আমি দেবতা দেখিনি, জাস্টিস ভট্টাচার্য্যকে দেখেছি
সীতাংশু গুহ
আমেরিকায় আমি তখন নতুন। বরুকলিনে এক বেডরুমের ভাঙাচোরা ফ্ল্যাট। কিন্তু সেদিন মেসো-মাসিমা ও আমরা সবাই এতটাই খুশি হয়েছিলাম যা বলাবাহুল্য। মাসিমা দীপেনের জন্য একটি মেয়ে দেখার জন্য আমার গিন্নিকে বলল। ওনারা ৩/৪ ঘণ্টা ছিলেন, কিন্তু ওইটুকু সময় ছিল খুবই আনন্দঘন। আমার কাছে তো বটেই, কারণ মেসো-মাসিমা শুধু আমাকে দেখার জন্য এতটা দূর এসেছিলেন, তা তো পরম সৌভাগ্যের। একবার কি এক আইনি প্রয়োজনে আমি আমাদের এক সহকর্মী নাহিদকে নিয়ে মেসোর বাসায় যাই। আমার কাছে সবকিছু শুনে মাসিমা একবারে মেয়ের মতো নাহিদকে আদর করতে শুরু করেন। পরে নাহিদ বলেছিল, ওনারা খুবই ভালো। আসলেই মাসিমা-মেসোর তুলনা শুধু ওনারাই। ওনারা ছিলেন সর্বজন শ্রদ্ধেয়। তবে এবার একটি ঘটনার কথা বলব, যাতে আমরা বিব্রত হয়েছি, মেসোকে অসহায় দেখেছি। উশৃঙ্খল যুবকদের বিরত রাখতে ঢাকেশ্বরী মেলাঙ্গনে সেদিন স্বপন সাহা, দিপু সেন, আমি ও অন্যদের যথেষ্ট বেগ পেতে হয়েছিল। ঘটনাটা এরকমÑ
হুসেইন মুহাম্মদ এরশাদ তখন সিএমএলএ। দুর্গাপূজা এসে গেছে। বঙ্গভবন থেকে বার্তা এলো, এরশাদ পূজায় আসবেন। মহানগর পূজা কমিটির সবাই এরশাদ বিরোধী, তাকে নিমন্ত্রণ পর্যন্ত করা হয়নি। কিন্তু, সিএমএলএ আসবেন, তাকে আনুষ্ঠানিক নিমন্ত্রণ জানাতে হবে, এমনটাই নির্দেশ। আগেকার দিনে রাজা-বাদশাহরা কোথাও গেলে কোনো মেয়েকে দেখে ‘সুন্দরী’ প্রশংসা করার অর্থই ছিল মেয়েটিকে তাকে দিতে হবে। এরশাদ আসবেন, এর মানেই হলো তাকে নিমন্ত্রণ জানাতে হবে, তা আমরা না চাইলেও। মহানগর পূজা কমিটি সিদ্ধান্ত নিল দেবেশবাবুর নেতৃত্বে একটি প্রতিনিধিদল যাবেন বঙ্গভবনে। হিন্দুদের স্বার্থে দেবেশবাবু রাজি হলেন এবং নিমন্ত্রণ করলেন। সম্ভবত এ সংবাদ টিভিতে আসে এভাবে যে, হিন্দুরা সানন্দে এরশাদকে পূজায় নিমন্ত্রণ করতে দৌড়ে বঙ্গভবন ছুটে গেছেন। মানুষ বিরক্ত হয়, ছাত্ররা ক্ষেপে যায় এবং সবার রাগটা গিয়ে পরে দেবেশবাবুর ওপর। এরই বহিঃপ্রকাশ ঘটে ঢাকেশ্বরী মেলাঙ্গনে। কিছু হৈ-হল্লা হয়, উল্টাপাল্টা কথাবার্তা, ছুটাছুটি, গালিগালাজ হয় এবং দেবেশবাবুকে অসহায়ের মতো তা শুনতে হয়। যারা এটা করে তারা সবাই ছিল তরুণ এবং কমিটির সিদ্ধান্ত জানত না। পরে অনেকের সঙ্গেই আমাদের কথা হয়েছে, অনেকেই অনুতপ্ত হয়েছে।
দেবেশ ভট্টাচার্য্য ছিলেন উদার। আমার ধারণা, রাজনৈতিকভাবেও তিনি ছিলেন উদারপন্থি। তখন হিন্দু নারীদের বাপের সম্পত্তির অধিকার দেওয়ার ওপর বেশ কথাবার্তা হচ্ছিল। দেবেশবাবু একবাক্যে এর পক্ষে ছিলেন। মোটামুটি আমাদের সবাই এর পক্ষে ছিল। কিন্তু একটু সমস্যা ছিল। হিন্দুরা একসঙ্গে রাজত্ব ও রাজকন্যা হারাতে রাজি ছিল না, এখনও রাজি নয়। বছর দুই-তিন আগে রাখিদাশ পুরকায়স্তু এসেছিলেন, তিনিও একই ইস্যু নিয়ে কথা বলেন। সবাই রাজি, কিন্তু একটু সমস্যা। রাখীদিকে যা বোঝানো হয়েছে, আশির দশকে আমরা তাই দেবেশবাবুকে বোঝাতে চেষ্টা করেছিলাম। সেটা হলোÑ এমনিতে বাংলাদেশে হিন্দু মেয়েদের নিরাপত্তা কম, প্রায়শ অপহরণ ও জোর করে বিয়ে ও ধর্মান্তরিত হচ্ছে, হিন্দুরা মেয়ে হারাচ্ছে, বিশেষত গ্রামে-গঞ্জে এর প্রকোপ বেশি। হিন্দু মেয়েদের বাপের সম্পত্তির ওপর অধিকার দিলে কন্যার সঙ্গে সঙ্গে সম্পত্তিও যাবে। আর আমদের ভাইয়েরা যখন দখল করে, তখন একাংশের নামে পুরোটাই দখল করে নেবে! সুতরাং হিন্দু মেয়েদের বাপের সম্পত্তির ওপর অধিকার দেওয়া যেতে পারে, কিন্তু শর্ত থাকবে যে, অন্য ধর্মে বিয়ে হলে বা ধর্মান্তরিত হলে ওই মেয়ে বাপের সম্পত্তির ওপর অধিকার হারাবে। দেবেশবাবু আমাদের যুক্তিতে রাজি হয়েছিলেন কিনা জানি না, কিন্তু ওটাই ছিল জনমত এবং এখনও তাই আছে।
নব্বই দশকের শেষের দিকে ঢাকা গেলে আমি মেসোকে দেখতে রানিকন স্ট্রিটের বাসায় যাই, তখন তিনি বেশ অসুস্থ। মাসিমা অনেক আদর-যতœ করলেন। দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য্য তখন ওই বাড়িতে, রাশিয়া ফেরত। দীপেনের সঙ্গেও অনেকদিন যোগাযোগ হারিয়ে যায়। কিন্তু আমি একবার লস এঞ্জেলস গেলে দীপেন ভট্টাচার্য্য ও সুধাংশুদার ছেলে শান্তু অনেক দূর থেকে এসে দেখা করেছিলেন। সুধাংশুদার ফ্যামিলির সঙ্গে দেবেশবাবুদের একটি ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক ছিল, সাধনা বৌদি ও চিত্রা মাসিমাকে একসঙ্গে অনেক দেখেছি। পরে এরা দুজনই সংসদ সদস্য হয়েছিলেন। আমি মাঝে মাঝে ভাবি, দেবেশবাবু কেন প্রধান বিচারপতি হননি? ঠিক জানি না, হিন্দু বলেই হয়তো। তদুপরি বঙ্গবন্ধু হত্যার পর ওই সময়টা তো অনুকূল ছিল না। তারপরও কথা থাকে! একে গাঙ্গুলী দীর্ঘদিন বাংলাদেশ ব্যাংকের ডেপুটি গভর্নর থাকতে থাকতে, গভর্নর না হয়ে শেষপর্যন্ত ওয়ার্ল্ড ব্যাংকে চাকরি নিয়ে দেশ ছাড়েন। দেবেশবাবু ধর্মীয় বৈষম্য কতটা ফেস করেছেন জানি না, করলেও তিনি কাউকে বলার নন, তবে তিনি দেশ ছাড়েননি, আমাদের সবাইকে ছেড়ে একবারে দুনিয়া থেকে চলে গেছেন। শুনলাম তার একশ বছর জন্মজয়ন্তী পালিত হবে, একটি ম্যাগাজিন বের হবে, সম্পাদক জীবন রায় আমেরিকা এসেছেন, বললেন একটি লেখা দিতে, তাই আমার এ প্রয়াস। মেসো জাস্টিস ভট্টাচার্য্যরে প্রতি এটা আমার শ্রদ্ধাঞ্জলি। (শেষ)
লেখক: প্রবাসী / সম্পাদনা: আশিক রহমান