেট অঞ্চলে একটা সময় বাংলা ভাষার লেখ্যরূপের আলাদা একটা রূপ ছিল। ভাষা এক, কিন্তু বর্ণমালা আলাদা। সিলেট অঞ্চলের মানুষ যে ভাষায় কথা বলে ঠিক সে ভাষাকে আলাদা বর্ণমালায় লেখা হতো একটা সময়। সেই লিপিকেই বলা হয় নাগরী লিপি।
কিন্তু বাংলা ভাষার তো স্বতন্ত্র একটা লিপি রয়েছে। তা সত্ত্বেও কেন উদ্ভব হয়েছিল নাগরী লিপির? এই ব্যপারে গবেষকরা নানা মত দিয়েছেন। তবে বেশিরভাগ গবেষকের অভিমত, হযরত শাহজালাল ও ৩৬০ ওলির মাধ্যমে সিলেট অঞ্চলে ইসলাম ধর্ম প্রসার লাভ করে এবং তাদের অনুসারীদের দ্বারা নাগরী লিপি সৃজিত হয়। কেন তারা বাংলা লিপিকে বাদ দিয়ে আলাদা একটা লিপি সৃজন করেছিলেন? এই ব্যাপারে একেক গবেষকের একেক মত। বাংলাভাষী, বাংলা সাহিত্যের নগণ্য একজন কর্মী হিসেবে এবং বাঙালি মুসলমানের মনস্তত্ত্ব সম্পর্কে আমার যৎসামান্য যে জ্ঞান রয়েছে, তার আলোকে আমার মনে হচ্ছে, মূলত ধর্মীয় সংকীর্ণতা থেকেই তারা বাংলা লিপির বদলে নাগরী লিপির প্রবর্তন করেছিলেন। বাংলা লিপি ব্যবহারের প্রতি তাদের অনীহা জাগার নেপথ্য কারণ হয়তো এই, হিন্দুধর্মমতে ব্রাহ্ম লিপি হচ্ছে স্রষ্টা ব্রহ্মার পক্ষ থেকে দেওয়া একটা লিপি। বাংলা লিপি ভারত উপমহাদেশের ব্রাহ্মী বর্ণমালা থেকে উদ্ভূত। মুসলমানদের স্রষ্টা তো ব্রহ্মা নয়, খোদা বা আল্লাহ। সুতরাং কেন তারা ব্রহ্মার দেওয়া লিপিতে লিখবেন? তাই তারা অনুভব করলেন নতুন লিপি প্রবর্তনের প্রয়োজনীয়তা। তখন যে লিপি তারা প্রবর্তন করলেন তা-ই নাগরী লিপি বলে স্বীকৃত হয়।
পরবর্তীকালে এই লিপিতে রচিত হয়েছে শত শত গ্রন্থ, দলিল-দস্তাবেজ এবং পরিচালিত হয়েছে সেকালের দৈনন্দিন কার্যক্রম। নাগরী লিপিতে রচিত সেসব গ্রন্থের বিষয় সাধারণত মানবিক প্রেমোপাখ্যান। এছাড়া মুসলমানদের নবীর জীবনী, ইসলাম ধর্মের বাণী, সিলেট অঞ্চলের নানা রূপকথা, ইসলামের নানা ইতিহাস, সামাজিক নানা সংস্কার, সুফিবাদ, ফকিরি গান, বীরগাথা এবং মরমিবাদ এসব গ্রন্থের বিষয় হিসেবে প্রাধান্য পেয়েছে। সাহিত্যমান বিবেচনায় বেশিরভাগ পুঁথি অত উঁচু নয়। কিন্তু কোনো কোনো পুঁথি আবার মানের দিক থেকে অত নিচুও নয়। মধ্যযুগে রচিত বাংলা ভাষার পুঁথি-কাব্য পড়ে আমরা যে সাহিত্যরস আস্বাদন করতে পারি, নাগরী লিপিতে রচিত কোনো কোনো পুঁথি পাঠে সমান রস আস্বাদন করা যায় বটে। কম হোক বেশি হোক, এগুলোর যে একটা সাহিত্যমূল্য রয়েছে সে বিষয়ে আমার মধ্যে কোনো দ্বিধা বা সন্দেহ নেই।
নাগরী লিপির লিপি যাই হোক, ভাষা যে বাংলা, এই ব্যাপারে ভাষাবিদরা একমত। ভাষা যদি এক হয়, নাগরী লিপিতে লেখা কোনো কবিতাকে কি আমরা বাংলা ভাষার কবিতা বলব না? না বলার তো কোনো কারণ দেখতে পাচ্ছি না। কারণ যদি না থাকে, যে অর্থে আমরা মধ্যযুগীয় বাংলা সাহিত্যে মুসলিম ঐতিহ্যভিত্তিক যুদ্ধবিষয়ক কাব্য ‘জঙ্গনামা’কে বাংলা সাহিত্যকর্ম হিসেবে বিবেচনা করি, নাগরী লিপিতে রচিত ‘জঙ্গনামা’কে কি বাংলা সাহিত্যকর্ম হিসেবে বিবেচনা করব না? না করার কোনো কারণ নেই। কারণ যদি না থাকে, বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে বাংলা লিপিতে রচিত ‘জঙ্গনামা’র কথা উল্লেখ থাকলে নাগরী লিপিতে রচিত ‘জঙ্গনামা’র কথা উল্লেখ থাকেব না কেন? বাংলা সাহিত্যের যে ইতিহাস তাতে বড় চ-ীদাসের শ্রীকৃষ্ণকীর্তন কাব্য থেকে শুরু করে মনসামঙ্গল, চ-ীমঙ্গল, ধর্মমঙ্গল, নাথসাহিত্য, পদাবলি ও জীবনীসাহিত্য, প্রণয়কাহিনী ও যুদ্ধকাহিনী বা অন্যান্য কাব্যের কথা উল্লেখ আছে। উল্লেখ আছে বড়ু চ-ীদাস থেকে শুরু করে কৃত্তিবাস, কবীন্দ্র পরেমেশ্বর দাস, শ্রীকর নন্দী, দ্বিজ রঘুনাথ, মালাধর বসু, দ্বিজ গোবিন্দ, বিজয় গুপ্ত, বিপ্রদাস পিপিলাই, দ্বিজ বংশীদাস, মুকুন্দরাম চক্রবর্তী, বিদ্যাপতি, ফয়জুল্লাহ, সৈয়দ সুলতান, বৃন্দাবন দাস, কৃষ্ণদাস কবিরাজ, দৌলত উজির বাহরাম খান, শাবিরিদ খান, শাহ মুহম্মদ সগীর প্রমূখ কবিগণের নাম। অথচ উল্লেখ নেই নাগরী লিপিতে রচিত নানা পুঁথি বা পুঁথিকারদের নাম।
ঢাকার আজিজ সুপার মার্কেটের উৎস প্রকাশন থেকে প্রকাশিত নাগরী গ্রন্থসম্ভারের গ্রন্থগুলো হচ্ছে যথাক্রমেÑ ওয়াহেদ আলীর জঙ্গনামা, দীন ভবানন্দের মুজমা রাগ হরিবংশ, শাহ আবদুল ওয়াহাব চৌধুরীর হাশর তরান, হাজী ইয়াছিনের মায়ারশি দুছরা, ছৈয়দুর রহমানের দেশ চরিত, মহম্মদ জওয়াদের বাহরাম জহুরা, মৌলবী আকবর আলীর আহকামে চরকা, মুন্সী ইরফান আলীর ছয়ফুল বেদাত, মুন্সী আবদুল করিমের সোনাভানের পুঁথি, মুন্সী জফর আলীর ওছিওতুন্নবী, মুন্সী ওয়াজিদ উল্লাহর হুসিয়ার গাফেলিন, সৈয়দ শাহনূরের সাত কন্যার বাখান, আব্দুল করিমের ছদছি মছলা, মুন্সী সাদেক আলীর হাশর মিছিল, মবিন উদ্দীন মুন্সীর দইখুরার রাগ, মুন্সী আব্দুল করিমের হরিণ নামা, মুহম্মদ খলিলের চন্দ্রমুখী, ফকির আমানের ভেদ চরিত, মুন্সী আছদ আলীর সহর চরিত, মুন্সী সাদেক আলীর কেতাব হালতুন্নবী, মুন্সী আব্দুল করিমের কড়িনামা, মুন্সী সাদেক আলীর মহব্বতনামা, শিতালং শাহের মশকিল তরান, শাহ আরমান আলীর নূর পরিচয়, শাহ আবদুল ওয়াহাব চৌধুরীর ভেদ কায়া।
কাব্য বা পুঁথি যা-ই বলি না কেন, এগুলোর একটির নামও বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসের কোথাও উল্লেখ নেই। উল্লেখ নেই পুঁথিকারদের নামও। তার মানে ইতিহাসবিদরা যে টর্চটা জ্বালিয়ে বাংলা সাহিত্যের নিদর্শন খুঁজে বেড়িয়েছেন সেই টর্চের আলো নাগরী লিপিতে রচিত ‘জঙ্গনামা’র ওপর পড়েনি। শুধু জঙ্গনামা নয়, এই লিপিতে রচিত প্রায় শতাধিক পুঁথির ওপরও পড়েনি। হয়তো পড়েছে। হয়তো তারা জেনেছেন এই লিপিতে রচিত সাহিত্যকর্মের কথা। জেনেও ইতিহাসের অন্তর্ভূক্ত করলেন না কেন? আমার অনুমান, এর পেছনে দুটো কারণ থাকতে পারেÑ এক. নাগরী লিপিতে রচিত এসব পুঁথি আদৌ বাংলা ভাষার কিনা সে বিষয়ে সংশয়, দুই. উপেক্ষা। সংশয় বা উপেক্ষা যা-ই থাকুক, এই লিপিতে রচিত সাহিত্যকর্মের কথা বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে লিখিত হয়নি এটা সত্য। এটি বাংলা সাহিত্যের অনালোকিত অধ্যায়। (চলবে)
সম্পাদনা: জব্বার হোসেন