এত জঙ্গি এলো কোথা থেকে?
ড. বদরুল হাসান কচি
সাম্প্রতিক সময়ে দেশে ঘটে গেল কয়েকটি জঙ্গি হামলা। একই সঙ্গে আইনশৃঙ্খলাবাহিনীর বেশ কটি জঙ্গি অভিযান পরিচালনাও ছিল প্রশংসনীয়। তারপরও জনমনে উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা রয়ে গেছে। উৎকণ্ঠায় আছে বাড়ির মালিকেরা; কারণ ভাড়াটিয়া সেজে কে আবার জঙ্গি আস্তানা বানিয়ে রেখেছে, এই ভয়ে। সত্যি, বোঝা বেশ মুশকিল! কড়াকড়ি আরোপ করা হলো, ব্যাচেলর ভাড়াটিয়াদের প্রতি। ফলে ব্যাচেলররা শহরে বাসা ভাড়া নিয়ে নানা বিড়ম্বনার মধ্যে পড়েছেন। এখন দেখা যাচ্ছে, কেবল ব্যাচেলর ভাড়াটিয়াই ভয়ংকর নয়, পরিবার নিয়েও থাকছেন জঙ্গিরা। আজিমপুরের ঘটনা সে সাক্ষ্য দিচ্ছে। ধরা পড়ছে নারী জঙ্গি। তারাও পুলিশের সঙ্গে সশস্ত্র যুদ্ধ করছে।
ঠিক এই পরিস্থিতিতে অনেকের সঙ্গে আলোচনায় একই প্রশ্ন শুনেছি বারবার; দেশে এত জঙ্গি এলো কোথা থেকে? অর্থাৎ মানুষজন বুঝতে পারছে না, যারা জঙ্গি হয়েছে তারা তো হঠাৎ করে কেউ জঙ্গি হয়নি, তাদেরকে ধীরে ধীরে জঙ্গিবাদের দিকে ধাবিত করা হয়েছে। কাজটি যেমন শ্রমসাধ্য, তেমনি সময়সাধ্য ব্যাপার। তাহলে এতদিন আইনশৃঙ্খলাবাহিনী বুঝতে পারেনি কেন? কিংবা হঠাৎ করে জঙ্গিদের এই আত্মপ্রকাশ কেন?
আমরা সহজে অতীত ভুলে যাই, এটা আমাদের বড় দোষের একটি। তাই বারবার মনে করিয়ে দিতে হয় পুরনো কাহিনী। ২০০৫ সালের ১৭ আগস্টের দিন দেশে কি ঘটেছিল তা হয়তো অনেকের স্মৃতি থেকে চলে গেছে। ইসলামি শাসনব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার দাবি নিয়ে দেশব্যাপী বোমা হামলা চালিয়েছিল জঙ্গিরা সেদিন। ৬৩ জেলায় একই সময়ে ৫০০ স্থানে বোমা বিস্ফোরণ ঘটিয়ে তারা জানান দিয়েছিল, তাদের শক্ত নেটওয়ার্কের কথা। কারও বুঝতে কষ্ট হবার নয়, ৫০০ বোমা তৈরি করা, তা অধিক সতর্কতার সঙ্গে ৫০০ জায়গায় পৌঁছে দেওয়া এবং ৫০০ ব্যক্তি সে বোমা নিক্ষেপ করা, একই সময় রক্ষণাবেক্ষণ করা এবং যারা বোমা বিস্ফোরণ করেছেন তাদের প্রশিক্ষণ দেওয়া; এতসব কাজের সঙ্গে অন্তত পাঁচ হাজার জঙ্গি জড়িত থাকার বিষয়টি খুবই স্বাভাবিক। প্রশ্ন হচ্ছে, সে ঘটনায় জড়িত কয়জনকে আমাদের আইনশৃঙ্খলাবাহিনী ধরতে পেরেছে? কিংবা সে ঘটনার বিচারের কাজ কতদূর এগুলো? সঠিক কোনো উত্তর কারও জানা নেই। তৎকালীন রাষ্ট্র ক্ষমতায় ছিলেন বিএনপি-জামায়াত জোট; তারা এতবড় ঘটনাকে তেমন আমলে কেন নিলেন না, সেটা আমাদের মতো সাধারণ নাগরিকেরা ঠিক বুঝতে পারেনি।
সেদিন যারা জানান দিয়েছিল তাদের শক্ত অবস্থানের কথা, তারা নিশ্চয়ই ওই বোমা হামলা ঘটিয়ে জঙ্গি থেকে ভালো মানুষ হয়ে যাননি। কোথাও না কোথাও তারা তাদের কাজ নিয়ে ব্যস্ত ছিলেন; হয়তো তারা তাদের পথভ্রষ্ট আদর্শ ছড়িয়েছেন কিংবা আরও প্রশিক্ষণ নিয়েছেন। তারা হয়তো এতদিন জঙ্গিবাদের বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্স ঘোষণা করা এই সরকারের সময়কালে তাদের কৌশলে ভিন্নতা এনেছেন। আর সেভাবে প্রস্তুত হয়ে এখন মাঠে নেমেছেন একযোগে।
এটা ঠিক আইনশৃঙ্খলাবাহিনী এখন যতটা তৎপর আছে, আরও আগে থেকে এই তৎপরতা থাকলে আজকের মতো এত খারাপ পরিস্থিতি হতো না। বলতে গেলে, আইনশৃঙ্খলাবাহিনীর সক্ষমতা ও নজরদারির অভাব ছিল। এখন যেমন তারা বিষয়টিকে গুরুত্ব দিয়ে কাউন্টার টেরোরিজম ইউনিট নামে আলাদা একটি বাহিনী করেছে, তাদের সদস্যদের নানানভাবে দক্ষ করে তুলছে। বলা যায়, সে সুফল পাচ্ছিও আমরা।
আরেকটি ঘটনা উল্লেখ করতে চাই, ২০০৪ সালে ২১ আগস্ট রাজধানীর গুলিস্তানে আওয়ামী লীগের সমাবেশে বড় একটি জঙ্গি হামলার ঘটনা গোটা দেশ প্রত্যক্ষ করেছে। পরবর্তীতে তদন্তে বেরিয়েছে, জঙ্গিদের পেছনে রাষ্ট্রীয় মদদ ছিল। তৎকালীন সময়ে যারা ক্ষমতায় ছিল, তাদের বড় বড় মাথারা ঘটনার ইন্ধনদাতা ও অর্থদাতা ছিল। যেখানে জঙ্গিবাদ উস্কে দেওয়ার জন্য রাষ্ট্রীয় মদদ থাকে, সেখানে জঙ্গিদের চাষাবাদ হওয়া স্বাভাবিক ঘটনা নয় কি? এবং তাই হয়েছিল। বলতে গেলে, সে ফল আমরা এখন ভোগ করছি। তাই বর্তমানে জঙ্গিদের সমূলে উৎপাটন এত কঠিন হয়ে দাঁড়িয়েছে।
বলতে কোনো দ্বিধা নেই, শেখ হাসিনার নেতৃত্বে বর্তমান সরকার ক্ষমতায় না থাকলে এই দেশ পাকিস্তান কিংবা আফগানিস্তানের মতো জঙ্গি রাষ্ট্র যে হতো, তা নিয়ে কোনো সন্দেহও নেই। স্বীকার করতেই হবে, শেখ হাসিনা জঙ্গিদের হাত থেকে বাঁচিয়েছেন আমাদের, রক্ষা করে চলেছেন এই দেশ।
লেখক: আইনজীবী ও মানবাধিকার কর্মী
সম্পাদনা: আশিক রহমান