টঙ্গীর টাম্পাকো কারখানায় আগুন ধ্বংস স্তুপের পাশে এখনো স্বজনেরা নিখোঁজের তালিকা বেড়ে ১১
সুজন কৈরী ও নাঈমুল হাসান, টঙ্গী প্রতিনিধি: টঙ্গী বিসিক শিল্পনগরীর টাম্পাকো ফয়েল কারখানায় অগ্নিকা-ের দশদিন আজ। ওই ঘটনায় ধ্বংসস্তূপে উদ্ধার তৎপরতা অব্যাহত রেখেছ সেনাবাহিনী ও ফায়ার সার্ভিস। গতকাল বিকেল পর্যন্ত আর কোনো লাশ উদ্ধার না হলেও নিখোঁজ শ্রমিকদের স্বজনরা এখনো ধ্বংসস্তূপের আশপাশে প্রতীক্ষার প্রহর গুনছেন। জীবিত না হোক অন্তত লাশটি পাওয়ার আশায় ধ্বংসস্তূপের পাশে অবস্থিত জেলা প্রশাসকের কন্ট্রোল রুমের সামনে বসে থাকতে দেখা যায় স্বজনদের।
গতকাল রোববার সকালে গিয়ে দেখা যায়, ভারী যন্ত্রপাতি ব্যবহার করে ধসে যাওয়া ভবনের জঞ্জাল-ড্রাম ট্রাক দিয়ে অন্যত্র সরিয়ে নেওয়া হচ্ছে। পুলিশ ও গাজীপুর সিটি করপোরেশন উদ্ধারকাজে সহযোগিতা করছে। সেনাবাহিনী ও ফায়ার সার্ভিসের কর্মীরা কারখানার মূল ফটকের পূর্ব পাশ থেকে ধ্বংস্তূপ সরানোর কাজ অব্যাহত রেখেছেন। একটু একটু করে তারা কালখানার ভেতরের দিকে এগোচ্ছেন। ভবনের ভেতরে থাকা ইথাইলের ড্রামগুলো ঝুঁকিপূর্ণ হওয়ায় সতর্ক হয়ে কাজ করছেন তারা। কারখানার আশপাশেই উদ্ধারকাজ শেষ হওয়ার অপেক্ষায় রয়েছেন নিখোঁজদের স্বজনরা। এখনো থামেনি তাদের চোখের পানি। শুধু আহাজারি করছেন তারা। ভবনের ভেতর আটকে পড়া শ্রমিকরা হয়তো বেঁচে আছেন ভেবে এখনো আশা ছাড়েননি তারা। দিনরাত খাওয়া-দাওয়া ছেড়ে কারখানার ধ্বংস্তূপের পাশে গিয়ে স্বজনের অপেক্ষায় বিলাপ করছেন অনেকে। কারখানা এলাকার পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে চারদিক ঘিরে রেখেছে পুলিশ সদস্যরা। ধ্বংস্তূপ এলাকায় জনসাধারণকে প্রবেশ করতে দেওয়া হচ্ছে না।
স্থানীয়রা বলেন, ধ্বংস্তূপ উদ্ধারকাজ শেষ হলে আরও অনেক শ্রমিকের লাশ বের হবে বলে মনে করেন তারা। কারখানার প্রিন্টিং অপারেটর মো. জহিরুল ইসলামের ভগ্নিপতি মো. আলাউদ্দিন মিয়া বলেন, ঘটনার পর থেকে কারখানার পাশে গিয়ে দাঁড়িয়ে থাকি। কিন্তু আমার স্বজনের লাশ এখনো পাইনি। ধ্বংস্তূপের পাশেই কন্ট্রোল রুম খুলেছে গাজীপুর জেলা প্রশাসক, পুলিশ ও সিটি কর্পোরেশন।
জেলা প্রশাসক কন্ট্রোল রুমে দায়িত্ব পালন করছিলেন নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট জান্নাতুল ফেরদৌস। তিনি বলেন, আমরা এখন পর্যন্ত ১১ জন শ্রমিক নিখোঁজের বিষয়ে তথ্য পেয়েছি।
ঘটনাস্থলে কথা হয় আইএসপিআর-এর সহকারী পরিচালক রেজাউল করিমের সঙ্গে। তিনি বলেন, সেনাবাহিনীর ১৪ স্বতন্ত্র ইঞ্জিনিয়ার ব্রিগেডের সদস্যরা উদ্ধার তৎপরতা অব্যাহত রেখেছেন। এখন পর্যন্ত ধ্বংস্তূপ থেকে ৩ হাজার ৬১৬ মেট্রিক টন বর্জ্য সড়ানো হয়েছে। এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, কারখানার ভেতরে এখনো কেমিক্যাল রয়েছে। আমাদের সদস্যরা কাজ করে যাচ্ছে। তবে কবে নাগাদ উদ্ধারকাজ শেষ হবে তা বলা যাচ্ছে না।
মালিকসহ দশ জনের বিরুদ্ধে মামলা: এ ঘটনায় গত শনিবার রাতে টঙ্গী মডেল থানায় টাম্পাকোর মালিকসহ দশ জনকে অভিযুক্ত করে একটি মামলা দায়ের করেছে পুলিশ। টঙ্গী থানার এসআই অজয় কুমার চক্রবর্তী বাদি হয়ে মামলাটি (নম্বর-২৩) দায়ের করেন। মামলার আসামিরা হলেন কারখানার মালিক- মকবুল হোসেন, তার স্ত্রী মোছা. পারভিন, মেয়ে আদিবা পারভিন, জামাতা শফি সামি, ছেলে তানভির হোসেন, কারখানার জেনারেল ম্যানেজার শফিকুর রহমান, এডমিন মনির হোসেন, ডেপুটি ম্যানেজিং ডিরেক্টর আলমগীর হোসেন, কারখানা ম্যানেজার সমির আহম্মেদ ও মো.হানিফ।
মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা এসআই মালেক খসরু জানান, মামলার আসামিদের গ্রেফতারে অভিযান চলছে।
এর আগে এ ঘটনায় নিহত শ্রমিক মো জুয়েলের বাবা আব্দুল কাদের পাটোয়ারী বাদী হয়ে টাম্পাকোর মালিকসহ আট জনের বিরুদ্ধে একই থানায় একটি মামলা দায়ের করেন। তিনি মামলায় উল্লেখ করেছেন, ঘটনার দিন সকালে জুয়েল টাম্পাকো কারখানার পাশ দিয়ে যাচ্ছিলেন। ওই সময় গ্যাস বা বয়লার বিষ্ফোরণে টাম্পাকো কারখানায় অগ্নিকা-ের ঘটনা ঘটে। এতে কারখানা ধ্বসে পরে। এতে চাপা পড়ে জুয়েলের মৃত্যু হয়। চার বছর আগে ওই কারখানাটি সিটি কর্পোরেশন কর্তৃক পরিত্যাক্ত ঘোষণা করার পরও কারখানাটি মালিক চালু রেখেছিলেন। এ কারণে জুয়েল নিহত হয়েছেন। এর বিচার চেয়ে তিনি মামলা করেছেন বলে এজাহারে উল্লেখ করেছেন।
শিগগির তদন্ত প্রতিবেদন দিবে তিতাস: টাম্পাকো কারখানায় অগ্নিকা-ের কারণ জানতে তিাতাসের পক্ষ থেকে তিন সদস্য বিশিষ্ট একটি কমিটি গঠন করা হয়েছে। সাতদিনের মধ্যে কমিটিকে তদন্ত প্রতিবেদন জমা দেওয়ার কথা বলা হয়েছে। তবে এর আগেই প্রতিবেদন জমা দেওয়ার কথা জানালেন কমিটির প্রধান তিতাস গ্যাসের ঢাকা মেট্রো উত্তরের মহা-ব্যবস্থাপক প্রকৌশলী রানা আকবর হায়দারী। তিনি বলেন, আমাদের তদন্ত চলছে। দুয়েক দিনের মধ্যেই আমরা তদন্ত প্রতিবেদন জমা দিবো। তদন্তে পাওয়া অগ্নিকা-ের কারনের বিষয়ে প্রশ্নটি এড়িয়ে যান এ কর্মকর্তা।
টাম্পাকোর মালিকসহ দায়ীদের শাস্তি দাবিতে মানববন্ধন: টাম্পাকো কারখানায় অগ্নিকা-ের জন্য মালিকসহ দায়ী ব্যক্তিদের বিচারসহ দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির দাবি জানিয়েছে বাংলাদেশ শ্রমিক ফেডারেশনসহ সমমনা ৭টি সংগঠন। গতকাল জাতীয় প্রেসক্লাবের সামনে আয়োজিত এক মানবন্ধন ও শোক র্যালি থেকে এ দাবি জানানো হয়। মানবন্ধনে জাতীয় গার্মেন্টস শ্রমিক ফেডারেশনের সভাপতি আমিরুল হক আমিন সংগঠনের পক্ষ থেকে কয়েকটি দাবি উপস্থাপন করেন। দাবিগুলোর মধ্যে রয়েছে- অগ্নিকা-ে নিহত, আহত, নিখোঁজ এবং ক্ষতিগ্রস্থ শ্রমিকদের সঠিক ও পূর্ণাঙ্গ তালিকা প্রকাশ করা, আহত শ্রমিকদের দ্রুত প্রয়োজনীয় উন্নত চিকিৎসার ব্যবস্থা করা। সেই সঙ্গে হতাহতদের শ্রম আইনে নয়; আইএলও কনভেনশন অনুযায়ী ক্ষতিপূরণের দাবি জানিয়েছে সংগঠনটি।
উল্লেখ্য, গত ১০ সেপ্টেম্বর সকালে টঙ্গীর বিসিক নগরির সাবেক সাংসদ মকবুল হোসেনের মালিকানাধীন টাম্পাকো ফয়েলস লিমিটেড কারখানায় অগ্নিকা-ের ঘটনা ঘটে। এতে ভবন ধসে পড়ে। এ ঘটনায় এখন পর্যন্ত ৩৪ জনের লাশ উদ্ধার করা হয়েছে। আহত উদ্ধার করা হয়েছে ৩৫ এদিকে নিখোঁজ শ্রমিকের সংখ্যা ১০ থেকে ১১ জনে বৃদ্ধি পেয়েছে। এছাড়া টাম্পাকোর মালিকসহ দশ জনের নাম উল্লেখ করে পুলিশ বাদি হয়ে আরও একটি মামলা করা হয়েছে। সম্পাদনা আজাদ হোসেন সুমন