বিদায়ী ভাষণে বান কি মুন হাত থেকে রক্তের দাগ মুছে মানবতাবাদ গ্রহণ করুন
লিহান লিমা: জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের অধিবেশনে শেষবারের মতো ভাষণ দিলেন সংস্থাটির মহাসচিব বান কি মুন। বিদায়ী ভাষণে তার কণ্ঠে ফুটে উঠেছে বিশ্বনেতাদের প্রতি তীব্র ক্ষোভ, নিন্দা ও মৌলিক মানবাধিকার রক্ষার আহ্বান। সূত্র: ইউএন রেডিও, ইয়াহু নিউজ
জাতিসংঘ মহাসচিব বলেন, অনেক জায়গায়ই আমরা দেখি ক্ষমতালোভী শাসকরা সংবিধান পরিবর্তন করেন। ক্ষমতাকে হস্তগত করার জন্য তারা নির্বাচনি কৌশলে কিছু বেপরোয়া পদক্ষেপ গ্রহণ করেন। সবার জন্য আমার বার্তা পরিষ্কার। আপনাদের জনগণের জন্য কাজ করুন। গণতন্ত্রকে অপবিত্র করবেন না। আপনার দেশের সম্পদ চুরি করবেন না। আপনার সমালোচকদের নির্যাতন এবং তাদের বন্দি করবেন না। শহরগুলোর প্রতি অত্যাচার করবেন না।
মঙ্গলবার অধিবেশনের সাধারণ বিতর্কের এ পর্বের বক্তব্যে তিনি সিরিয়া ইস্যুকেই সবচেয়ে বেশি প্রাধান্য দেন। জাতিসংঘ মহাসচিব বলেন, এ যুদ্ধে উভয় পৃষ্ঠপোষকদের হাতেই রক্তের দাগ লেগে আছে। এখানে এমন সব দেশের প্রতিনিধি রয়েছেন, যেসব দেশ সিরিয়ায় যুদ্ধরত পক্ষগুলোকে সহায়তা করেছে, অর্থ দিয়েছে, সরাসরি অংশ নিয়েছে, এমনকি দেশটির জনগণের ওপর নৃশংসতা চালিয়েছে। প্রভাবশালীদের প্রতি আমার অনুরোধ, আলোচনার সুযোগ তৈরি করুন। এ যুদ্ধ বন্ধের উদ্যোগ নিন।
বান কি মুন বলেন, একজন মানুষের ভাগ্যের উপর ভিত্তি করে যুদ্ধবিধ্বস্ত সিরিয়ার ভবিষ্যৎ থমকে যেতে দেওয়া যাবে না। তার এ বক্তব্যে সিরিয়ান প্রেসিডেন্ট বাশার-আল-আসাদের কথা বলা হয়। মুন বলেন, সিরিয়ায় সব পক্ষই মানুষ মেরেছে, তবে সবচেয়ে বেশি মানুষ নিহত হয়েছে আসাদ সরকারের হাতে। আসাদ সরকার এখনও নির্যাতন জারি রেখেছেন।
ভাষণে সিরিয়ার যুদ্ধ পরিস্থিতি দীর্ঘায়িত করে তোলার পাশাপাশি মানবাধিকার লঙ্ঘন ও দেশটির ক্ষুধার্ত জনগণের মধ্যে ত্রাণ বিতরণে বাধা সৃষ্টি করায় বিশ্বনেতাদের ওপর ক্ষোভ প্রকাশ করেন জাতিসংঘ মহাসচিব।
এ সময় তিনি দক্ষিণ সুদানের দ্বন্দ্বরত নেতাদের বিরুদ্ধে জনগণের সঙ্গে প্রতারণার অভিযোগ তোলেন। ইসরায়েল-ফিলিস্তিন সম্পর্কে বান কি মুন বলেন, গত এক দশকে এ অঞ্চলে শান্তির দেখা মেলেনি। সেখানে ফিলিস্তিনিরা নির্যাতিত হচ্ছে। ইসরায়েল ক্রমাগত নতুন বসতি গড়ে তুলেছে। এটি পাগলামি। দুই দেশের পরিবর্তে এক দেশ গড়ে তোলার প্রক্রিয়ার পরিণতি ভয়াবহ হতে পারে।
উত্তর কোরিয়ার সাম্প্রতিক পারমাণবিক বোমার পরীক্ষা চালানো প্রসঙ্গে তিনি বলেন, পিয়ংইয়ংয়ের উচিত সামরিক কার্যক্রম থেকে সরে আসা। জাতিসংঘের শান্তিরক্ষীদের দ্বারা হাইতিতে যৌন নিগ্রহ ও ধর্ষণের ঘটনায় দুঃখ প্রকাশ করেন বান কি মুন। বলেন, হাইতিতে কলেরা আক্রান্তদের সহায়তায় উদ্যোগ নেবে জাতিসংঘ। পাশাপাশি হাইতিতে সুপেয় পানি, স্বাস্থ্যসম্মত পয়ঃনিষ্কাশনব্যবস্থা ও স্বাস্থ্যসেবার মানোন্নয়নে সহযোগিতা করা হবে ।
নিজেকে বান কি মুন ‘ফেমিনিস্ট’ হিসেবে দাবি করে বলেন, আগের চেয়ে উচ্চপদে আমি মেয়েদের নিয়োগ দিয়েছি। নারীর ওপর সহিংসতা রোধে আমাদের আরও বেশি বেশি ভূমিকা রাখতে হবে। এ সময় শিশুদের জন্য নিরাপদ পৃথিবী গড়তে বিশ্বজুড়ে কার্বন নিঃসরণের হার কমানোর আহবান জানান জাতিসংঘ মহাসচিব।
বিশ্বনেতাদের উদ্দেশে বান কি মুন বলেন, আমাদের কাছে নষ্ট করার মতো আর সময় নেই। এ বছরের মধ্যেই প্যারিস চুক্তি কার্যকর করতে আপনাদের অনুরোধ করছি। এটি বর্তমান সময়ের চ্যালেঞ্জ। চুক্তিটি কার্যকর করতে মাত্র ২৬টি দেশকে এতে যোগ দেওয়া প্রয়োজন। বিশ্বের ১৫ শতাংশ কার্বন নিঃসরণের জন্য এসব দেশ দায়ী।
ভাষণের শেষে বিশ্ব শীর্ষ কূটনীতিক হিসেবে তিনি দাবি করেন, ১০ বছরের দায়িত্ব পালন শেষে আমি এখন অতীতের যেকোনো সময়ের চেয়ে একথা বেশি বিশ্বাস করি যে, যুদ্ধ, দারিদ্র্য ও নিপীড়ন বন্ধের ক্ষমতা আমাদের আছে। মানুষের জীবনমান উন্নয়নে জাতিসংঘ আরও কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারে।
উল্লেখ্য, দক্ষিণ কোরিয়ার সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী বান কি মুন আগামী ৩১ ডিসেম্বর জাতিসংঘের মহাসচিব হিসেবে ১০ বছরের মেয়াদ পূর্ণ করবেন। এই হিসাবে জাতিসংঘের চলমান সাধারণ অধিবেশনে এটিই তার শেষ ভাষণ। এখন দেখার বিষয় হলো, বিশ্বনেতাদের বন্ধ মানবতাবাদের চক্ষু এবং হাতে লেগে থাকা রক্তের দাগ তিনি উন্মোচিত করে দিয়ে যেতে পারেন কি না। সম্পাদনা : পরাগ মাঝি