এই মৃত্যু মিছিল আর কত দীর্ঘ হবে?
ওয়াসিম ফারুক
ঈদ মানেই আনন্দ। ঈদ মানেই ত্যাগ, উৎসব আর উদযাপন। কিন্তু কখনো কখনো কিছু সময় আসে, কোনো একটি ঘটনায় ঈদের সব আনন্দকে চিরকান্নায় পরিণত করে আমাদের জীবনে। প্রতি ঈদেই নাড়ির টানে বাড়ি ফেরা মানুষদের মধ্যে কেউ কেউ বাড়ি ফিরেন লাশ হয়ে। এবারের কুরবানির ঈদও এর ব্যতিক্রম হয়নি। প্রায় প্রতিদিন সংবাদ শিরোনাম হয়েছে, ঘরমুখি মানুষের লাশ হওয়ার সংবাদ। প্রতিটি মৃত্যুই যন্ত্রণাদায়ক, প্রতিটি মৃত্যুই আমাদের কাঁদায়। কিন্তু কিছু কিছু মৃত্যু মনের ভিতরে গভীর ক্ষত তৈরি করে। গণমাধ্যমের খবর অনুযায়ী, ১৬ সেপ্টেম্বর সারাদেশে সড়ক দুর্ঘটনায় ১৭ জন মানুষকে জীবন দিতে হয়েছে। তার মধ্যে টাঙ্গাইলের কালিহাতি উপজেলায় একটি বাস উল্টে পড়ে পাঁচজনের মৃত্যু হয়েছে। তাদের সাবই পোশাকশ্রমিক। পরিবার-পরিজনের সাথে ঈদের আনন্দ ভাগাভাগি করে জীবন-জীবিকার প্রয়োজনে তারা ফিরছিল কর্মক্ষেত্রে। ভাগ্যের নির্মম পরিহাস, এই ঈদ-ই যে তাদের জীবনের শেষ ঈদ তা কি কখনো তারা ভেবেছিল?
ব্রাহ্মণবাড়িয়ার বিজয়নগর উপজেলার শশই ইসলামপুর এলাকায় ঢাকা-সিলেট মহাসড়কে ঘটে যাওয়া দুর্ঘটনাটি, পিতা-পুত্রসহ একই পরিবারের চারজনসহ মোট আটজনের জীবন প্রদীপ নিভেছে। মৌলভীবাজারের কমলগঞ্জের রুপশপুর গ্রামের হাদিউর রহমান, ছেলে আবু সুফিয়ানকে বিয়ে দেওয়ার জন্য মাইক্রোবাস যোগে ঢাকায় আসছিলেন কনে দেখতে। সঙ্গে দুই ছেলেসহ অনেকেই ছিলেন। কিন্তু হাদিউর রহমানের আর ছেলের জন্য কনে দেখা হলো না। আবু সুফিয়ানেরও বিয়ের আশা পূরণ হলো না। যে বাড়িতে আজ আনন্দের বন্যা বয়ে যাওয়ার কথা, সেখানে এখন শোকের মাতম।
সড়ক দুর্ঘটনা এদেশের একটি নিত্য ঘটনা হয়ে দাঁড়িয়েছে। প্রায় প্রতিদিন-ই দেশের কোথাও না কোথাও সড়ক দুর্ঘটনায় আপনজনকে হারিয়ে শোকে মাতম করতে হয় কোনো না কোনো পরিবারকে। সড়ক দুর্ঘটনার জন্য দায়ী কে? কেন এত আলোচনা-সমালোচনার পরও মানুষকে অপমৃত্যুর শিকার হতে হয়? কারণ, প্রশিক্ষিত চালকের অভাব। সেই সাথে বেহাল রাস্তাঘাট। বৈধ লাইসেন্স ছাড়া চালকের আসনে বসে যাওয়ার ঘটনা যেন কোনো ঘটনাই নয়। জানা যায়, দেশের ৬১ শতাংশ চালক পরীক্ষা না দিয়ে লাইসেন্স নিচ্ছেন। অন্যদিকে ১৬ লাখ চালক বৈধ লাইসেন্স ছাড়াই গাড়ি চালাচ্ছেন। আর যে সব গাড়ি চালাচ্ছেন তার বেশির ভাগই চলাচলের অনুপযোগী, ফিটনেসবিহীন। কত গাড়ি ফিটনেসবিহীন সড়ক-মহাসড়কে চলাচল করছে, তার সঠিক পরিসংখ্যান হয়তো কারোরই দেওয়া সম্ভব নয়। প্রশিক্ষিত চালকেরাও বাড়তি আয়ের আশায় বিরামহীন গাড়ি চালিয়ে যাচ্ছেন। গাড়ি চালানোয় কোনো বিরতি নেই! কিভাবে সম্ভব এটা?
২০১১ সালের ১৩ আগস্ট ঢাকা-আরিচা মহাসড়কের মানিকগঞ্জের ঘিওর উপজেলার জোকায় মর্মান্তিক সড়ক দুর্ঘটনায় তারেক মাসুদ ও মিশুক মুনীরসহ ৫ জন নিহত হওয়ার পর অবৈধভাবে লাইসেন্স নেওয়া অদক্ষ চালকদের কারণে একের পর এক সড়ক দুর্ঘটনায় হতাহতের বিষয় নিয়ে যখন দেশবাসী ক্ষুব্ধ, তখনই তৎকালীন একজন দায়িত্বশীল মন্ত্রী মন্তব্য করেছিলেন, ‘গাড়ি চালানোর জন্য শিক্ষা ততটা গুরুত্বপূর্ণ নয়, চালকদের কিছু চিহ্ন চিনতে পারলেই হয়।’ আমার মনে হয়, কিছু চিহ্ন জানা লোকই গাড়ির স্টিয়ারিং হাতে মানুষের জীবন নিয়ে ছিনিমিনি খেলছে।
নিরাপদ সড়ক চাই (নিসচা) তথ্যমতে, ২০১৫ সালে সারাদেশে ২ হাজার ৬২৬টি সড়ক দুর্ঘটনা ঘটেছে। এসব দুর্ঘটনায় ৫ হাজার ৩ জন মারা যান, আহত হন ৬ হাজার ১৯৭ জন। ২০১৪ সালে সারাদেশে সড়ক দুর্ঘটনা ঘটেছিল ২ হাজার ৭১৩টি, এতে নিহতের সংখ্যা ছিল ৬ হাজার ৫৮২ জন। ২০১৫ সালে ঢাকা জেলায় সবচেয়ে বেশি মানুষ দুর্ঘটনায় নিহত হন। এই সংখ্যা ৩৫৯। এর মধ্যে রাজধানীতেই নিহত ২২৭ জন আর সবচেয়ে কম ২৮ জন মারা যান কুষ্টিয়া জেলায়। বাংলাদেশ যাত্রী কল্যাণ সমিতির হিসাব অনুযায়ী, ২০১৫ সালে সারাদেশে ৬ হাজার ৫৮১টি ছোট-বড় সড়ক দুর্ঘটনা ঘটে। এতে ৮ হাজার ৬৪২ জন নিহত হন; আহত হন ২১ হাজার ৮৫৫ জন। অন্য এক পরিসংখ্যানে দেখা যায়, দেশে প্রতিবছর সড়ক দুর্ঘটনায় ১২ হাজার মানুষের মৃত্যু হয়। জাতীয় অর্থোপেডিক হাসপাতাল ও পুনর্বাসন কেন্দ্রের একটি সূত্র অনুযায়ী, সড়ক দুর্ঘটনার শিকার হয়ে প্রতিবছর গড়ে ১৫ হাজার লোক পঙ্গু হচ্ছে। সড়ক দুর্ঘটনাসহ বিভিন্ন ধরনের দুর্ঘটনায় আহত হয়ে গত বছর পঙ্গু হাসপাতালের জরুরি বিভাগে ৪৭ হাজার ৪৩৭ জন এবং ২০১৪ সালে ৪৬ হাজার ৫৮৪ জন চিকিৎসা নেয়। এদের মধ্যে প্রায় এক তৃতীয়াংশ চিরতরে পঙ্গুত্ব বরণ করতে হয়। পরিসংখ্যান যাই বলুক, এদেশে মানুষের অকাল মৃত্যুর বড় একটি কারণ যে সড়ক দুর্ঘটনা, তা অস্বীকার করার উপায় বোধ হয় কারোরই নেই।
সড়কে গাড়ি চললে দুর্ঘটনা ঘটবে এটা অস্বীকারের কোনো উপায় নেই। পৃথিবীর এমন কোনো দেশ নেই যেখানে সড়ক দুর্ঘটনা হয় না। তবে বিশ্বের উন্নত দেশগুলোতে সড়ক দুর্ঘটনার নানান যৌক্তিক কারণ থাকে। কিন্তু এখানে সড়কে যে দুর্ঘটনাগুলো ঘটছে, সেখানে যৌক্তিক কারণ কতটা তা নিয়েই প্রশ্ন।
লেখক: কলামিস্ট / সম্পাদনা: আশিক রহমান