শব্দ দূষণ
জীবন আছে পৃথিবীর এমন সকল প্রাণীর নিজের দেহ ও মন সতেজ রাখার জন্য প্রতিদিন বিশ্রামের প্রয়োজন রয়েছে। অধিকাংশ প্রাণী বিশ্রামের সময় নিদ্রায় আচ্ছন্ন হয়ে পড়ে। বুদ্ধি ও বিবেকের কারণে মানুষ অপরাপর প্রাণী হতে পৃথক। প্রতিটি মানুষের স্বাস্থ্য সুরক্ষার জন্য নিদ্রার প্রয়োজন। আর এ নিদ্রা অবশ্যই সুনিদ্রা হওয়া কাম্য। মানুষ সাধারণত দিনের বেলা পরিশ্রমের পর রাতে নিজ গৃহে নিদ্রায় মগ্ন হয়। যেকোনো কারণে একজন মানুষের নিদ্রায় ব্যাঘাত ঘটলে তার দেহ ও মনের উপর এর বিরূপ প্রভাব পড়ে। নিদ্রার ব্যাঘাতের ক্ষেত্রে শব্দ প্রধান কারণ। এ শব্দ যখন মাত্রাতিরিক্ত হয় তখন এটিকে বলা হয় শব্দ দূষণ। শব্দ পরিমাপের একককে বলা হয় ডেসিবল। বিভিন্ন উৎস হতে উৎপন্ন শব্দের সহনীয় মাত্রা পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে শব্দ দূষণ নিয়ন্ত্রণ আইন দ্বারা নির্ধারিত। আমাদের দেশে অদ্যাবধি এ ধরনের আইন প্রণীত না হলেও শব্দ দূষণ নিয়ন্ত্রণে মূলদ- আইন দ-বিধি ও মেট্রোপলিটন শহরের ক্ষেত্রে মেট্রোপলিটন পুলিশ আইন ভূমিকা রেখে চলেছে।
দেশে যে সকল উৎস শব্দ দূষণের মূল কারণ তা হলোÑ বিভিন্ন ধরনের যান্ত্রিক যানের শব্দ ও হর্ন, নির্ধারিত স্থান ও সময় ব্যতিরেকে মাইকে গানবাজনা, বক্তৃতা-বিবৃতি প্রভৃতি প্রচার, বিভিন্ন আবাসিক এলাকায় বিভিন্ন ধরনের সামাজিক অনুষ্ঠানে বাদ্যযন্ত্রের সংমিশ্রণে উচ্চস্বরে সাংস্কৃতিক পরিবেশনা, দালান ও অবকাঠামো নির্মাণকালীন ব্যবহৃত যন্ত্রের শব্দ এবং কলকারখানায় ব্যবহৃত যন্ত্রের শব্দ।
বিমান উড্ডয়ন ও অবতরণের সময় মাত্রাতিরিক্ত শব্দ হয়। এ কারণে শহরে বসবাসরত মানুষজনের স্বাভাবিক জীবনযাপনে যেন ব্যাঘাত না ঘটে সেটিকে বিবেচনায় নিয়ে অধিকাংশ দেশ বিমানবন্দরসমূহ শহরাঞ্চলের বাইরে জনবসতি কম এমন লোকালয়ে স্থাপন করে থাকে। পৃথিবীর প্রতিটি দেশেই যানবাহনের সংখ্যা ক্রমবর্ধমান। যানবাহন হতে দুই ধরনের শব্দ নিঃসরিত হয়। এর একটি যানবাহন চলাচলজনিত এবং অপরটি যানবাহনের হর্ন বাজানোজনিত। অধূনা বিভিন্ন যানবাহন প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠান উচ্চ প্রযুক্তির যানবাহন নির্মাণপূর্বক যানবাহন চালনাজনিত শব্দ আগেকার চেয়ে কমিয়ে আনতে সামর্থ হয়েছে। প্রতিটি যানবাহনে হর্ন থাকলেও পৃথিবীর অধিকাংশ উন্নত দেশে নেহাত প্রয়াজন ব্যতীত হর্ন বাজানো নিষিদ্ধ এবং অপরাধ হিসেবে গণ্য। দেশে যানবাহনের হর্ন নিয়ন্ত্রণহীনভাবে বাজানোর কারণে তা প্রায়শই জনমানুষের জন্য অস্বস্তিদায়ক। তাছাড়া দেশের যানবাহনে উচ্চশব্দ বিশিষ্ট হাইড্রোলিক হর্নের ব্যবহার নিষিদ্ধ হলেও এখনও তা আইনের প্রয়োগের শিথিলতায় জনউপদ্রব হিসেবে বড় ধরনের যানবাহন বিশেষত বাস ও ট্রাক হতে বেজে ওঠে।
পৃথিবীর উন্নত দেশসমূহে উন্মুক্ত স্থানে সভা, সমাবেশ বা সঙ্গীতানুষ্ঠানে ব্যবহৃত মাইকের শব্দ সর্বোচ্চ কত ডেসিবল পর্যন্ত হবে এবং তা কত সময় অবধি চলতে পারবে আইন ও বিধি দ্বারা নির্ধারিত। আমাদের দেশে এ ধরনের সুনির্দিষ্ট আইনের অনুপস্থিতিতে উন্মুক্ত স্থানে সভা, সমাবেশ বা সঙ্গীতানুষ্ঠানে মাইক ব্যবহারে শব্দ নিয়ন্ত্রণের কোনো বালাই নেই। তাছাড়া দুটি প্রধান ধর্মীয় গোষ্ঠীর কিছু কিছু অনুষ্ঠানে দেখা যায়, সূর্যাস্ত হতে সূর্যোদয় অবধি রাতভর মাইকে ধর্মীয় সম্প্রচার অব্যাহত থাকে। এ ধরনের সম্প্রচারের শব্দ উৎপত্তি স্থল হতে বহুদূর পর্যন্ত বিস্তৃত হয় এবং রাতের নিস্তব্ধতায় এটির ব্যাপকতা আরও গভীরভাবে অনুভূত হয়। প্রতিটি ধর্মাবলম্বীর নিকট ধর্মীয় আচার অনুষ্ঠান পবিত্র বিধায় এ ধরনের সম্প্রচারকালীন কিছু বিধিনিষেধ প্রতিপালন অত্যাবশ্যক। কিন্তু রাতভর অনুষ্ঠান চললে জৈবিক তাড়নায় অনেকের পক্ষে যে বিধিনিষেধ মেনে চলা সম্ভব হয় না তা অনুষ্ঠান সংশ্লিষ্টদের বিবেচনায় নেওয়া উচিত নয় কি? অধিকন্তু অসহনীয় মাত্রার শব্দ যে নিদ্রা ব্যাঘাতের কারণ হয়ে দেখা দেয়, সেদিকেও দৃষ্টিনিবদ্ধ অত্যাবশ্যক।
দেশে মানুষের আর্থিক অবস্থার উন্নতির সঙ্গে সঙ্গে বিভিন্ন ধরনের সামাজিক অনুষ্ঠান আয়োজনের সক্ষমতা বৃদ্ধি পেয়েছে। এ ধরনের অনেক সামাজিক অনুষ্ঠান সংশ্লেষে সাংস্কৃতিক পরিবেশনার আয়োজন থাকে। অধিকাংশ ক্ষেত্রে দেখা যায়, সামাজিক অনুষ্ঠানের শেষভাগে বাদ্যযন্ত্রের সংমিশ্রণে সাংস্কৃতিক পর্ব থাকে এবং তা গভীর রাত অবধি চলে। এ ধরনের সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান যে আশপাশে বসবাসরত মানুষজনের ঘুমের ব্যাঘাত করে প্রায়শই দেখা যায়, সেদিকে আয়োজকদের কোনো ধরনের ভ্রুক্ষেপ থাকে না।
শহরগুলোতে, বিশেষত ঢাকা ও বিভাগীয় শহরসমূহে বহুতলবিশিষ্ট ভবন ও বিভিন্ন ধরনের অবকাঠামো নির্মাণে মাত্রাতিরিক্ত ও অসহনীয় শব্দ উৎপাদক যেসব যন্ত্রপাতির ব্যবহার হচ্ছে তা নির্মাণ স্থলের ও আশেপাশের এলাকার লোকজনের বড় ধরনের অস্বস্তির কারণ হয়ে দেখা দিয়েছে। কিন্তু নির্মাতা প্রতিষ্ঠানসমূহ ধনাঢ্য বিধায় তাদের কার্যকলাপ জনউপদ্রবের কারণ হওয়া সত্ত্বেও সাধারণ জনমানুষ তা হতে নিবৃত্তি পাওয়ার ক্ষেত্রে কদাচিৎ আইন প্রয়োগকারী সংস্থা বা প্রশাসনের সহায়তা লাভ করে। এ ধরনের নির্মাণকাজ দীর্ঘদিনব্যাপী চলতে থাকায় তা প্রতিনিয়ত সংশ্লিষ্ট এলাকার মানুষজনের আরাম-আয়েশ-বিশ্রামসহ ঘুমের তীব্র ব্যাঘাত করে চলেছে। যেকোনো মানুষ প্রতিনিয়ত এ ধরনের ব্যাঘাতের কবলে পড়লে তার পক্ষে স্বাভাবিক জীবনযাপনসহ স্বাভাবিকভাবে কাজ করা দূরূহ।
পৃথিবীর উন্নত দেশসমূহে আবাসিক এলাকায় কোনো কলকারখানা ও বাণিজ্যিক স্থাপনা গড়ে তোলার অনুমতি দেওয়া হয় না। দেশে এ বিষয়ে কাগজেকলমে বিধিনিষেধ থাকলেও তা হরহামেশাই উপেক্ষিত হয়ে আসছে। আমাদের শহরাঞ্চলে অনেক আবাসিক এলাকার সন্নিকটে কলকারখানা ও বাণিজ্যিক স্থাপনা গড়ে উঠায় এবং এগুলোর উৎপাদন প্রক্রিয়া সংশ্লেষে মাত্রাতিরিক্ত শব্দ ও কার্যক্রম দিন গড়িয়ে রাত অবধি চলায় তা আশেপাশের মানুষজনের স্বাভাবিক জীবনযাপন মারাত্মকভাবে ব্যহত করছে। এ সব কারখানা ও বাণিজ্যিক স্থাপনা মালিক প্রতিপত্তি ও প্রভাবশালী হওয়ার কারণে আইন প্রয়োগকারী সংস্থা ও প্রশাসনের সহায়তা সাধারণ জনমানুষের চেয়ে এদের স্বপক্ষেই থাকে। আর এ কারণে এদের এ ধরনের কার্যকলাপ অনেকটা বাঁধাহীনভাবে চলে জনমানুষের অস্বস্তিকে প্রলম্বিত করে।
শব্দ দূষণ একটি সামাজিক উপদ্রব এবং এ ধরনের দূষণ আইন দ্বারা অনুমোদিত নয়। আমাদের দ-বিধিতে এটিকে গণউপদ্রব গণ্যে শাস্তিযোগ্য করা হলেও আইন প্রয়োগকারী সংস্থা ও প্রশাসনের উদাসীনতায় এর উপদ্রব হতে সাধারণ জনমানুষের নিষ্কৃতি মিলছে না। সাধারণ জনমানুষের সুখ-সাচ্ছন্দ্য, আরাম-আয়েশ, বিশ্রাম-নিদ্রা প্রভৃতি নিশ্চিত করতে হলে শব্দ দূষণ হতে পরিত্রাণ অত্যাবশ্যক। আর পরিত্রাণ না পাওয়ায় শব্দ দূষণ স্বাভাবিক ও সাচ্ছন্দে জীবনযাপনের ক্ষেত্রে এখনও বড় ধরনের অন্তরায়।
লেখক: সাবেক জজ, সংবিধান, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক বিশ্লেষক
সম্পাদনা: আশিক রহমান