পাকিস্তানে সার্ক শীর্ষ সম্মেলন নিয়ে অনিশ্চয়তা! ভেঙে যেতে পারে সার্ক? বয়কট করবে ভারত, বাংলাদেশ ও আফগানিস্তান?
মাছুম বিল্লাহ : দক্ষিণ এশীয় আঞ্চলিক সহযোগিতা সংস্থা সার্ক কি ভেঙে যাচ্ছে? পর্যবেক্ষকদের অনেকে তেমন আশঙ্কার কথা বলছেন। জম্মু ও কাশ্মীরে সেনা ঘাঁটিতে হামলায় ২০ ভারতীয় সেনা নিহত হওয়ার পর দুই দেশের মধ্যে যুদ্ধের উত্তেজনা চলছে। এ প্রেক্ষিতে দুটি তথ্য সামনে এসেছে। প্রথমত. আগামী নভেম্বরে পাকিস্তানে অনুষ্ঠেয় সার্ক শীর্ষ সম্মেলনে ভারত, আফগানিস্তান ও বাংলাদেশ বয়কট করতে পারে। দ্বিতীয়ত. ভারত সরকার পাকিস্তানকে বাদ দিয়ে সার্কের বাকি ৬ সদস্য দেশের শীর্ষ নেতাদের নিয়ে ভারতে একটি সম্মেলনের উদ্যোগ নিচ্ছে।
ভারতের প্রভাবশালী হিন্দি দৈনিক জাগরণের এক উপ-সম্পাদকীয়তে বলা হয়েছে, নরেন্দ্র মোদির সরকারে ‘প্রতিবেশি প্রথম’ নীতির বাস্তবায়ন করার পরিকল্পনা করার অংশ হিসেবে ভারত শিগগিরই দক্ষিণ এশীয় সহযোগী সংস্থা সার্কের ৬ সদস্য রাষ্ট্রকে ভারতে এক শীর্ষ সম্মেলনে অংশ নিতে আমন্ত্রণ জানানোর উদ্যোগ নিচ্ছে।
টাইমস অব ইন্ডিয়া গ্রুপের হিন্দি দৈনিক নব ভারতের এক প্রতিবেদনে বলা হয়, কাশ্মীরের উরিতে সন্ত্রাসী হামলার ঘটনা আগামী নভেম্বরে অনুষ্ঠেয় সার্ক শীর্ষ সম্মেলনে ভারতে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির অংশগ্রহণের রাজনৈতিক সম্ভাবনাকে বিনষ্ট করে দেয়। একইসঙ্গে পাকিস্তান পরিচালিত সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানাতে ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশ ও আফগানিস্তানও সার্ক শীর্ষ সম্মেলন বয়কট করতে পারে।
পত্রিকাটির প্রতিবেদনে বলা হয়, আগামী নভেম্বরে পাকিস্তানে অনুষ্ঠেয় সার্ক শীর্ষ সম্মেলনে এই তিনটি দেশ বয়কট করতে পারে। এই তিনটি দেশই পাকিস্তান পরিচালিত সন্ত্রাসবাদের ভিকটিম হয়ে পড়েছে। তাই এ তিনটি দেশ রাষ্ট্র পরিচালিত সন্ত্রাসবাদের একটি ভিকটিম সম্মেলনের আয়োজন করতে পারে।
জাগরণের উপ-সম্পাদকীয়তে বলা হয়, পাকিস্তান পরিচালিত সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে বৈশ্বিক সচেতনতা বৃদ্ধিতে উদ্যোগী ভূমিকা পালন করবে। এই অঞ্চল থেকে সন্ত্রাস দূর করতে তিন দেশ একসঙ্গে কাজ করবে। ভারতে নিযুক্ত আফগানিস্তানের রাষ্ট্রদূত ড. শাইদা মোহম্মাদ আদবালী এনডিটিভিকে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে বলেছেন, আসন্ন সার্ক শীর্ষ সম্মেলন বয়কট করে পাকিস্তানকে একটি উপযুক্ত বার্তা পাঠানো উচিত।
এদিকে ভারত ও পাকিস্তানের সংবাদ মাধ্যমের খবর অনুযায়ী, ভারত এখন প্রতিবেশী রাষ্ট্র বাংলাদেশ, আফগানিস্তানসহ মিত্রদের সঙ্গে নিয়ে পাকিস্তানকে একঘরে করার কৌশল নিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে। এ কৌশল নিয়ে ভারত অনেক দূর এগিয়ে গেছে। যুক্তরাষ্ট্রের দুই পার্লামেন্ট সদস্য পাকিস্তানকে ‘জঙ্গি রাষ্ট্র’ ঘোষণার প্রস্তাব দিয়ে মার্কিন কংগ্রেসে একটি বিল উত্থাপন করেছেন। টেক্সাসের কংগ্রেসম্যান টেড পো এবং ক্যালিফোর্নিয়ার কংগ্রেসম্যান ডানা রোহরাবেকার ওই বিল উত্থাপন করেন। টেড পো কংগ্রেসের সন্ত্রাসবাদ বিষয়ক উপকমিটির চেয়ারম্যান, আর ডানা রোহরাবেকার বালুচ জাতিসত্তার একজন শক্তিশালী সমর্থক। পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী নওয়াজ শরিফ জাতিসংঘ সাধারণ অধিবেশনে বক্তব্য রাখার ঠিক আগে এই বিলটি উত্থাপন করা হয়। নওয়াজ শরিফ তার ভাষণে ভারত শাসিত কাশ্মিরে মানবাধিকার লঙ্ঘনের ইস্যুটি উত্থাপন করবেন বলে আগে থেকেই জানিয়েছে পাকিস্তান। আর তার পাল্টা হিসেবে পাকিস্তানের বেলুচিস্তানে জাতীয়তাবাদীদের দমনে পাকিস্তানের মানবাধিকার লঙ্ঘনের বিষয়টি জাতিসংঘে তুলে ধরবেন ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী সুষমা স্বরাজ।
পাকিস্তানের সঙ্গে সার্কের দুই সদস্য রাষ্ট্র বাংলাদেশ ও আফগানিস্তানের সম্পর্কও এখন বেশ নাজুক। যুদ্ধাপরাধীদের বিচার ইস্যুতে বাংলাদেশের সঙ্গে এবং তালেবানদের মদদ দেয়ার অভিযোগে আফগানিস্তানের সঙ্গে পাকিস্তানের সম্পর্কের টানাপড়েন চলছে। এই অবস্থায় ভারত দুটি দেশকে সঙ্গে নিয়ে ইসলামাবাদ শীর্ষ সম্মেলন বয়কটের মাধ্যমে পাকিস্তানকে একটি জবাব দিতে পারে। উড়ির ঘটনার নিন্দা জানিয়ে সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে ভারতের পাশে থাকার দৃঢ় অঙ্গীকার ব্যক্ত করেছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। একই ধরনের মনোভাব পোষণ করেছেন আফগান প্রেসিডেন্ট আশরাফ ঘানি।
কূটনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, সার্কের নিয়ম অনুযায়ী শীর্ষ সম্মেলনে সদস্য সব কয়টি দেশের সরকার বা রাষ্ট্রপ্রধানদের উপস্থিতি আবশ্যক। কোনো একটি দেশ অংশ না নিলে শীর্ষ সম্মেলন হতে পারে না। এর আগেও পাক-ভারত বিরোধকে কেন্দ্র করে সার্ক শীর্ষ সম্মেলন অনেকবার পিছিয়েছে। ২০০৫ সালে তৎকালীন বিএনপি সরকারের সময়ে নিরাপত্তার কারণে ভারত ঢাকায় আসতে অপারগতা প্রকাশ করায় চূড়ান্ত প্রস্তুতি নিয়েও বাংলাদেশ যথাসময়ে সার্ক শীর্ষ সম্মেলন আয়োজন করতে পারেনি। অবশ্য বছরের শেষ দিকে সব দেশের অংশগ্রহণে এ শীর্ষ সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়।
এদিকে ভারতে আফগানিস্তানের রাষ্ট্রদূত ড. শাইদা মোহাম্মদ আবদালি এনডিটিভিকে এক সক্ষাৎকারে বলেছেন, আসন্ন সার্ক শীর্ষ সম্মেলন বয়কট করে হলেও পাকিস্তানকে একটা উপযুক্ত বার্তা পাঠানো উচিত। তিনি বলেন, আমাদের এটা অবশ্যই নিশ্চিত করতে হবে যে, আমরা যেন সবচেয়ে বেশিসংখ্যক রাষ্ট্রকে ঐক্যবদ্ধ করতে পারি। আমি নিশ্চিত যে আমরা যেভাবে ভাবছি সেইভাবে দক্ষিণ এশিয়ার সব দেশই চিন্তাভাবনা করছে। তাই আমাদের এই উদ্যোগ এতটাই ব্যাপকভিত্তিক হওয়া উচিত, যাতে আমরা একটি দেশকে চিহ্নিত করতে পারি, যা আমাদের আঞ্চলিক শান্তি ও ঐক্যের প্রতি হুমকি সৃষ্টি করছে।
২০১৪ সালের নভেম্বরে সার্কের কাঠমান্ডু শীর্ষ সম্মেলনে পাকিস্তানের আপত্তির কারণে মোটর ভেহিকল এগ্রিমেন্ট (এমভিএ) স্বাক্ষর হয়নি। এর পর থেকেই পাকিস্তানকে বাদ দিয়ে বাংলাদেশ-ভুটান-ভারত-নেপাল (বিবিআইএন) উপ-আঞ্চলিক সহযোগিতার জোরালো উদ্যোগ নেয় দিল্লি। এই জোটের যোগাযোগমন্ত্রীরা গত বছর জুনে থিম্পুতে বিবিআইএন এমভিএ স্বাক্ষর করেন।
সার্ক শীর্ষ সম্মেলনে বাংলাদশের যোগ দেওয়ার সম্ভাবনা প্রসঙ্গে ভারতে বাংলাদেশের হাইকমিশনার সৈয়দ মোয়াজ্জেম আলী সংবাদমাধ্যমকে বলেছেন, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এতে যোগ দেবেন কি না তা এখনো চূড়ান্ত হয়নি। নিউ ইয়র্কে জাতিসংঘ সাধারণ অধিবেশনে ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী সুষমা স্বরাজের সঙ্গে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর দেখা হবে। আগামী অক্টোবরে ব্রিকস সম্মেলনে যোগ দিতে গোয়ায় যাবেন শেখ হাসিনা। সেখানে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির সঙ্গেও নিশ্চিতভাবে এ নিয়ে আলোচনা হবে।
এর আগে ইসলামাবাদে সার্ক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীদের বৈঠকে যাননি বাংলাদেশের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল। এতে বাংলাদেশের প্রতিনিধিত্ব করেন ইসলামাবাদে নিযুক্ত বাংলাদেশের হাইকমিশনার। আর সার্ক অর্থমন্ত্রীদের বৈঠকে যোগ দেননি আবুল মাল আবদুল মুহিত। এতে বাংলাদেশের প্রতিনিধিত্ব করেন অর্থ প্রতিমন্ত্রী।