নির্বাচন বলে এখন কিছু নেই, গণতন্ত্র নির্বাসিত হয়ে গেছে
সাক্ষাৎকার নিয়েছেন আশিক রহমান
বর্তমান সরকারের শাসনকাল ভালো যাচ্ছে তা বলা যাবে না, বরং তাদের পারফরমেন্স খুবই খারাপ। গণিতের হিসাবে, আমরা মধ্যম আয়ের দেশে পরিণত হয়েছি। হ্যাঁ, কিছুসংখ্যক মানুষ ধনী হয়েছে। কিন্তু সাধারণ মানুষের সে অর্থে উন্নতি হয়নি। সমাজে বৈষম্য বেড়েছে। জাতীয় আয়ের যে হিসাব করা হয়, সেটা গড় হিসাব। গড় হিসাবে আমরা উপরে উঠেছি, সমাজের সবাইকে নিয়ে এখনো আমরা উপরে উঠতে পারিনিÑ দৈনিক আমাদের অর্থনীতিকে দেওয়া বিশেষ সাক্ষাৎকারে এমন মন্তব্য করেন সিপিবির সভাপতিম-লীর সদস্য হায়দার আকবর খান রনো।
তিনি বলেন, একজন পোশাকশ্রমিক, আন্তর্জাতিক মান অনুযায়ী ন্যূনতম যে শ্রমমূল্য পাওয়ার কথা তার চেয়েও তারা কম পায়। প্রতিদিন দুই ডলার হচ্ছে ন্যূনতম পারিশ্রমিক। তার নিচে যারা পায়, তাদের দরিদ্র বলা হয়। পোশাকশ্রমিকদের বেশিরভাগই কম শ্রমমূল্য পায়। অপরদিকে কিছু মানুষ বিশাল অংকের অর্থ সুইচ ব্যাংকে জমা রেখেছে। সুইচ ব্যাংক এ বিষয়ে একটি হিসাব দিয়েছে কত টাকা বাংলাদেশিদের জমা রয়েছে সেখানে। কার কার টাকা ওখানে জমা, তা অবশ্য বলেনি, তাদের নাম প্রকাশ করেনি। কিছু লোক আঙ্গুল ফুলে কলাগাছ হচ্ছে, বটগাছও হচ্ছে। এমনটি হচ্ছে কারণ, আমরা এখানে একটি নিকৃষ্টতম পুঁজিবাদী পথে অগ্রসর হচ্ছি। তিনি আরও বলেন, এখানে সমাজতন্ত্রও কায়েম হচ্ছে না, বরং উল্টো দিকে যাচ্ছে। তা যেন ভুলেই বসে আছে সবাই। সমাজতন্ত্রের কথা বলেও না কেউ এখন। বঙ্গবন্ধুর বক্তৃতা শোনাতে পারি, তিনি সমাজতন্ত্রের পক্ষে কিভাবে কথা বলেছেন? খুব জোরালভাবে সমাজতন্ত্র নিয়ে কথা বলেছেন। আজকে তার কন্যা তা যেন ভুলেই গেছেন।
সমাজতন্ত্র নিয়ে শেখ হাসিনা তার বাবার বিপরীতমুখী অবস্থান কেন নিয়েছেন? এমন প্রশ্নের জবাবে হায়দার আকবর খান রনো বলেন, এটা কেন হয়েছে তা আমি কি করে বলব? তিনি পুঁজিবাদী পথে বিশ্বাসী বলেই হয়তো তার এমন অবস্থান। তার দল, বল সবই হয়তো এই জায়গায় অবস্থান করছে। তবে সেই পুঁজিবাদী পথও যদি স্বাভাবিক হতো তাহলে এখনকার চেয়ে সেটাই ভালো হতো। কিন্তু এখন যা হচ্ছে, তা লুটেরা পুঁজিবাদ।
বর্ষীয়ান এই রাজনীতিবিদ আরও বলেন, গণতন্ত্র মানে নির্বাচন। নির্বাচন মানে, আগের রাতে সিল মারা। কর্মী-সমর্থকেরা সিল মারবে, প্রিজাইডিং অফিসার সিল মারবে। নির্বাচন করতে গেলে টাকা লাগে। সেই টাকা জনগণের জন্য খরচ করা হতো আগে, এখন তাও করতে হয় না। কারণ নির্বাচন বলে এখন কিছু নেই, গণতন্ত্র নির্বাসিত হয়ে গেছে। দলীয় মনোনয়ন পাওয়ার জন্যও টাকা দিতে হয়। সেই অর্থে অর্থনৈতিক উন্নতি নেই। এখানে কিছু লোকের উন্নতি হয়েছে। আওয়ামী লীগের লোকজন মানুষের জমিজমা, নদী-নালা সব দখল করছে। আমাদের এত উন্নতি, আমরা মধ্য আয়ের দেশে পরিণত হচ্ছি, অথচ গত বছর প্রতিবেদন হয়েছে, একলাখ শ্রমিক শ্রমের আকাক্সক্ষায় সমুদ্রে ভাসছে। তাদের পরিণতি হয়েছে, থাইল্যান্ডের জঙ্গলে বাস। না খেয়ে মরতে হচ্ছে। দেশ মধ্য আয়ের দিকে যাচ্ছে, কিন্তু দেশের লোক সমুদ্রে ভাসছে!
সুন্দরবনের কাছে রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্রের যৌক্তিকতা নিয়ে প্রশ্ন তোলে তিনি বলেন, রামপাল নিয়ে হচ্ছেটা কী? আমাদের যদি কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র করতেই হয়, তাহলে তা রামপালে না করে একটু দূরে সরিয়ে করলে অসুবিধাটা কী? ২০ মাইল উত্তরে নিয়ে আসলে ক্ষতিটা কোথায়? পরিবহন খরচ কিছুটা বাড়ে, তাই তো? প্রশ্ন হচ্ছে, পরিবহন খরচটাই কি আমাদের কাছে গুরুত্বপূর্ণ, নাকি ঐতিহ্যের সুন্দরবন গুরুত্বপূর্ণ? প্রাকৃতিক সৌন্দর্য্যরে কথা বাদ দিলাম, নানাদিক থেকে অত্যন্ত উপকারী আমাদের সুন্দরবন। সবকিছুর ঊর্ধ্বে উঠে এটাকে আমাদের রক্ষা করা উচিত।
রামপাল বিষয়ে কি প্রধানমন্ত্রীকে কেউ ভুল বোঝাচ্ছেন? এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, তা আমি কি করে বলব? ভুল যদি তাকে বোঝানো হয়ে থাকে সে দোষ তো তারই। তিনি ভুল বুঝবেন কেন? তার ভালো পরামর্শক থাকতে হবে। আমি যদি মন্দ পরামর্শক বাছাই করি, সেটা তো আমার দোষ। দায়দায়িত্ব আমার উপরই বর্তাবে।
অপর এক প্রশ্নের জবাবে সিপিবির সভাপতিম-লীর এই সদস্য আরও বলেন, প্রধানমন্ত্রীর ভালো আকাক্সক্ষা থাকতে পারে। হয়তো আছেও। আমি তার কতগুলো বিষয়ে খুবই প্রশংসা করি। আন্তর্জাতিক মহল থেকে আসা শত চাপকে উপেক্ষা করে একাত্তরের ঘাতকদের বিচার করছেন তিনি। শাস্তিও নিশ্চিত করছেন। এটা সহজ বিষয় নয়। ৫০ লাখ হতদরিদ্র মানুষকে ১০ টাকা কেজি চাল দেওয়ার উদ্যোগটি কী প্রশংসাযোগ্য নয়? নিশ্চয়ই। বিভিন্ন কাজে তার দরদী মনের পরিচয় পাওয়া যায়। কিন্তু এসব যথেষ্ট নয়। আমাদের সিস্টেম পরিবর্তন করতে হবে। এখানে ৫০ লাখ হতদরিদ্র মানুষ থাকবেইবা কেন? এ বিষয়ে অনেক বেশি কাজ করতে হবে আমাদের।
আওয়ামী লীগ ও বিএনপির শাসনামলের তুলনামূলক পার্থক্য করতে যদি বলি কিভাবে করবেন? এ বিষয়ে তিনি বলেন, দুই দলের মধ্যে পার্থক্য খুবই সামান্য। শেখ হাসিনা ও খালেদা জিয়ার কোনো আমলেই গণতন্ত্র ছিল না, গরিবমুখী অর্থনীতি ছিল না, সবই পুঁজিবাদী অর্থনীতি। নিকৃষ্ট ধরনের পুঁজিবাদী অর্থনীতি। এই সরকারের একটা বড় দিক হচ্ছে, যুদ্ধাপরাধীদের বিচার। এ বিষয়ে শেখ হাসিনা দৃঢ় মনোভাব দেখাতে পেরেছেন। আমি তাকে প্রকাশ্যে বহুবার সাধুবাদ জানিয়েছি। এখনো জানাচ্ছি। অপরদিকে বিএনপি কি করছে? বিএনপি যুদ্ধাপরাধীদের সঙ্গে জোট করে, হেফাজতকেও সমর্থন দেয়। আবার সেই হেফাজতকে আওয়ামী লীগ ব্যবহার করে।
বিএনপি কি রাজনৈতিক দল হিসেবে ব্যর্থ? জানতে চাইলে হায়দার আকবর খান রনো বলেন, বিএনপির জন্ম ক্যান্টনমেন্ট থেকে, এটা সত্য। তবে এরশাদের নয় বছরে বিএনপির পুনর্জন্ম হয়েছে। রাজপথের ধুলোবালি মেখেই তারা আজকে এখানে এসেছে। একটি রাজনৈতিক দলে পরিণত হয়েছে। সে কারণেই জনগণ দ্বারা দুইবার নির্বাচিতও হয়েছিল। বিএনপি মতাদর্শগতভাবে ক্রমাগত মৌলবাদীদের কাছে স্যারেন্ডার করছে, জামায়াতের কাছে স্যারেন্ডার করছে। এই বিএনপির কাছে মানুষ কেন জড়ো হবে, কেন তাদের পাশে দাঁড়াবে? তাদের সমর্থন আছে, ভোট হলে ভোটও পাবে, হয়তো জয়ীও হতে পারে। কিন্তু জনপ্রত্যাশা মেটাতে না পারলে তো মানুষ রাস্তায় নামবে না, এটাই তো স্বাভাবিক।
দেশের এই পরিস্থিতির জন্য কি শুধু সরকারই দায়ী? হায়দার আকবর খান রনো বলেন, গণতন্ত্র ও দেশের বর্তমান পরিস্থিতির জন্য সরকারই দায়ী। দোষ করবে একজন, আপনি আরেকজনকে দায়ী করবেন কেন? বিএনপির আমলে অপারেশন ক্লিনহার্ট করে মানুষ মারল। সংসদের বিল পাস করল, যারা খুন করল, তাদের দায়মুক্তি দিয়েছিল সেসময়ের সরকার। এই দায়িত্ব কি আমি নেব? সেই দায়িত্ব বিএনপিকেই নিতে হবে। আজকে গণতন্ত্রের যে বারোটা বাজছে তার দায়িত্ব কি আমি নেব? একজনের দায় আরেকজনের ঘাড়ে চাপাচ্ছেন কেন? যার যার দায় তা তাকেই নিতে হবে বলেও মনে করেন এই বর্ষীয়ান রাজনীতিবিদ।