আমরা কি সন্তানদের স্বনির্ভর করছি?
আরিফ জেবতিক
নতুন মডেলের মোটরসাইকেল কিনে না দেওয়ায় ফারদিন হুদা মুগ্ধ নামের এক বখাটে ছেলে তার বাবা-মাকে আগুনে পুড়িয়ে হত্যার চেষ্টা করেছে! মাত্র এসএসসি পাস করা এই ছেলেকে কিছুদিন আগেই তার বাপ ৫ লাখ টাকা দিয়ে একটি মোটরসাইকেল কিনে দিয়েছিলেন, ছেলে এখন নতুন মোটরসাইকেল কিনতে চেয়েছে, সেটা না পেয়ে মা-বাবাকে পুড়িয়ে দিচ্ছে! রিয়েলি?
এখন আমি যদি খারাপ কিছু বলি তাহলে সবাই নির্ঘাত তেড়ে এসে বলবেন, ‘একটা পরিবার পুড়ে মরতে বসেছে আর তুমি এসেছ আলুপোড়া খেতে।’ ওয়েল, আলুপোড়া খাবার জন্য নয়, আপনি আমি নিজেরা যাতে পরবর্তী আগুনে পোড়ার শিকার না হন, এজন্যই লিখছি।
আমাদের দেশের কিছু কিছু মা-বাবার মতো অপত্য অন্ধ সন্তান স্নেহ বিশ্বের আর কোনো জাতির মাঝে আছে কি না আমার জানা নেই। কিছু কিছু মা-বাবা সুস্থ সন্তান জন্ম দেন ৯ মাসে আর বাকি জীবন সেই সন্তানকে পঙ্গু বানানোর কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়েন। সন্তানদের হাতে অতিরিক্ত টাকা দেওয়ার কুফলে আগুনে পুড়ে যাওয়া হয়তো একটি এক্সট্রিম ঘটনা, কিন্তু নজর বুলিয়ে দেখবেন আপনার আমার আশেপাশে ছোটখাটো ঘটনা খুব কম নয়। বছর কয়েক আগে মোহাম্মদপুরের এক লোক পত্রিকার পাতায় আহাজারি করেছিলেন, কারণ ক্লাস এইটে ওঠার পরে সন্তানকে তিনি ‘ভিডিও গেম’ খেলার জন্য দিনে ৮শ টাকা দিতেন। সেই সন্তান ভয়াবহ মাদকাসক্ত হয়ে এরকম খুনি ঘটনাই ঘটিয়েছিল। এখন যদি ক্লাস এইটের বাচ্চা দিনে ৮শ টাকা পায়, তাহলে তার কৃতকর্মের জন্য কি সেই সন্তানের জেল হওয়া উচিত, নাকি মা-বাবার? ঢাকার শীর্ষ সন্ত্রাসী একজনের মা ছিলেন খ্যাতনামা চিকিৎসক, মাথা চাপড়ে বলেছিলেন যে এসএসসি পাস করার পর ছেলেকে বাইক কিনে দেওয়াটা ছিল তার জীবনের সবচাইতে বড় ভুল।
আমরা অনেকেই হয়তো বলব, আমাদের বাপু এত টাকা নেই যে এসএসসি পড়ুয়া ছেলেকে ৫ লাখ টাকা দিয়ে বাইক কিনে দেব কি দিনে ৮শ টাকা হাত খরচ দেব। ঠিক আছে, এটা কিন্তু একটা পার্ট।
অন্য পার্টে আসি। আমরা কি আমাদের সন্তানদেরকে স্বনির্ভর করে বড় করছি? বিদেশেও দেখেছি নিজের বাচ্চাকাচ্চাকে তারা স্বনির্ভর করে গড়ে তুলে। আমরা বাচ্চাদের নিজেদের বিছানাটা ঠিক করতে শেখাই না। ৮ বছরের বাচ্চা কিন্তু দিব্যি নিজের বিছানা ঠিক করতে পারে, নিজের বই গুছিয়ে রাখতে পারে, এমনকি রাতের খাবার পরে অন্তত নিজের এঁটো প্লেটটি রান্নাঘরে নিয়ে রেখে আসতে পারে। বাসার বাইরে নানা ঝুঁকি আছে বলে সন্তানকে আগলে রাখি, সে ভালো কথাÑ কিন্তু ঘরের ভিতরে সন্তানকে তো অন্তত স্বনির্ভরতা কিছুটা শেখানো উচিত।
দ্বিতীয় বড় বিষয়টি হচ্ছে, নিজের সন্তানকে শুরু থেকেই এই শিক্ষা দেওয়া যে জীবন খুব কঠিন, এখানে চাইলেই সবকিছু পাওয়া যায় না, অর্জন করে নিতে হয়। বাচ্চারা চাইলেই সব খেলনা কিনতে পারবে না, সেটার একটা রুটিন থাকা দরকার। আপনার যতই টাকাপয়সা থাকুক সেটি আপনার, আপনার বাচ্চার জন্য সেটি অফুরন্ত করে রাখার কোনো দরকার নেই। প্রয়োজন আর বিলাসিতা এক জিনিস নয়। ক্লাস টেনের বাচ্চা একটা বাইসাইকেল পেতে পারে অবশ্যই, কিন্তু কোনো অবস্থাতেই ৫ লাখ টাকার মোটরবাইক নয়।
স্কুল পড়ুয়া একটা বাচ্চার নিরাপত্তার জন্য যদি মুঠোফোন কিনে দিতেই হয়, সেটি হওয়া উচিত একেবারেই সস্তা দামের চাইনিজ সেট, শুধু ফোন আর টেক্সট মেসেজ করা যায় এমন ‘আনস্মার্ট’ ফোন। সেই ফোনও বাসায় আপনার জিম্মায় থাকা দরকার।
এগুলো সবই আমরা জানি। কিন্তু মানি কি? যদি না মানি, তাহলে নিজের সন্তানকে পঙ্গু কি, বখাটে বানানোর দায়ভার কি আমাদের নিজেদের নয়? নিজে দায়িত্বহীন আচরণ করে জাতির জন্য একটি অকাট আত্মবিশ্বাসহীন অকম্মা নাগরিক তৈরি করাটা কি নায্য হয়?
লেখক: সাংবাদিক ও লেখক