কাশ্মীরে রক্তপাত কার জন্য জরুরি?
মোহসীন আব্বাস: কাশ্মীর। মোগল বাদশাহ হুমায়ুন কাশ্মীরে যাওয়ার পর মুগ্ধ হয়েছিলেন। কবি হুমায়ুন লিখেছিলেন, দুনিয়াতে কোথাও যদি স্বর্গ থাকে তবে এই খানে, এই খানে, এই খানে! কাশ্মীর উপত্যকায় রক্তপাত বহুকাল থেকে, ইতিহাসের পাতাভরা এখানকার রক্তপাতের বর্ণনায়। সম্প্রতিক রক্তপাতের ধারাও কম বয়সের নয়। ১৯৪৭ সালে ভারত ভাগের পর থেকে শুরু, আর থামেনি। কখনো যুদ্ধের ভয়াবহ রূপে, কখনো সশস্ত্র সংঘাতে প্রাণহানি হয়েছে, অব্যাহতভাবে হচ্ছে।
বর্তমানের কাশ্মীর দুভাগে বিভক্ত। আজাদ কাশ্মীর এবং জম্মু ও কাশ্মীর। আজাদ কাশ্মীর আন্তর্জাতিক মহলের কাছে পাকিস্তান নিয়ন্ত্রিত কাশ্মীর বলে পরিচিত। আর বাকীটা ভারত নিয়ন্ত্রিত। পাকিস্তানের দাবিÑ আজাদ কাশ্মীর স্বাধীন দেশ। যদিও একটি সার্বভৌম রাষ্ট্রের কোনো চিহ্নই এখানে নেই। আর জম্মু ও কাশ্মীর ভারতের দাবি অনুযায়ী তাদের রাজ্য। এ দাবিটা একেবারে অমূলক নয়। জম্মু নিয়ে কোনো বিতর্ক নেই। যত বিতর্ক কাশ্মীরের শ্রীনগর উপত্যকা নিয়ে। এ ভূখ-ের মানুষ তাদের আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকার নিয়ে মত প্রকাশের সুযোগই পায়নি। এমন একটি ব্যবস্থার কথা থাকলেও, সামরিক বুটের তলে তা হারিয়েছে ভারত ভাগের পরের বছরই। একটু পেছেনের দিকে তাকালে দেখা যায় যে, ভারত ভাগের প্রাক্কালে কথাছিল কাশ্মীরের জনগণ তাদের অবস্থান জানাবে একটা গণভোটের মাধ্যমে। তখন কাশ্মীর শাসন করেন একজন হিন্দু ধর্মাবলম্বী রাজা; সংখ্যাগরিষ্ঠ প্রজা ইসলাম ধর্মের অনুসারী। নিয়োগ দেওয়া হলো মুসলিম প্রধানমন্ত্রী। এর পর, প্রথমে পাকিস্তান দখলে নামে, পরে ভরত সৈন্য পাঠায়। দুপক্ষের সৈন্যরা যেখানে মুখোমুখি হয় সেই বরাবর তৈরি হয় সীমান্তরেখা। বিতর্ক রয়েছে বলে এ রেখাকে সীমান্ত না বলে বলা হয় নিয়ন্ত্রণ রেখা।
তারপর পার হয়েছে প্রায় সাত দশক। এ ভূখ-ে আর শান্তি আসেনি। ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে এ উপত্যকায় চলছে এক নীরব যুদ্ধাবস্থা। আর ধীরে ধীরে এ সংঘাত চলে যায় আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক প্রতিযোগিতা ও কূটনৈতিক কৌশলের বেড়াজালে।
এখন কেবল ভারত ও পাকিস্তান নয়, চীন, ইরান, যুক্তরাষ্ট্র, রাশিয়া, ইউরোপের নানা দেশসহ পৃথিবীর বিভিন্ন দেশ তাদর কূটনৈতিক ্ও সমরনৈতিক কৌশল নির্ধারণ করে কাশ্মীরের সংঘাত ও পরিস্থিতি সামনে রেখে। এখানে এখন কেবল আর ভারত ও পাকিস্তানের গোয়েন্দাদের তৎপরতা চলে না। চলে পরাশক্তিগুলোর তৎপরতাও।
উদীয়মান বিশ্বশক্তি ভারত। দক্ষিণ এশিয়ার বিবেচনায় সবচেয়ে বড় অর্থনৈতিক ও সামরিক শক্তি। ভারত মহাসাগরে দাপট বাড়ছে দিন দিন। ইরান-ভারত-আফগানিস্তান সম্পর্ক এবং ইরানের বন্দর ও অবকাঠমোতে ভারতের বিনিয়োগ আন্তর্জাতিক মুরুব্বিদের মাথাব্যথার কারণ। ইরান-ভারত বন্ধুত্বের বিপরীতে চীন-পাকিস্তান বন্ধুত্ব পশ্চিমের জন্য চিন্তার কথা। আন্দামান-নিকোবর পর্যন্ত ভৌগোলিক বিস্তৃতি মহাসাগরে ভারতকে কৌশলগত সুবিধা দিয়েছে, সামরিক ও বাণিজ্যিক উভয় ক্ষেত্রেই সুবিধা দিয়েছে। ইরানের বন্দরে ভারতের উপস্থিতি পারস্য উপসাগরে ভারতের অধিগম্যতাকে বাড়িয়ে দিয়েছে। ইরান ও আফগানিস্তানের সঙ্গে মিত্রতা মধ্য এশশিয়ায় অধিগম্যতা বাড়িয়েছে।
পক্ষান্তরে চীন এখন আর পীত সাগর, দক্ষিণ চীন সাগর এবং জাপানের পার্শ্ববর্তী প্রশান্ত মহাসাগর নিয়ে সন্তুষ্ট থাকতে চায় না, পারছে না। তার বুভুক্ষু অর্থনীতি আরও বাজার চায়। আর নতুন বাজারগুলোতে অধিগম্যতার জন্য ভারত মহাসাগরে উপস্থিতি চীনের জন্য জরুরি। এ প্রেক্ষাপটে চীনের কাছে জরুরি দেশ মিয়ানমার ও পাকিস্তান। এ দুটো দেশ দিয়ে বঙ্গোপসাগর ও আরব সাগরে উপস্থিতি নিশ্চিত করতে পারে চীন। এ ক্ষেত্রে পাকিস্তানের প্রতি অবশ্যই চীনের পক্ষপাত ও আগ্রহ বেশি। বেলুচিস্তানের বন্দরে উপস্থিতি নিশ্চিত করতে না পারলে পারস্য উপসাগরে নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা অসম্ভব। চীন-পাকিস্তান অবকাঠামোগত সম্পর্কের জন্যও কাশ্মীর জরুরি ভূখ-। ফলে ভারত মহাসাগরে প্রাধান্য বিস্তার ও উপস্থিতির প্রতিযোগিতার কেন্দ্র থেকে সরছে না কাশ্মীর। আর এ করণেই পশ্চিমের অর্থনৈতিক ও সামরিক শক্তির কাছেও কাশ্মীর একটা বিশেষ ইস্যু।
এ বিষয়টি অনুধাবন করতে হলে বুঝার চেষ্টা করতে হবে চীন-ভারত, চীন-পাকিস্তান, রুশ-ভারত, রুশ-চীন, যুক্তরাষ্ট্র-ভারত, যুক্তরাষ্ট্র-পাকিস্তান এবং অন্য ইউরোপীয় ও এশীয় দেশের সঙ্গে ভারতের সম্পর্ককে। এ সম্পর্ক অর্থনৈতিক, কূটনৈতিক এবং সামরিক।
ভারতের ক্রমবর্ধমান অর্থনীতি, বিকাশমান বিজ্ঞান-প্রযুক্তি এবং সামরিক সক্ষমতা দেশটিকে নিয়ে গেছে আঞ্চলিক পরিম-লের বাইরে। বড় অর্থনীতি ও সামরিক শক্তির দেশগুলোর সঙ্গে এখন ভারতের সম্পর্ক অম্ল-মধুর। কূটনীতি এখন প্রয়োজনতাড়িত (নেসেসিটি ড্রিভন)। কেউ ভারতের সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করতে চায় না, এমনকি ঘনিষ্ঠ প্রতিদ্বন্দ্বী চীনও নয়। আবার প্রতিযোগিতার কথা ভুলে কেবল মিত্রতাও চায় না কেউ। এমন জটিল কূটনীতির মধ্যে পাকিস্তান, চীন এবং পশ্চিমা শক্তিগুলোর উঠান হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে। আর কাশ্মীর হলো ভারতকে চাপে ফেলার জন্য সকল প্রতিযোগী দেশের কাছে একটা চাপযন্ত্র (লিভারেজ)। পাকিস্তানের উঠান কাশ্মীর ইস্যু জিইয়ে রাখার জন্য ব্যবহৃত হতেই পারে।
পাকিস্তান এ খানে কেবলই মাঠ। তাদের সুস্পষ্ট কূটনৈতিক অবস্থান ৭০ বছরেও ঠিক হয়নি। তবে এবার ভারতকে শিক্ষা দেওয়ার জন্য বেলুচিস্তানের ভেতর দিয়ে চীনকে আরব সাগরে টেনে আনছে পাকিস্তান। পাকিস্তানে চীনা বিনিয়োগের উদ্যোগ অস্থির করে তুলেছে বেলুচিস্তানের জনগণকে, ইরান-আফগানিস্তান-ভারতের নীতি নির্ধারকদের এবং পশ্চিমা স্বার্থকে। এ টানাপড়েনে তেঁতে উঠছে বেলুচিস্তানের মাটি। বালুচ মরুর তাপ কমাতে শীতল কাশ্মীর উপত্যকায় রক্তপাততো জরুরি হতেই পারে। সম্পাদনা : পরাগ মাঝি