প্রাচীরের উচ্চতা বৃদ্ধি নয়, প্রয়োজনে ভেঙে ফেলুন
ইকতেদার আহমেদ
পৃথিবীর উন্নত গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রসমূহে সরকারের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ কার্যালয়ে প্রবেশাধিকার সংরক্ষিত হলেও এগুলোর বহিরাঙ্গন উঁচু সীমানা প্রাচীর দ্বারা বেষ্টিত নয়। এ সব দেশের সরকার প্রধানের বাসভবনও এ ধরনের প্রাচীর দ্বারা বেষ্টিত নয়। অনেক উন্নত গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের ক্ষেত্রে দেখা যায়, জনসাধারণ ও যানবাহন চলাচলের সড়কের পর উন্মুক্ত মাঠে, বিভিন্ন ধরনের ফুল গাছের সমারোহে সরকারের গুরুত্বপূর্ণ কার্যালয়। কোনো কোনো দেশে সরকারের গুরুত্বপূর্ণ কার্যালয়ের বহিরাঙ্গনে সীমানা প্রাচীর থাকলেও তা দৃষ্টি আবদ্ধ হয় এমন ধরনের দেয়াল দ্বারা বেষ্টিত নয়। অধিকাংশ ক্ষেত্রে দেখা যায়, নির্ধারিত দূরত্বের পিলারের মধ্যে লোহার রড বা লোহার গ্রিলের স্বল্প উচ্চতার প্রাচীরের বেষ্টনী।
এ কথা অনস্বীকার্য, দৃষ্টিনন্দন যেকোনো ভবনের বহিরাঙ্গন দৃষ্টি আবদ্ধ হয় এমন ধরনের সুউঁচ্চ সীমানা প্রাচীর দ্বারা বেষ্টিত হলে তা একদিকে ভবনটির সৌন্দর্যের হানি ঘটায়, অপরদিকে ভবনটির সম্মুখ দিয়ে যাতায়াত করে এমন জনমানুষের ভবন ও ভবনের সম্মুখস্থ ফুলের বাগান বা সবুজ চত্বরের সৌন্দর্য অবলোকনের ক্ষেত্রে অন্তরায় হিসেবে দেখা দেয়। উন্নত গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রসমূহের সরকারের গুরুত্বপূর্ণ কার্যালয় বা সরকারের গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের বাসভবন দৃষ্টি আবদ্ধ হয় এমন সুউঁচ্চ প্রাচীর দ্বারা বেষ্টিত না হওয়ার কারণে এগুলোর নিরাপত্তা কখনও বিঘিœত হয়েছে এমনটি শোনা ও দেখার ঘটনা বিরল।
অতীতে দেখা গেছে, বিভিন্ন দেশের শাসকেরা বিশেষত, ঔপনিবেশিক শাসকেরা কারাগারসমূহের বহিরাঙ্গনের সীমানা নিরাপত্তার দৃষ্টিকোণ হতে দৃষ্টি আবদ্ধ হয় এমন সুউঁচ্চ প্রাচীর দ্বারা বেষ্টনে গুরুত্বারোপ করতেন। বর্তমানে শাসকদের মধ্যে অতীতের সে মানসিকতা নেই। এখনকার অধিকাংশ কারাগারের বহিরাঙ্গনের প্রাচীরের বেষ্টনী অতীতের মতো সুউঁচ্চ না হলেও এগুলোর উপরিভাগে রয়েছে বিদ্যুৎ বাহিত কাটাতারের বেষ্টনী। তাছাড়া এখনকার কারাগারসমূহের নিরাপত্তা বেষ্টনীসহ গুরুত্বপূর্ণ সকল স্থান সিসি ক্যামেরার আওতাভুক্ত হওয়ায় কোনো কারাবন্দীর পক্ষে পলায়নের চিন্তা যে নির্ঘাত বিফলতায় পর্যবসিত হবে, একথা ভেবে কোনো কারাবন্দীই এ পথে পা বাড়ায় না।
এখন উন্নত গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রসমূহে সরকারের সকল গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনাসহ প্রধান শহরসমূহের গুরুত্বপূর্ণ সড়কগুলো সিসি ক্যামেরার আওতাভুক্ত হওয়ায় যে কারও পক্ষে অপরাধ সংঘটন পরবর্তী পার পাওয়া খুবই দূরহ। আর এ কারণেই এ সকল দেশে অনেক অপরাধী অপরাধ সংঘটন পরবর্তী ধরা পড়ে যাবে, এই ভয়ে আত্মাহুতির মাধ্যমে নিজের জীবনাবসান ঘটায়। তারপরও অপরাধ সংঘটন হচ্ছে না, এ কথা যেমন বলা যাবে না, অনুরূপ অপরাধ সংঘটন পরবর্তী অনেক অপরাধীর আত্মগোপনে কিছুকাল কাটানোর নজিরও রয়েছে।
আমাদের দেশের গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনাসমূহের মধ্যে সংসদ ভবন, সুপ্রীম কোর্ট, প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়, বঙ্গভবন, গণভবন, সচিবালয়, শেরেবাংলা নগরস্থ সচিবালয়, নগরভবন, বাংলাদেশ ব্যাংক, রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবন পদ্মা প্রভৃতি অন্যতম। উপরোক্ত ভবনসমূহের মধ্যে বঙ্গভবন, গণভবন, সচিবালয়, শেরেবাংলা নগরস্থ সচিবালয় ও রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবন পদ্মা সুউঁচ্চ দেয়াল দ্বারা বেষ্টিত।
প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় ও সুপ্রীম কোর্টের সম্মুখ ভাগের সীমানা প্রাচীরে নির্ধারিত দূরত্বের পিলারের মধ্যে মাঝারি উচ্চতার লোহার রড বা লোহার গ্রিলের বেষ্টনী রয়েছে। সংসদ ভবনের চতুর্দিকে স্বল্প উচ্চতার লোহার রড বা গ্রিলের যে বেষ্টনী ছিল তা সংসদ ভবনের নিরাপত্তার জন্য অপ্রতুল এ কারণ দেখিয়ে এটিকে মাঝারি উচ্চতার লোহার রড বা গ্রিলের বেষ্টনী দ্বারা স্থলাভিষিক্ত করা হচ্ছে। উপরোক্ত তিনটি ভবনের বহিরাঙ্গনের বেষ্টনী দ্বারা জনমানুষের দৃষ্টি আবদ্ধ না হওয়ার কারণে তারা চলাচলের সময় এগুলোর প্রাঙ্গনে বিভিন্ন ধরনের মনোমুগ্ধকর ও সুশোভিত ফুলের বাগানের যে সমারোহ রয়েছে তার সৌন্দর্য অবলোকন করতে পারেন। এ ধরনের সৌন্দর্য অবলোকন যে, জনমানুষকে সাময়িক প্রশান্তি দেয় তা যদি দেশের শাসনক্ষমতায় যারা অধিষ্ঠিত তারা সঠিকভাবে অনুধাবন করেন, তবে এ কথা নিশ্চিতভাবে বলা যায়, আমাদের যে সব গুরুত্বপূর্ণ ভবনের বহিরাঙ্গনের সৌন্দর্য দৃষ্টি আবদ্ধ হয় এমন সুউঁচ্চ দেয়ালের কারণে বিঘিœত তা নিরসনে তারা সচেষ্ট হবেন।
সম্প্রতি শেরেবাংলা নগরস্থ সচিবালয় ও রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবনের সীমানা প্রাচীরের উচ্চতা আরও বৃদ্ধি করা হয়েছে। এ বৃদ্ধির ফলে এ দুটি ভবনের সম্মুখস্থ বা অভ্যন্তরস্থ যে সকল ফুলের বাগান রয়েছে তা ভবন দুটির বাইরে দিয়ে যারা চলাচল করেন তারা তা অবলোকনে ব্যর্থ হন। তাছাড়া সুউঁচ্চ প্রাচীরের কারণে ভবন দুটির অভ্যন্তরে প্রাকৃতিকভাবে স্বাভাবিক বায়ু চলাচলে বিঘœ ঘটছে। বর্তমানে প্রযুক্তির উন্নতি হওয়ার কারণে সিসি ক্যামেরা ছাড়াও নিরাপত্তামূলক বিভিন্ন ধরনের ইলেকট্রনিক ডিভাইসের প্রচলন ঘটেছে। উন্নত গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রসমূহ উভয়ের প্রয়োগের মাধ্যমে তাদের সকল ধরনের গুরুত্বপূর্ণ কার্যালয় ও স্থাপনার নিরাপত্তা সীমানা প্রাচীর ব্যতিরেকে অথবা স্বল্প উচ্চতার লোহার রড বা লোহার গ্রিলের প্রাচীর দ্বারা নিশ্চিত করছেন। সরকারি যেকোনো কার্যালয়ের বহিরাঙ্গনের সীমানা প্রাচীরের নির্মাণ ব্যয় দেশের সাধারণ মানুষ প্রদত্ত কর হতে নির্বাহ করা হয়। প্রদত্ত কর দেশ গঠনমূলক কাজ ও উন্নয়নে ব্যয় হবে এ উপলব্ধি হতেই সাধারণ মানুষ কর প্রদান করে থাকে।
যেকোনো গণতান্ত্রিক দেশে সরকার পরিচালনার দায়িত্বভার যাদের উপর ন্যস্ত, সাধারণ জনমানুষের সঙ্গে তাদের যোগাযোগ যতবেশি নিবিড় হবে, তারা ততবেশি জনমানুষের দুঃখ দুর্দশা লাঘবসহ বিভিন্ন ধরনের সমস্যা নিরসন করে দেশকে উন্নয়ন ও সমৃদ্ধির দিকে নিয়ে যেতে পারবেন। সরকার পরিচালনার দায়িত্বে নিয়োজিতদের সঙ্গে সাধারণ জনমানুষের সম্পৃক্ততা না থাকলে বা কম থাকলে তাদের পক্ষে সাধারণ জনমানুষের অভাব-অভিযোগ অনুধাবন সম্ভব নয়। একটি দেশ যত সমৃদ্ধ বা উন্নতই হউক না কেন, সে দেশের সাধারণ মানুষের অভাব-অভিযোগ থাকবেই। আর এ অভাব-অভিযোগ অনুধাবন করতে হলে প্রয়োজন দূরত্বের ব্যবধান লাঘব। সরকারি যেকোনো গুরুত্বপূর্ণ ভবনে দৃষ্টি আবদ্ধ হয় এমন সুউঁচ্চ প্রাচীন সাধারণ জনমানুষের সঙ্গে সরকারের শীর্ষ পর্যায়ের ব্যক্তিদের দূরত্ব বৃদ্ধির সহায়ক। সুতরাং এ ধরনের প্রাচীর সুউঁচ্চ না করে দেশের প্রয়োজনে ও জনস্বার্থে তা স্বল্প উচ্চ বা মাঝারি উচ্চতার হোক এটাই জনমানুষের প্রত্যাশা।
লেখক: সাবেক জজ, সংবিধান, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক বিশ্লেষক / সম্পাদনা: আশিক রহমান