পেরেছে তাবাসসুম, পারবে আরও অনেক নির্যাতিত
নূসরাত জাহান : তখনও শৈশব পেরোয়নি মেয়েটির। বয়স ১৩ বছর। পুতুল খেলার সেই বয়সে কিছু বুঝে উঠার আগেই পরিবার থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। ঠিক বিয়ের পিঁড়িতেও বসা বলে না একে। তারপরও ২০ তাকে নরকে কাটাতে হয়েছে। এরপরই ঘুরে দাঁড়ান তাবাসসুম আদনান। তার একার সেই সাহসী পদক্ষেপ আজ হাজার নারীর লড়াইয়ে সাহস যোগাবে।
পাকিস্তানের সোয়াত উপত্যকায় বাড়ি তাবাসসুমের। পশতু অধ্যুষিত ওই এলাকায় ৪০০ বছরের পুরনো প্রথা অনুযায়ী, দুই পক্ষের বিবাদ মীমাংসা হয় খেসারত দিয়ে। দোষী পক্ষ অন্য পক্ষকে খেসারত দেয় মেয়ে দান করে। এরপর মেয়েটিকে তাদের ইচ্ছামতো ‘ব্যবহার’ করে। ভয়ানক এই রীতির নাম ‘সোয়ারা’। এই প্রথায় যাতে বিঘœ না ঘটে সেদিকে নজর রাখছে স্থানীয় পঞ্চায়েত ‘জিরগা’।
তাবাসসুমের সঙ্গেও এমন অমানবিক ঘটনা ঘটে। মেয়েদের প্রতি এমন অন্যায় নিয়মের বিরুদ্ধে কেবল গর্জেই উঠেননি তাবাসসুম। স্থানীয় মেয়েদের নিয়ে গড়ে তুলেছেন ‘খোয়েন্দো জিরগা’ বা নারীদের পঞ্চায়েত। যারা লড়াই করছে মেয়েদের উপর অত্যাচারের বিরুদ্ধে।
এ প্রসঙ্গে চার সন্তানের জননী তাবাসসুম বলেন, ২০ বছরের সংসার ছাড়ার পর তিনি আচমকা একা হয়ে যান। কোথাও আশ্রয় না পেয়ে বিদিশা হয়ে পড়েন। তবে ভেঙে পড়েননি। ঠিক করেন মেয়েদের প্রতি হওয়া এই অন্যায়-অত্যাচারের বিরুদ্ধে কাজ করবেন। একটি মেয়েকে এসিড ছুঁড়ে মারার বিচার চাইতে গিয়েছিলেন জিরগার কাছে। লাভ হয়নি। এরপরই উদ্যোগ নেন খোয়েন্দো জিরগা গড়ার। মেয়েদের সমস্যা মেয়েরাই সামলাবে, অন্যায়ের জবাব দেবে। যেই ভাবা সেই কাজ।
তারা আশ্রয় দেন নিপীড়িত, অত্যাচারিত, স্বামী পরিত্যক্তা মেয়েদের। রুখে দাঁড়ান পাচার ও বাল্যবিবাহের বিরুদ্ধে। মেয়েদের স্বাস্থ্য, পুষ্টি, পড়াশোনার ব্যবস্থাও করে।
তবে তাবাসসুমের এ কাজ ভালোভাবে নেয়নি সমাজ। তার বিরুদ্ধে জিরগা ফতোয়া জারি করে। তবে থামেননি তাবাসসুম। নিজের গোষ্ঠী, এলাকার মানুষের কাছ থেকে এত সমর্থন পেলেন যে ফতোয়া তুলে নিতে বাধ্য হলো জিরগা।
কট্টর সমাজের তোয়াক্কা না করে তাবাসসুমরা অনেক কিছু বদলে ফেলেছেন। কাজের স্বীকৃতি হিসেবে ২০১৪ সালে পেয়েছেন নেদারল্যান্ডস সরকারের ‘বেস্ট হিউম্যান রাইটস ডিফেন্ডার অ্যাওয়ার্ড’, মার্কিন সরকার ২০১৫ সালে তাকে দিয়েছে ‘ইন্টারন্যাশনাল উইমেন অব কারেজ অ্যাওয়ার্ড’ এবং চলতি বছর পেলেন ‘নেলসন ম্যান্ডেলা-গ্রাসা মিশেল ইনোভেশন অ্যাওয়ার্ড।’
যেখানে মেয়েদের কথায় কথায় বেত মারা হয়, পাথর ছুঁড়ে মেরে ফেলা হয়, পড়তে দেওয়া হয় না, ধর্ষণের শিকার হলে পুড়িয়ে মারা হয় সেখানে মেয়েদের পঞ্চায়েতের কথা ভাবাই যায় না। কিন্তু তাবাসসুম সেটা করে দেখিয়েছেন। ভালো কাজের ইচ্ছা থাকলে তা করা যায় এটাই তার প্রমাণ।
তাবাসসুমের পারাটা একার নয়। তিনি সমবেতভাবে কাজটি করেছেন। তার চেতনা, ভাবনা অন্যদের মাঝে সঞ্চারিত করতে পেরেছেন। তবেই অনেক মেয়ে তার বিশ্বাসের উপর আস্থা রাখতে পেরেছেন। তাবাসসুম যে কারণে লড়ছেন, সেই কারণটা যে অত্যন্ত প্রয়োজনীয়, সেটা মনে করতে পেরেছেন। তাকে সমর্থন দিয়েছেন।
এ ধরনের বৃহৎ কাজের জন্য সবার আগে প্রয়োজন নিজেকে সমষ্টির একটা অংশ ভাবা। একটি-দুটি তারা দিয়ে কাজ চলে না। তাই অন্ধকারে পথ দেখাতে চাই লাখো তারার সম্মিলিত আলো। তাবাসসুম সেটাই সম্ভব করেছেন। তার এই সম্মিলিত প্রয়াস নিপীড়িতদের রেহাই দেবে। দেবে সমাজে মর্যাদা আর সম্মান। সূত্র: ডন। সম্পাদনা : সুমন ইসলাম