আমি দেবতা দেখিনি, জাস্টিস ভট্টাচার্য্যকে দেখেছি
সীতাংশু গুহ
অনেক দিন আগের কথা, সম্ভবত আশির দশকের গোড়ার দিকে জাতীয় প্রেসক্লাবের সামনে মঞ্চ বানিয়ে আমরা শত্রু (অর্পিত) সম্পত্তি আইন বাতিলের দাবিতে প্রতীক গণ-অনশন কর্মসূচি পালন করছিলাম। এর উদ্যোক্তা ছিল শত্রু সম্পত্তি আইন প্রতিরোধ পরিষদ, যা ঠিক মনে নেই, হয়তো ১৯৭৯ সালে গঠিত হয়। এর সভাপতি ছিলেন, বিচারপতি দেবেশ ভট্টাচার্য্য এবং সাধারণ সম্পাদক অ্যাডভোকেট আমিনুল হক। আমিনুল হক, যিনি সার্জেন্ট জহুরুল হকের ভ্রাতা এবং পরে অ্যাটর্নি জেনারেল ছিলেন। প্রতিকী অনশন কর্মসূচিতে অনেকেই অংশ নেন, বিভিন্ন সময়ে অনেকেই স্টেজে উপস্থিত ছিলেন। আমি যে সময়টার কথা বলছি, তখন অন্যান্যদের মধ্যে জাস্টিস দেবেশবাবু, ব্যারিস্টার শওকত আলী, ব্যারিস্টার সুধীর দাস প্রমুখ মঞ্চে উপবিষ্ট ছিলেন।
আমি কমিটির দফতর সম্পাদক ছিলাম। নিম ভৌমিক ও সুব্রত চৌধুরী যথাক্রমে যুগ্ম ও সাংগঠনিক সম্পাদক। আমাদের অফিস ছিল মেনন-রনো ভাইয়ের ওয়ার্কার্স পার্টির একটি রুম, তোপখানা রোডে, আমরা নিয়মিত সেখানে বসতাম। ঘটনার দিন, দেবেশ ভট্টাচার্য্য, যাকে আমি ‘মেসো’ বলে ডাকতাম, তখন মঞ্চে বসা, আমরা ক’জনা স্টেজের পেছনে তদারকি করছিলাম। এসময়ে সুমিত দেবী এলেন। ডাকলেন, বললেন, ‘দেবেশবাবুকে একটু ডেকে দিন না?’ বললাম, কেন? উনি বললেন, ‘দরকার আছে’। তাকে অল্পবিস্তর চিনতাম, তাই আবারও বললাম, দরকারটা কি না বললে তো মেসোকে ডাকতে পারব না। এবার অভিনেত্রী সুমিত দেবী বললেন, ‘উনি ব্রাহ্মণ মানুষ, প্রণাম করব’।
তার কথায় অবাক হলাম। স্টেজে গেলাম, মেসোকে ফিসফিস করে জানালাম, সুমিতা দেবী আপনাকে একটু স্টেজের পেছনে যেতে অনুরোধ করেছেন। তিনি জিজ্ঞাসা করলেন, ‘কেন?’ বললাম, উনি প্রণাম করবেন। শুনে মেসো তখন একটু মুচকি হাসি দিলেন। গল্পটি বলার কারণ এটা যে, মেসোর সেই অমায়িক হাসির কথা আমার আজও মনে আছে। তিনি নিচে নেমে এলেন, সুমিত দেবীর সঙ্গে টুকটাক কথা বললেন। এরপর স্টেজের পেছনে সুমিত দেবী গলায় আঁচল পেঁচিয়ে ভক্তি ভরে মেসোকে পায়ে ধরে সশ্রদ্ধ প্রণাম করলেন। মেসো আশীর্বাদ করলেন। কিছু সময় পর তিনি আবার স্টেজে চলে গেলেন। সুমিতা দেবীও বিদায় নিলেন।
জাস্টিস দেবেশ ভট্টাচার্য্য, যার সঙ্গে আমেরিকায় আসার আগে আমার প্রায় একযুগ কাজ করার সৌভাগ্য হয়েছিল। আমি দেবতা দেখিনি, দেবেশবাবু ও চিত্রা ভট্টাচার্য্যকে দেখেছি। আজও আমি মাঝে মধ্যে সগর্বে বলি, ‘এমন চমৎকার ভদ্রলোক আমার জীবনে দেখিনি’। মেসো-মাসিমা দুজনের অমায়িক সুন্দর ব্যবহার, সৌম্যদীপ্ত চমৎকার স্বর্গীয় চেহারা, দুজনে যৌবনে রাজযোটক ছিলেন তা বলাবাহুল্য। কথাও বলতেন দেবদূতের মতো মিষ্টি। মেসো তখন রিটায়ার্ড করেছেন, কিন্তু ওই বয়সেও মেসো-মাসিমার রাজকীয় আচার-আচরণ, স্নিগ্ধ সৌন্দর্য্য, ততোধিক চমৎকার ব্যবহার সবাইকে শ্রদ্ধাবনত করত। তার সামনে সবার মাথা নিচুই দেখেছি, এমনকি তখনকার সময়ে প্রতাপশালী সিএমএলএ এরশাদকেও অত্যন্ত বিনম্রভাবেই কথা বলতে দেখেছি। একজন মানুষ কতটা শ্রদ্ধাশীল হলে সবাই তাকে শ্রদ্ধা করে তা মাঝে মধ্যে ভেবে আমি অবাক হতাম।
সদ্য কর্মজীবনে প্রবেশের পরপরই আমার মেসো-মাসিমার সান্নিধ্যে আসার সুযোগ ঘটে, দুজনের স্নেহধন্য হবার সুযোগ হয়েছিল আমার। প্রায় একই সময়ে অর্থাৎ সত্তর দশকের একেবারে শেষ বা আশির দশকের শুরুতে ঢাকায় অবস্থিত হিন্দু সম্প্রদায়ের প্রথিতযশা প্রায় সবার সঙ্গেই আমার একটি চমৎকার সম্পর্ক গড়ে ওঠে। প্রথমে তা সাংগঠনিক হলেও পরে অনেকের সঙ্গেই তা আরও গভীরে পৌঁছে। ওই সময় যাদের সান্নিধ্যে আমার আসার সুযোগ ঘটেছিল তাদের ক’জনার নাম না বললেই নয়, মেজর জেনারেল সি আর দত্ত, বীরউত্তম (তিনি তখনও চাকরিরত); জাস্টিস রণধীর সেন; ব্যারিস্টার সুধীর দাস; দুর্গাদাস ভট্টাচার্য্য; পিকে গাঙ্গুলী; কেবি রায়চৌধুরী; ইঞ্জিনিয়ার পিকে হাওলাদার; গৌরগোপাল সাহা প্রমুখ। সুধাংশুদা বা সুরঞ্জিৎদা বা পঙ্কজ ভট্টাচার্য্য তো ছিলেনই। এরা তখন সবাই নিজ নিজ ভুবনে কীর্তিমান, বলিষ্ঠ ব্যক্তিত্ব এবং প্রথিতযশা।
১৯৯০-এ আমি আমেরিকা চলে আসি। সম্ভবত ৯১/৯২-এ দেবেশবাবু আমেরিকা আসেন। আমি নিউইয়র্কে থাকি এবং মেসো-মাসিমা ছোটপুত্র দীপেনের কাছে, অন্য স্টেটে। একদিন হঠাৎ মেসোর কল পেলাম। বললেন, ‘আমি নিউজার্সি এসেছি স্বল্পসময়ের জন্য, তোমার ওখানে যাব।’ ওই সময় সি আর দত্ত নিউইয়র্কে ছিলেন, মেসো বললেন, ‘তুমি কিন্তু জেনারেলকে জানাবে না, কারণ জেনারেল একটু দূরে থাকেন, আমার সময় হবে না, আর আমি নিউইয়র্ক গেছি কিন্তু ওনার ওখানে যাইনি শুনলে উনি খুব দুঃখ পাবেন।’ মেসো-মাসিমা আসবেন শুনে আমার স্ত্রীও খুশি, কারণ বিয়ের পর থেকেই ও এদের চেনে-জানে। মাসিমা জানলেন যে আমরা তিনতলায় থাকি, বললেন, ‘তোমার মেসো তো তিনতলায় উঠতে পারবে না।’ আমরা তখন আমাদের বাসার সঙ্গে এনি ফেরদৌসের বাসার নিচতলায় অতিথিদের বসার ব্যবস্থা করলাম। দীপেন বাবা-মাকে ড্রাইভ করে নিয়ে আসে। গাড়ি থেকে নেমে মেসো বলেন, ‘এতদূর থেকে এসেছি, তোমার বাসায় যাব না তা কি হয়?’ দীপেন ও আমি তখন মেসোকে ধরাধরি করে তিনতলায় উঠাই। (চলবে)
লেখক: প্রবাসী / সম্পাদনা: আশিক রহমান