সড়কের এই মৃত্যু মিছিল থামাবে কে?
ডা. জাকির হোসেন
কুরবানির ঈদ বা ঈদুল আযহা উপলক্ষে ঘরে ফেরা মানুষের আনন্দ যাত্রাকে আনন্দদায়ক করা গেল না। বিষাদ ছেয়ে গেছে অগণিত মানুষের হৃদয়। আপনজন হারা হয়েছে হাজারও পরিবার। মানুষের আর্তনাদে বাতাস ভারী হচ্ছে। প্রতিবছর থেকেই সংবাদমাধ্যমে ঈদে দেশে ঘটে যাওয়া মহাসড়কগুলোতে ভয়াবহ দুর্ঘটনার বর্ণনা পড়ে পড়ে আমরা বেদনার্ত হই, কষ্ট পাই। অল্পকিছু সংখ্যক মানুষের অবহেলা, কোনোভাবেই ঠেকানো যাচ্ছে না সড়কের এই মৃত্যু মিছিল। পাপিষ্ট মানুষগুলোর অমানবিকতা দিনে দিনে বাড়ছেই, কোনোভাবেই তাদের মনের ভিতর সচেতনতা জাগছে না। সজাগ-সতর্কতার কোনো নমুনাই দৃশ্যমান হচ্ছে না।
আমরা মানুষ হয়ে মনের অজান্তেই অন্য মানুষের প্রতি এমন নিষ্ঠুর হয়ে যাচ্ছি। প্রাকৃতিক ঝড়-ঝঞ্চার দেশ এই বাংলাদেশে বাঙালি জন্মলগ্ন থেকেই যেকোনো সংকটে নিজেকে মানিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করে। প্রকৃতির বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে ধীরে ধীরে নিজেকে টিকিয়ে রাখার সংগ্রাম বাঙালিকে অনেক দূর এগিয়ে দিয়েছে। দেখতে দেখতে এই জাতি এখন মধ্যম আয়ের দেশে পদার্পণের দোরগোড়ায়। ত্রিশ লাখ প্রাণের বিনিময়ে অর্জিত স্বাধীনতাকে বাংলাদেশ কিছুটা হলেও মূল্যায়ন করতে পেরেছে। পরাজিত, ব্যর্থ পাকিস্তান থেকে বাংলাদেশ আজ বহুগুণে অগ্রসরমান। স্বাস্থ্য, শিক্ষা, স্যানিটেশন ইত্যাদি সূচকে বাংলাদেশ পরাজিত পাকিস্তানসহ পার্শ্ববর্তী অনেক দেশ থেকে এগিয়ে। সংগ্রামী কৃষক ভাইদের সংগ্রামী পথ ধরে বাঙালি শুধু বেঁচে থেকেই ক্ষান্ত হয়নি, দেশকে খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ করে উদ্ধৃত খাদ্যপণ্য আজ বহির্বিশ্বে রপ্তানি করছে। কিন্তু প্রতিবছর আমাদের বড় বড় উৎসবগুলোকে কেন্দ্র করে মহাসড়কগুলোতে মানুষের ভোগান্তি আর মৃত্যুর মিছিলে সব অর্জন যেন নিমিষেই ম্লান হয়ে যাচ্ছে। টেলিভিশনের পর্দা আর পত্রিকার পাতায় চোখ পড়লেই মনে হয়, এই দেশের যোগাযোগ ব্যবস্থায় কোনো আধুনিকতা, উন্নতির ছোঁয়া লাগেনি! মানুষের ভোগান্তির মাত্রা ও দুর্ঘটনার ভয়াবহতার চিত্র দেখলে মনে হয়, আমরা এখনও বিশ্বের পিছিয়ে থাকা জাতিগুলোর মধ্যে একটি জাতি! অথচ এমনটি তো আমরা নই। আমরা বীরের জাতি। মাথা উচু করেই বাঁচতে জানি। পিছিয়ে যাওয়া কারও সঙ্গে আমাদের তুলনা হতে পারে না। আমাদের চরম দুর্ভাগ্য যে, উন্নতির চরম এই সময়েও আমরা সড়কে মানুষের এই মৃত্যু মিছিল থামাতে পারছি না।
সড়ক দুর্ঘটনায় মানুষের এই মৃত্যু মিছিল শুধু কিছু পরিবারই ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে না, ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে জাতি। মানুষের এই মৃত্যু জাতীয় অর্থনীতিতেও বিরূপ প্রভাব ফেলছে। কারণ বিশাল জনসংখ্যার বাংলাদেশে এক সময় জনসংখ্যাকে সমস্যা হিসেবে চিহ্নিত করা হলেও দিনে দিনে সেই জনসংখ্যা জনসম্পদে পরিণত হয়েছে। যার ফলে পরিবারের উপার্জনক্ষম ব্যক্তিটি দুর্ঘটনায় পতিত হলে অর্থনৈতিকভাবে নিঃস্ব হয়ে যায় একটি পরিবার, তার উপর নির্ভর করে চলা ছেলেমেয়েদের পড়াশোনায় বিঘœ ঘটে। পরিবারের প্রতিটি সদস্য আক্রান্ত হন সাইকোলজিক্যাল ট্রমায়। কারণ যেসব পরিবার-পরিজন স্বজন হারান, তারাই জানেন স্বজন হারানোর বেদনা কতটা কঠিন। সড়কের এই মৃত্যু মিছিল থামাবে কে? সংশ্লিষ্টরা এ বিষয়ে কথা বলেন, আশ্বাস দেন কিন্তু কাজের কাজ কিছু কি হচ্ছে? সড়ক দুর্ঘটনা কি বন্ধ হচ্ছে? হচ্ছে না। অথচ মানুষের এই মৃত্যু মিছিল যাতে বন্ধ হয় দ্রুত কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করা উচিত, সেটা কি আমরা নিচ্ছি? নিলে তার সুফল পাচ্ছি না কেন? এসব প্রশ্নের উত্তর কে দিবে?
এভাবে চলতে দেওয়া যায় না। এমন মৃত্যু আর মেনে নেওয়া যায় না। কথায় নয়, মানুষ দেখতে চায় কার্যকর উদ্যোগ। চালকেরা যাতে সচেতন হন, দায়িত্বশীলতার সঙ্গে চালান, এ বিষয়ে আরও মনোযোগী হওয়া জরুরি। সরকার, মিডিয়া, দায়িত্বশীল ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানসমহের যৌথ প্রয়াসে আমরা উদ্বেগ কাটাতে পারি। মানুষের অকাল মৃত্যু রোধ করতে তৎপর হতে পারি। সড়ক-মহাসড়কগুলো নিরাপদ করা খুব জরুরি হয়ে পড়েছে। একই সঙ্গে দুর্ঘটনায় স্বজন হারানো পরিবারকে রাষ্ট্রীয় ও সামাজিকভাবে পূনর্বাসনের প্রকল্প হাতে নেওয়া এখন সময়ের দাবি।
লেখক: চিকিৎসক ও কলামিস্ট
সম্পাদনা: আশিক রহমান