রাজীব গান্ধীর বিষয়ে সিরিয়াস না হওয়ার খেসারত দিল সরকার
শায়েখ হাসান: উত্তরাঞ্চলের জঙ্গি অধ্যুষিত জেলায় জঙ্গি কর্মকা-ে সরাসরি জড়িত ছিল রাজীব গান্ধী ওরফে শান্ত ওরফে সুভাষ। ওই অঞ্চলের কয়েকটি জেলার দলপতিও ছিল সে। বছরের শুরুর দিকে গোয়েন্দারা তার বিষয়ে তথ্যও সংগ্রহ করে। এমনকি সেই তথ্যসহ প্রতিবেদন জমা পড়ে সরকারের আইন-শৃঙ্খলা রক্ষা ও তদারকিতে নিয়োজিত সব সংস্থায়। কিন্তু এই চতুর লোকটির বিষয়ে ‘খুব সিরিয়াসলি’ কোনো পরিকল্পনায় যায়নি সরকার। যার খেসারত দিতে হলো গুলশান ও শোলাকিয়ায়। গোয়েন্দা এবং পুলিশ হেডকোয়ার্টার সূত্রে এসব তথ্য জানা গেছে।
সূত্র বলছে, গুলশানের হলি আর্টিজান রেস্তোরাঁয় জঙ্গি হামলার কয়েকদিন পরেই রাজীব গান্ধীর সংশ্লিষ্টতা পায় গোয়েন্দারা। তবে নিশ্চিত হওয়ার জন্য কিছুদিন সময় নেওয়া হয়। এ সময়ের মধ্যে গ্রেফতারের চেষ্টাও চলে। কিন্তু তাকে আর পাওয়া যায়নি। সর্বশেষ ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশ (ডিএমপি) বলছে, হামলার পর কীভাবে পালাতে হবে, প্রতিরোধ হলে তা কীভাবে প্রতিহত করতে হবে তার অনেক কিছুরই ছক কষে তারা। আর এই হামলার অন্যতম মাথা ছিল রাজীব গান্ধী। প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী, সে-ই মূলত হামলায় অংশ নেওয়া জঙ্গি দলকে বাইরে থেকে নেতৃত্ব দিয়েছিল। তার উপরে ‘থিঙ্কট্যাঙ্ক’ হিসেবে কাজ করেছিল অন্য জঙ্গি নেতারা।
ঢাকা মহানগর পুলিশের অতিরিক্ত উপ-কমিশনার (গণমাধ্যম) মোহাম্মদ ইউসুফ আলী বলেন, ‘রাজীব গান্ধীর প্রকৃত নাম আমরা জানতে পারিনি। তবে আগে থেকেই পুলিশের হাতে তার বিষয়ে তথ্য ছিল, তবে সেই তথ্য ছিল নিষিদ্ধ ঘোষিত সংগঠন জেএমবির ‘কমান্ডার’ হিসেবে। তখন তাকে গ্রেফতারের বিষয়ে অভিযানও পরিচালনা হয়। তবে তাকে গ্রেফতার করা যায়নি’।
রাজীব গান্ধী নামে পরিচিত এই ব্যক্তি আগে থেকেই জঙ্গি কর্মকা-ে সম্পৃক্ত ছিল। তিনি কাজ করছিলেন নিষিদ্ধ জঙ্গি দল জেএমবির ‘উত্তরাঞ্চলীয় কমান্ডার’ হিসেবে।
এ বিষয়ে তিনদিন আগেই পুলিশের কাউন্টার টেরোরিজম ইউনিটের প্রধান মনিরুল ইসলাম ও ডিএমপির অতিরিক্ত কমিশনার মনিরুল ইসলাম বলেছিলেন, রাজীব গান্ধী ওরফে সুভাষ গান্ধী ওরফে গান্ধী নামে জঙ্গি কর্মকা-ে সম্পৃক্ত ওই ব্যক্তি কাজ করছিলেন নিষিদ্ধ জঙ্গি দল জেএমবির ‘উত্তরাঞ্চলীয় কমান্ডার’ হিসেবে। অর্থাৎ তথ্য থাকা সত্ত্বে¡ও এই জঙ্গির বিষয়ে হার্ডলাইনে যায়নি সরকার। যদিও পুলিশের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে, তখন দেশে অন্যান্য অনেক বিষয় ছিল, যেগুলো রাজীব গান্ধীর থেকে গুরুত্বপূর্ণ ছিল।
সূত্র জানায়, নিষিদ্ধ জঙ্গি সংগঠন জেএমবি প্রায় এক বছর আগে গুলশান-বারিধারা এলাকার একটি বেসরকারি টেলিভিশন চ্যানেলে হামলা চালানোর এবং সেটির নিয়ন্ত্রণ নিয়ে নেওয়ার পরিকল্পনা করেছিল। ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ কয়েক জঙ্গিকে আটক করার পর এই পরিকল্পনার কথা জেনে যায়। পরবর্তী সময়ে ওই টেলিভিশন চ্যানেলে নিরাপত্তা জোরদারের পাশাপাশি শুরু করে ধারাবাহিক অভিযান। ফলে তখন টেলিভিশন চ্যানেলটি জঙ্গি আক্রমণ থেকে রক্ষা পায়। এরপর জেএমবি হোটেল র্যাডিসনে হামলার পরিকল্পনা করে। গত বছর নভেম্বরে রাজধানীতে পুলিশের সঙ্গে ‘বন্দুকযুদ্ধে’ জেএমবির সামরিক কমান্ডার আলবানি ওরফে হোজ্জা ভাই ওরফে মেম্বার ভাই ওরফে শাহাদত ওরফে মাহফুজ নিহত হয়। এই জঙ্গি পুরান ঢাকার হোসেনি দালানে গ্রেনেড হামলা ও আশুলিয়ায় ব্যাংক ডাকাতিসহ আরও কয়েকটি হামলার নেতৃত্ব দিয়েছিল।
আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ও গোয়েন্দা সূত্রের তথ্য অনুযায়ী, ঠিক এমন একটা পরিস্থিতিতে জেএমবির থিঙ্কট্যাঙ্করা উত্তরাঞ্চলের সামরিক কমান্ডার রাজীব গান্ধী ওরফে শান্ত ওরফে সুভাষ ওরফে আদিলকে ঢাকায় আক্রমণের দায়িত্ব দেয়। পাশাপাশি দেশি-বিদেশি মিডিয়ায় সংবাদ শিরোনাম থেকে গুলশান, বনানী ও বারিধারা এলাকায় হামলা চালাতে পরামর্শ দেওয়া হয়। এরপরই নিবরাস ইসলামসহ আরও বেশ কয়েকজনকে নিয়ে একটি জঙ্গি দল গঠন করা হয়। নেওয়া হয় বাসা ভাড়া। সংগ্রহ করা হয় অস্ত্র। মজুদ করা হয় হাতে তৈরি গ্রেনেড। পরিকল্পনা করা হয় হলি আর্টিজানে জঙ্গি হামলার। এরপর জঙ্গি দলটি প্রায় দুই মাস আগে থেকে কয়েক দফা হলি আর্টিজানসহ আরও কয়েকটি টার্গেট পয়েন্ট রেকি করে। এর মধ্যে হলি আর্টিজানকেই শেষ পর্যন্ত হামলার জন্য বেছে নেওয়া হয়।
সূত্র জানায়, জেএমবির এই আক্রমণের পরিকল্পনা সম্পর্কে আঁচ করতে পারে পুলিশ ও গোয়েন্দা সংস্থাগুলো। গত ২৭ জুন স্পেশাল ব্রাঞ্চ থেকে এক আগাম গোয়েন্দা প্রতিবেদন দাখিল করা হয় ঢাকার পুলিশ কমিশনারের কাছে। এ ছাড়া টাঙ্গাইল জেলার পুলিশ সুপারকেও একই প্রতিবেদন দেওয়া হয়।
প্রতিবেদনে বলা হয়, উত্তরাঞ্চলের জঙ্গি অধ্যুষিত জেলায় পুলিশের টানা অভিযানের ফলে ওই অঞ্চল থেকে পালিয়ে একটি গ্রুপ আশ্রয় নিয়েছে ঢাকা, টাঙ্গাইল ও ময়মনসিংহ অঞ্চলে। এই গ্রুপের দলনেতা রাজীব গান্ধী ওরফে শান্ত, ওরফে সুভাষ ওরফে আদিল। তার সহযোগী হৃদয় ও সোহেল। তারা এই এলাকা নিরাপদ মনে করছে। ওই প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, ঢাকা ও পার্শ্ববর্তী এলাকায় নাশকতা চালানোর জন্য জেএমবির একটি গ্রুপ ঢাকায় অবস্থান করছে। এদের মধ্যে বিকাশ, আকাশ, ডন রমজান মাসের শুরুর দিকে উত্তরবঙ্গ থেকে ঢাকায় আসে।
এই পর্যন্ত ডিএমপির দেওয়া তথ্য মতে, নব্য জেএমবির হামলা ও নাশকতায় দক্ষ জঙ্গি সরবরাহ করাই রাজীব গান্ধীর মূল দায়িত্ব। তার আগে জঙ্গিদের প্রশিক্ষণ ও বাসস্থানও নিশ্চিত করে সে। সংগঠনে তার নাম রাজীব গান্ধী, ওরফে সুভাষ গান্ধী, ওরফে গান্ধী, ওরফে শান্ত ওরফে আদিল। গুলশান ও শোলাকিয়া হামলায় তিন জঙ্গিকে সে উত্তরাঞ্চল থেকে পাঠিয়েছিল। পুলিশ তাকে গ্রেফতারে হন্য হয়ে খুঁজছে। তার আসল পরিচয় কী? তদন্ত সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, সে বাংলাদেশের উত্তরাঞ্চলে থাকতে পারে। সম্পাদনা : সুমন ইসলাম