গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে জনপ্রতিনিধি এবং জনপ্রশাসনের সম্পর্ক
বৃটিশরা এদেশে শাসনের জন্য যে প্রশাসনিক ব্যবস্থা স্থাপন করে পরবর্তীতে ১৯৪৭ সাল পাকিস্তান সৃষ্টির পরও পাকিস্তানি সরকারকর্তৃক তা চলতে থাকে। ১৯৪৭ এর পরবর্তী সময়ে তৎকালীন পাকিস্তানে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা চালু না হওয়ার কারণে এবং দেশের প্রধান নির্বাহীর ইচ্ছানুযায়ী প্রশাসকগণ কাজ করতেন। বৃটিশ শাসনামলে তাই আইসিএস অফিসাররা স্থানীয় মন্ত্রীদের উপর মর্যাদা পেতেন এবং পাকিস্তান আমলেও আমরা দেখতে পাই, ডধৎৎবহঃ ড়ভ চৎবপরফবহপব এ সংসদ সদস্যদের অবস্থান ছির যুগ্ম সচিবের সমপর্যায়ে। বাংলাদেশ স্বাধীন হবার পর নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের পদমর্যাদা সচিবের উপর নির্ধারিত হয়। তাছাড়া সংসদ সদস্যদের মেয়াদ খ-কালীন এবং প্রশাসনিক ব্যবস্থা স্থায়ী বলে উন্নয়ন কর্মকা-ে প্রশাসকগণই মূল ভূমিকা পালন করে আসছে। প্রশাসকদের অবস্থান এবং স্থায়ীত্বের কারণে মাঠ পর্যায়ে জনগণ প্রশাসকদেরই সরকার মনে করে থাকে। তাই সচরাচর রাজনীতিবিদ, গবেষক বিভিন্ন পেশাজীবী গ্রুপ আমলাতন্ত্রকে সমালোচনা করে থাকলেও আজ পর্যন্ত এর কোনো বিকল্প ব্যবস্থা সৃষ্টি করতে পারেনি। প্রকৃতপক্ষে আমলাতন্ত্রের কোনো বিকল্পের প্রয়োজন নেই, প্রয়োজন আমলাতন্ত্রকে জনগণের কল্যাণে কাজে লাগানো। এর জন্য চাই সংসদ এবং আমলাতন্ত্রের মধ্যে সমন্বয়। বাংলাদেশ সংবিধানের ৫৫(৬) ধারা বলে ১৯৭৫ সালে রুলস অব বিজনেস প্রণীত হয়েছিল তাতে মন্ত্রণালয়ের সকল কর্মকা-ের প্রধান নির্বাহী ছিল সচিবগণ এবং সচিবগণ ছিলেন মন্ত্রণালয়ের প্রধান হিসাবরক্ষক কর্মকর্তা। ১৯৯৬ সালে রুলস অব বিজনেস পরিবর্তন করে মন্ত্রীদের মন্ত্রণালয়ের প্রধান নির্বাহী করা হলেও সচিবগণ এখনও চৎরহপরঢ়ধষ অপপড়ঁহঃরহম ড়ভভরপবৎ হিসেবে কাজ করেছেন।
গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া বিকাশের পূর্ব শর্ত হচ্ছে দক্ষ প্রশাসনিক ব্যবস্থা। বৃটিশ শাসন আমল থেকে পাকিস্তান আমল এবং বাংলাদেশে ১৯৭৫ পরবর্তী সময়ে এদেশে স্বৈরশাসন পরিচালনার কারণে গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া বিকাশ করতে পারেনি। উপরন্তু আমলা এবং রাজনৈতিকদের মধ্যে পারস্পরিক অবিশ্বাস সৃষ্টি হয়েছে। পক্ষান্তরে যুক্তরাজ্য, ভারত, মালয়েশিয়ার মতো দেশ দীর্ঘ গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া চালুর কারণে পরস্পরের মধ্যে শ্রদ্ধাবোধ এবং বিশ্বাস সৃষ্টি করতে সক্ষম হয়েছে।
উপরোক্ত আলোচনা হতে এটাই স্পষ্ট, প্রশাসকগণ তাদের অবস্থান, স্থায়ীত্ব এবং ধারাবাহিকতার কারণে উন্নয়ন কর্মকা-ে মূল ভূমিকা পালন করে আসছে। বিগত বছরগুলোতে এদেশে গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ার বিকাশ না হওয়াতে উন্নয়ন কর্মকা-ে সংসদের ভূমিকা ছিল অত্যন্ত গৌণ। তাই বর্তমানে গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা এবং দেশের আর্থ সামাজিক উন্নয়ন এবং সামাজিক ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠায় চাই সংসদ এবং প্রশাসনের মধ্যে সমন্বয়।
প্রশাসনের উপর সংসদের কর্তৃত্ব ঃ গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় সাংসদগণ নিম্নে বর্ণিতভাবে প্রশাসনিক কর্মকা- নিয়ন্ত্রণ করে থাকে : এক. মন্ত্রীগণ স্ব স্ব মন্ত্রণালয়ে প্রধান নির্বাহী হিসেবে মন্ত্রণালয়ের যাবতীয় কর্মকা- নিয়ন্ত্রণ করা এবং তাদর কার্যের জন্য সংসদের নিকট এককভাবে দায়ী থাকা। দুই. সংসদীয় কমিটির মাধ্যমে মন্ত্রণালয়ের কর্মকা- নিয়ন্ত্রণ। সরকারের বিভিন্ন বিভাগের কর্মকা- নিয়ন্ত্রণের জন্য বাংলাদেশ সংবিধানের ৭৬(১) ধারায় সংসদ সদস্য সমন্বয়ে কমিটি গঠনের বিধান রাখা হয়েছে। বর্তমানে সরকারি হিসাব কমিটি, বিশেষ অধিকার কমিটি ইত্যাদি ছাড়াও প্রত্যেকটি মন্ত্রণালয়ের জন্য একটি করে সংসদীয় স্থায়ী কমিটি গঠন করা হয়েছে। সরকারের স্বচ্ছতা এবং জবাবদিহিতা নিশ্চিত করণের লক্ষ্যে বর্তমান সরকার মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রীদের পরিবর্তে সংসদ সদস্যদের এ সকল স্থায়ী কমিটিতে সভাপতি নিয়োগ করেছেন। সংবিধানের ৭৬(২ ও ৩) তে এ সকল কমিটির কার্যাবলি নির্ধারিত করা হয়েছে। যেমনÑ ক. খসড়ার বিল ও অন্যান্য আইনগত প্রস্তাব পরীক্ষা করিতে পারিবেন।
খ. আইনের বলবৎকরণ পর্যালোচনা এবং অনুরূপ বলবৎ করণের জন্য ব্যবস্থাদি গ্রহণের প্রস্তাব করিতে পারিবেন।
গ. জনগুরুত্ব সম্পন্ন বলিয়া সংসদ কোনো বিষয় সম্পর্কে কমিটিকে অবহিত করিলে সেই বিষয়ে কোনো মন্ত্রণালয়ে কার্য বা প্রশাসন সম্বন্ধে অনুসন্ধান বা তদন্ত করিতে পারিবেন এবং কোনো মন্ত্রণালয়ের নিকট হইতে ক্ষমতাপ্রাপ্ত প্রতিনিধির মাধ্যমে প্রাসঙ্গিক তথ্যাদি সংগ্রহের এবং প্রশ্নাদির মৌখিক বা লিখিত উত্তরলভের ব্যবস্থা করিতে পারিবেন।
ঘ. সংসদকর্তৃক অর্পিত যেকোনো দায়িত্বপালন করিতে পারিবনে।
তিন. সংসদ আইনের দ্বারা এই অনুচ্ছেদের অধীন নিযুক্ত কমিটিসমূহকে
ক. সাক্ষীদের হাজিরা বলবৎ করিবার এবং শপথ ঘোষণা বা অন্য কোনো উপায়ের অধীন তাহাদের সাক্ষ্য গ্রহণের; খ. দলিলপত্র দাখিল করিতে বাধা করিবার ক্ষমতা প্রদান করিতে পারিবেন। (১) নবগঠিত এসকল কমিটিগুলোর কাজের ব্যাপ্তি অনেক বিস্তৃত হলেও কমিটিগুলোতে কোনো প্রফেশনাল লোকবল বা লজিস্টিক সাপোর্ট দেওয়া হয়নি। গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া বিকাশে এবং সরকারের স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত করতে এসকল কমিটিগুলোকে আরও বেশি সংগঠিত করা প্রয়োজন। কেননা গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় কমিটি প্রথা হলো অন্যতম পদ্ধতি যা দিয়ে সংসদ প্রশাসনিক কর্মকা- নিয়ন্ত্রণ করতে পারে। মন্ত্রণালয়ের আর্থিক ব্যবস্থাপনায় মন্ত্রীদের নিয়ন্ত্রণ স্থাপনে মন্ত্রীদের চৎরহপরঢ়ধষ অপপড়ঁহঃরহম ড়ভভরপবৎ নিয়োগ করা প্রয়োজন। (চলবে)
লেখক: সংসদ সদস্য ও সাবেক ডেপুটি স্পিকার / সম্পাদনা: আশিক রহমান