জাতিসংঘে দেওয়া ভাষণে বিশ্ব সম্প্রদায়ের প্রতি শেখ হাসিনা সন্ত্রাসী ও উগ্রবাদীদের অর্থ-অস্ত্রের জোগান ও সমর্থন দেবেন না
নাশরাত আর্শিয়ানা চৌধুরী: প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, বর্তমান সময়ের দুটি বৈশ্বিক চ্যালেঞ্জ জঙ্গিবাদ ও সহিংস চরমপন্থা। এই চ্যালেঞ্জগুলো কোনো নির্দিষ্ট গন্তব্যে আবদ্ধ না থেকে বিশ্বের সর্বত্র ছড়িয়ে পড়েছে। কোনো দেশই আপাতদৃষ্টিতে নিরাপদ নয়। কোনো ব্যক্তি এদের লক্ষ্যের বাইরে নয়। আমেরিকা থেকে ইউরোপ, আফ্রিকা থেকে এশিয়ায়, অগণিত মানুষ সন্ত্রাসবাদের শিকার হচ্ছে। তিনি সন্ত্রাসী ও উগ্রবাদীদের অর্থ ও অস্ত্রের জোগান বন্ধ এবং তাদের প্রতি নৈতিক ও বৈষয়িক সমর্থন না দিতে বিশ্ব সম্প্রদায়ের প্রতি আহ্বান জানান। ২১ সেপ্টেম্বর বুধবার সন্ধ্যায় (স্থানীয় সময়) নিউইয়র্কে জাতিসংঘ সদর দফতরে জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের ৭১তম অধিবেশনে দেয়া ভাষণে তিনি এ আহ্বান জানান। প্রধানমন্ত্রী বলেন, সন্ত্রাসের পরামর্শদাতা, মদতদাতা ও প্রশিক্ষকদের খুঁজে বের করতে হবে।
প্রধানমন্ত্রী বাংলাদেশের উন্নয়ন ও অগ্রগতির চিত্র বিশ্বনেতাদের অবহিত করেন। টানা আটবার জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের অধিবেশনে বাংলায় ভাষণ দিলেন তিনি। ৭ টা ৪০ মিনিটে প্রধানমন্ত্রী তার ভাষণ শুরু করেন এবং প্রায় ২০ মিনিটের দেওয়া এই ভাষণ শুধুমাত্র দেশীয় পরিম-লেই সীমাবদ্ধ থাকেনি, প্রাধান্য পেয়েছে জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলা, অভিবাসী শ্রমিকদের অধিকার আদায়, নারীর ক্ষমতায়ন, আন্তর্জাতিক শান্তি ও নিরাপত্তার মতো সাম্প্রতিক ইস্যুগুলো। এসেছে বিশ্বমানবতার কথা।
গত ১ জুলাই ঢাকার গুলশানে ভয়াবহ সন্ত্রাসী হামলা বাংলাদেশের জনগণের মনে এক গভীর ক্ষতের সৃষ্টি করেছে বলে উল্লেখ করেন প্রধানমন্ত্রী। এ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, বর্তমানে আমরা এই সন্ত্রাসীদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ চালিয়ে যাচ্ছি। নিজে সন্ত্রাসী হামলার শিকার হয়েছেন উল্লেখ করে শেখ হাসিনা বলেন, তার সরকার সন্ত্রাসীদের বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্সে নীতি গ্রহণ করেছে।
শেখ হাসিনা বলেন, সন্ত্রাস-জঙ্গিবাদ প্রতিরোধে দেশের জনগণকে সচেতন করতে, সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে অবস্থান নিতে ব্যাপক কর্মসূচি হাতে নেওয়া হয়েছে। এতে সাড়া দেওয়ার জন্য পুরো জাতির প্রতি আহ্বান জানানো হয়েছে। সমাজের প্রত্যেক স্তর থেকে অভূতপূর্ব সাড়া মিলছে। প্রধানমন্ত্রী বলেন, তিনি আত্মবিশ্বাসী যে জনগণের দৃঢ়তা ও সহযোগিতায় বাংলাদেশের মাটি থেকে সন্ত্রাসীদের সমূলে উচ্ছেদ করতে সক্ষম হবেন।
শেখ হাসিনা বলেন, আগামী ডিসেম্বরে গ্লোবাল ফোরাম অন মাইগ্রেশন অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট (জিএফএমডি) আয়োজন করা হচ্ছে। সেখানে অভিবাসন-বিষয়ক গঠনমূলক সংলাপের প্রত্যাশা করছেন তিনি।
জাতিসংঘের বিদায়ী মহাসচিব বান কি মুনের ভূমিকার প্রশংসা করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, তিনি সব সময়ই একজন বিশ্বস্ত বন্ধু হিসেবে বাংলাদেশের উন্নয়নের অর্জনগুলোকে বাকি বিশ্বের জন্য ‘রোল মডেল’ হিসেবে তুলে ধরেছেন।
বাংলাদেশে নারীর ক্ষমতায়ন প্রসঙ্গে শেখ হাসিনা বলেন, সম্ভবত বাংলাদেশ পৃথিবীর একমাত্র দেশ, যেখানে প্রধানমন্ত্রী ও সংসদনেতা, বিরোধীদলীয় নেতা, স্পিকার, সংসদ উপনেতা সবাই নারী।
শেখ হাসিনা জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের কথা স্মরণ করে বলেন, ১৯৭৪ সালে এই মহান সাধারণ পরিষদে তিনি বলেছিলেন, ‘শান্তির প্রতি যে আমাদের পূর্ণ আনুগত্য, তা এই উপলদ্ধি থেকে জন্মেছে যে একমাত্র শান্তিপূর্ণ পরিবেশেই আমরা ক্ষুধা, দারিদ্র্য, রোগ-শোক, অশিক্ষা ও বেকারত্বের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করার জন্য আমাদের সকল স¤পদ ও শক্তি নিয়োগ করতে সক্ষম হবো।’ আমাদের বিশ্ব বর্তমানে এমন এক সন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়ে আছে, যখন এ সব অভিশাপ থেকে মুক্তি খুব একটা দূরে নয়। অনেক সৃজনশীল এবং প্রায়োগিক সমাধান এখন আমাদের নাগালের মধ্যে। প্রযুক্তি, নব্য চিন্তাধারা এবং বৈশ্বিক নাগরিকদের বিস্ময়কর ক্ষমতা আমাদের একটি নতুন সাহসী বিশ্ব স¤পর্কে ভাবতে উদ্বুদ্ধ করছে। তবে এখনও আমাদের এই বিশ্ব উত্তেজনা এবং ভীতিকর পরিস্থিতি থেকে মুক্ত নয়। বেশকিছু স্থানে সহিংস-সংঘাতের উন্মত্ততা অব্যাহত রয়েছে।
প্রধানমন্ত্রী প্রশ্ন রাখেন, কী অপরাধ ছিল সাগরে ডুবে যাওয়া সিরিয়ার ৩-বছর বয়সী নিষ্পাপ শিশু আইলান কুর্দীর? কী দোষ করেছিল ৫-বছরের শিশু ওমরান, যে আলেপ্পো শহরে নিজ বাড়িতে বসে বিমান হামলায় মারাত্মকভাবে আহত হয়েছে? একজন মা হিসেবে আমার পক্ষে এ সব নিষ্ঠুরতা সহ্য করা কঠিন। বিশ্ব বিবেককে কি এসব ঘটনা নাড়া দিবে না?
শেখ হাসিনা সরকারের বিভিন্ন সাফল্যের কথা তুলে ধরে বলেন, নিজস্ব অর্থায়নে আমরা ৬ দশমিক ১৫ কিলোমিটার দীর্ঘ পদ্মা বহুমুখী সেতু নির্মাণ করছি। একটি গভীর সমুদ্র বন্দর নির্মাণের আলোচনা চলছে। তৃতীয় সমুদ্র বন্দর পায়রার কার্যক্রম শুরু হয়েছে। বিশ্ব মন্দা সত্ত্বেও বিগত সাত বছরে আমাদের রপ্তানি আয় প্রায় তিনগুণ বৃদ্ধি পেয়ে ৩৪.২৪ বিলিয়ন মার্কিন ডলার হয়েছে। প্রবাসীদের পাঠানো রেমিটেন্স তিনগুণ বৃদ্ধি পেয়েছে। বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ৩.৫ বিলিয়ন থেকে সাড়ে আটগুণ বৃদ্ধি পেয়ে ৩১ বিলিয়ন ডলার ছাড়িয়ে গেছে। এ সময়ে বিদ্যুৎ উৎপাদন সক্ষমতা প্রায় তিনগুণ বৃদ্ধি পেয়েছে। সরাসরি বৈদেশিক বিনিয়োগের পরিমাণও তিনগুণ বৃদ্ধি পেয়েছে।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, জলবায়ু পরিবর্তন আমাদের অনেকগুলো উন্নয়ন অর্জনকে হুমকির মুখোমুখি করছে। আমি আশা করি বৃহৎ কার্বন নিঃসরণকারী দেশগুলো অতি সত্বর চুক্তিটিতে অনুসমর্থন জানাবে।
শেখ হাসিনা বলেন, ১৯৭১ সালে আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধের সময় গণহত্যা এবং মানবতাবিরোধী অপরাধের জন্য স্থানীয় অপরাধীদের বিচার নিশ্চিত করার মাধ্যমে আমরা বিগত কয়েক দশকের বিচারহীনতার সংস্কৃতি থেকে বেরিয়ে আসতে সক্ষম হয়েছি। মধ্যপ্রাচ্য শান্তি প্রক্রিয়া পুনরায় চালু ও ভ্রাতৃপ্রতীম ফিলিস্তিনি জনগণের প্রতি বৈরিতা নিরসনের জন্য সাম্প্রতিক প্রচেষ্টাগুলোকে অবশ্যই সঠিক দিকে পরিচালিত করতে হবে।
তিনি বলেন, ‘বিশ্বায়নের এই যুগে আমদের সামনে অনেক চ্যালেঞ্জ রয়েছে। তবে, যদি আমরা সঠিক পন্থা অবলম্বন করি, তাহলে এখানে সম্ভাবনা ও সুযোগও রয়েছে প্রচুর। এক মানবতার জন্য কাজ করার উদ্দেশ্যে আমরা সকলে এখানে সমবেত হয়েছি। মতের ভিন্নতা থাকা সত্ত্বেও আসুন আমরা মানবতার স্বার্থে সকলে অভিন্ন অবস্থানে উপনীত হই এবং বিশ্ব থেকে সংঘাত দূর করে শান্তির পথে এগিয়ে যাই। এক্ষেত্রে জাতিসংঘই হতে পারে আমাদের জন্য একটি অনন্য প্ল্যাটফর্ম। আসুন আমরা এই সংস্থাকে আরও টেকসই এবং প্রাসঙ্গিক করে তুলতে নতুন করে শপথ গ্রহণ করি। সম্পাদনা : সুমন ইসলাম