ভারতকে কেন শান্ত থাকতে হবে
ডেস্ক রিপোর্ট: বড় ধরনের সন্ত্রাসী হামলা হলো জম্মু-কাশ্মীরে। এই হমলায় নিহত হয়েছে ১৮ ভারতীয় সেনা। এরপর প্রথমে ৪ সন্ত্রাসী ও পরে ভারতে ঢুকার চেষ্টাকালে ১০ অনুপ্রবেশকারী নিহত হয় ভারতের সেনাদের গুলিতে। কাশ্মীরের শেষ খবর এরকমই। এ ঘটনার পর শুরু হয় পরস্পরকে দোষারোপ করার পুরাতন রাজনীতি। এ ঘটনার জন্য ভারত দায়ী করে পাকিস্তানভিত্তিক সন্ত্রাসী গ্রুপকে। আর পাকিস্তান যথারীতি তা অস্বীকার করে। ভারত বলেছে বিষয়টি তারা জাতিসংঘে তুলবে। পাশাপাশি কাশ্মীরে সেনা উপস্থিতিও বাড়াচ্ছে ভারত। অন্যদিকে, পাকিস্তান এ বিষয়ে কোনো কূটনৈতিক পদক্ষেপ নিয়েছে এমন খবর পাওয়া যায়নি। রাজনীতি ও কূটনীতি যাই হোক, একথা সত্যি যে আক্রান্ত হয়েছে ভারত। আর আক্রমণের ধারাটা এমন যে, তা ভারতের সম্মানে ঘা দিয়েছে। এমন পরিস্থিতিতে প্রশ্ন হলো ভারত এবং পাকিস্তান কি যুদ্ধের সীমারেখায় এসে দাঁড়িয়েছে। আর পাকিস্তান-ভারতের মধ্যে সীমিত পরিধির যুদ্ধ শুরু হলে সার্কের ভবিষ্যৎ কোথায় গিয়ে দাঁড়াবে। আঞ্চলিক নিরাপত্তার স্বরূপটি কেমন হবে।
হামলার পর ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি বলেন, এ ঘটনার জন্য দায়ী যেই হোক তাকে রেহাই দেওয়া হবে না। তিনি বলেন, সমুচিত জবাব দেওয়া হবে। আর ভারতের সশস্ত্র বাহিনী বলেছে রাজনীতিকদের সীমান্ত পার হয়ে হামলার কথা বিবেচনা করা উচিৎ। সংবাদ মাধ্যমে খবর এসেছে এ বিষয়ে দ্রুত ভারতের প্রতিক্রিয়া পাওয়া যাবে।
নরেন্দ্র মোদি ক্ষমতায় আসেন ২০১৪ সালে। তিনি পাকিস্তানের বিষয়ে বরাবরই কঠোর অবস্থানের পক্ষে। আর সাম্প্রতিক সন্ত্রাসী হামলার পর পেছনের শক্তিকেও শাস্তি দেয়ার প্রতিজ্ঞা করেন। বিজেপির একজন সিনিয়র নেতা রাম মাধব। তিনি বলেন কৌশলগত ধৈর্য্য ধারণের নীতির দিন শেষ। সাবেক সামরিক কর্মকর্তারা এই প্রবণতার পক্ষে মত দিচ্ছেন। বলছেন এর পাল্টা জবাব দেওয়া উচিৎ। প্রতিরক্ষা বিশ্লেষক রাহুল বেদি বলেন, সেনাবাহিনী সাম্প্রতিক ঘটনার জবাব দেয়ার জন্য মুখিয়ে আছে। আর এতে করে দুই পারমাণবিক শক্তিধর প্রতিবেশীর মধ্যে উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়ছে।
এমন পরিস্থিতিতে দাঁড়িয়ে, সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ও সংকটপূর্ণ প্রশ্ন হচ্ছে ভারতের কি পর্যাপ্ত গোয়েন্দা তথ্য এবং সামর্থ্য আছে যে, পাকিস্তানের ভিতরে নির্দিষ্ট লক্ষ্যে আঘাত হানতে পারে বা একটা সীমিত যুদ্ধ পরিচালনা করতে পারে। বেশিরভাগ বিশেষজ্ঞের মত মোদি সরকার এমন কিছু দেখাতে পারেনি যে এটা বিশ্বাস করতে হবে ভারতের এ ধরনের সামর্থ্য আছে। বিভিন্নজন বলছে ভারতের উচিত পাকিস্তানের ভিতরে বিমান হামলা চালানো। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, পাকিস্তানের বিমান প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা দিয়ে জবাব দিলে এমন ধরনের হামলা চালানো প্রায় অসম্ভব। এছাড়া অনেকে এমন সন্দেহও করছেন যে ভারত প্রথাগত যুদ্ধের বাইরে কিছু করতে পারে বা এমন সামর্থ্য অর্জন করেছে, এর কোনো প্রমাণ দেখা যাচ্ছে না।
প্রতিরক্ষা বিশ্লেষক অজয় শুক্লার মতে, মোদি সরকারের সমস্যা হচ্ছে তারা পাকিস্তানের বিরুদ্ধে বেশি কথা বলছে, কিন্তু সন্ত্রাসী হামলা মোকাবিলায় সামরিক এবং পরিকল্পনা সামর্থ্য অর্জন করেনি। আগের সরকারের সঙ্গে তুলনা করলেও তা অর্জন করতে পারেনি। এই সরকার এখন নিজের তর্জন-গর্জনের হাতে বন্দি হয়ে পড়েছে। শুক্লা বলেন, বিপদটা হচ্ছে নিজের বক্তৃতাবাজির ফাঁদে পড়েছে সরকার। এখন তাকে কঠোর জবাব দিতে হবে আর তা করতে হবে দুর্বল উপায়ে। এ কারণে, হয়তো পাকিস্তানের প্রতি কৌশলগত ধৈর্য্য ধারণের নীতিই হবে এ প্রশ্নের উত্তম জবাব। আর এ নীতি কাজ না করলে কি হবে এর কোনো সহজ জবাব নেই।
প্রতাপ ভানু মেহতা। দিল্লিভিত্তিক প্রখ্যাত থিংক ট্যাঙ্ক প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি রিসার্চ-এর গবেষক। তিনি বলেন, ধৈর্য্য ধারণের নীতি ভারতের জন্য অনেক ভালো। এতে করে পাকিস্তান চীন ছাড়া, আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় থেকে বিচ্ছিন্ন হবে। আর ভারত পাকিস্তানের উপর আর্থিক অবরোধ আরোপের জন্য আহ্বান জানাতে পারবে। আর সাম্প্রতিক হামলা পাকিস্তানকে নেতিবাচক সমালোচনার কেন্দ্রে নিয়ে আসবে। বিষয়টি জাতিসংঘে উত্থাপনে সহজ হবে। মেহতা বলেন, ভারত বক্তৃতাবাজি করে নিজেকে কিছুটা বাক্সবন্দি করে ফেলেছে। এখন আকস্মিক কিছু করেও ফেলা যায়। এ ছাড়া দীর্ঘ যুদ্ধে হয়তো ভারত জিতবে। তবে সি. ক্রিস্টিন ফেয়ার এর মতো সামরিক বিশ্লেষক মনে করেন পাকিস্তানকে সন্ত্রাসী কাজে ইন্ধন যোগানো থেকে নিবৃত করার জন্য কৌশলগত ধৈর্য্য ধারণের নীতি কাজ করবে না। তিনি আরও বলেন, এ নীতির কারণে আন্তর্জাজিক সম্প্রদায় ভারতের দিকে আরও ঝুঁকে যাবে, তাও নয়।
আরও কিছু পন্ডিতের মত, কৌশলগত ধৈর্য্য ধারণের নীতি ভারতের ভিতর এক ধরনের শান্ত থাকার যুক্তি প্রতিষ্ঠা করেছে। একশ’ কোর্টিও বেশি মানুষের দেশ ভারত। সবচেয়ে বড় সেনাবাহিনী আছে এমন দেশের তালিকায়ও ভারতের নাম আছে। তারপরও সন্ত্রাসী হামলায় সেনা সদস্যের মৃত্যুতে কোনো রাজনৈতিক অস্থিরতা দেখা দেয়নি ভারতে। একজন বিশেষজ্ঞ বলেন, ভারত অর্থনৈতিকভাবে এগিয়ে যাচ্ছে। পাকিস্তান তা করছে না। আর এ ধারা অব্যাহত রাখতে এ ধরনের হমলায় আরও মানুষ জীবন দান করতে পারে। কোনো যুদ্ধের ঝুঁকির বিপরীতে তা করতেই পারে। আর এই চেতনাই কৌশলগত ধৈর্য্য ধারণের নীতির পেছনে কাজ করে। আর এ কথাটা খুব বেশি উচ্চারিত হয় না।
তাহলে প্রশ্ন উঠে, ভারতের সামনে বিকল্প কী? লেখক ব্রহ্মা শেল্যানি বলেন, নতজানু নীতি ও যুদ্ধের ঝুঁকি- এর মাঝখানে কোনো নীতি গ্রহণ ভারতের জন্য প্রযোজ্য নয়। এটা একটা ভুল ও অনৈতিক অবস্থান। এ নীতি ভারতের পারমানবিক ও প্রথাগত যুদ্ধ সামর্থ্যকে পরিহাস করে। আর শত্রুকে আগ্রাসন অব্যাহত রাখতে উস্কানি দেয়। আর ভারতের নিজের ভূমিতে পাকিস্তানের অঘোষিত যুদ্ধের বিরুদ্ধে লড়ে যাওয়া ছাড়া আর কোনো বিকল্প নেই, এ যুক্তিও বৈধ নয়, খোঁড়া যুক্তি।
এ সব বিবেচনায় বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ভারতকে প্রথাগত যুদ্ধের বাইরে একটি বিস্তৃত কৌশল গ্রহণ করতে হবে। যার কোনো প্রচার থাকবে না। তারা আরও বলছেন দিল্লির উচিত ইসলামাবাদের সঙ্গে কূটনৈতিক সম্পর্কের মাত্রা কমিয়ে ফেলা। চীন, যুক্তরাষ্ট্র ও সৌদি আরবের উপর চাপ বাড়ানো; কারণ এরা পাকিস্তান থেকে বেশি সুবিধা পায়। ভারতের উচিৎ পাকিস্তানের উপর অর্থনৈতিক অবরোধ আরোপের জন্য লবিং করা। আর যুক্তরাষ্ট্রকে চাপ দেয়া, যাতে তারা পাকিস্তানকে সন্ত্রাসে ইন্ধনদাতা রাষ্ট্র হিসেবে প্রকাশ্য ঘোষণা দেয়।
গতবছর মোদি আকস্মিকভাবে পাকিস্তান সফরে যান। বিশেষজ্ঞরা ওই সফরের প্রতি ইঙ্গিত করে বলেন, ভারতের উচিৎ ভারতের সঙ্গে বন্ধুত্ব-শত্রুতার সম্পর্ক ত্যাগ করা। অনেকে মনে করেন, ভারত প্রশ্নে এ কথাও বলতে হবে যে, দেশটি আন্ত:সীমান্ত সন্ত্রাসের শিকার।
এদিকে, ডক্টর ফেয়ার বলেন, জাতিসংঘে বেলুচিস্তান ইস্যুকে উত্থাপন করলে তা ভারতের জন্য তেমন কাজে আসবে না। কারণ তাতে মনে হবে ভারত এ অঞ্চলের ঝগড়া-বিবাদের প্রত্যক্ষ অংশিদার। তিনি বলেন, ভারতের লক্ষ্য হওয়া উচিৎ পাকিস্তানের সন্ত্রাসী কর্মকা-, বেলুচিস্তান ইস্যু নয়। ভারতের উচিৎ এই অবস্থানে দৃঢ় থেকে এর সত্যতা তুলে ধরা।
দক্ষিণ এশিয়া বিশেষজ্ঞ স্টিফেন কোহেন বলেন, ভারত-পাকিস্তান সংঘাত হলো বিশ্বের সেইসব সংঘাতের একটি যা সত্যি অপ্রতিরোধ্য এবং যা চলতে পারে অননুমেয় কাল ধরে। এটা এমন এক সংঘাত যাতে পাকিস্তান কখনো জিতবে না। আর ভারতের হারাবার কিছু নেই। অনেক বিশেষজ্ঞ বলছেন, বাগাড়ম্বর কখনোই ঠা-া মাথার, পরিষ্কার দৃষ্টির নীতি এবং বিবেচনা প্রসূত পদক্ষেপের বিকল্প হতে পারে না। আর এর মাধ্যমে ভারতের গ্রহণযোগ্যতা বাড়বে বৈ কমবে না। বিবিসি অবলম্বনে, মোহসীন আব্বাস।