স্বাস্থ্যখাতে কর্মীদের ঝুঁকিভাতা অত্যন্ত কম এবং বৈষম্যমূলক
রিকু আমির : দেশের সরকারি সংক্রামক রোগের চিকিৎসা কেন্দ্রের কর্মীদের ঝুঁকিভাতা বৃদ্ধি করা হয়নি ৪৫ বছরেও। যক্ষ্মা, এইডসসহ বিভিন্ন ছোঁয়াচে ও জটিল রোগে আক্রান্তদের খুব কাছাকাছি ঝুঁকিপূর্ণ নৈকট্যে কাজ করেও ঝুঁকিভাতা হিসেবে চিকিৎসক, নার্স, কর্মচারীরা মাসে পাচ্ছেন মাত্র ২৫০ টাকা!
দেশে ৪৪টি বক্ষব্যাধি ক্লিনিক, পাঁচটি বিভাগে পাঁচটি বক্ষব্যাধি হাসপাতাল, ঢাকার শ্যামলীতে ২৫০ শয্যার বক্ষব্যাধি হাসপাতাল, মহাখালীতে কুষ্ঠ হাসপাতাল এবং জাতীয় বক্ষব্যাধি ইনস্টিটিউট ও হাসপাতাল, চন্দ্রঘোনা ও লালমনিরহাটে কুষ্ঠ হাসপাতাল, মহাখালীতে সংক্রামক ব্যাধি হাসপাতাল রয়েছে। এসব হাসপাতালে যেসব চিকিৎসক-নার্স-কর্মচারী নিয়োজিত আছেন, তাদের বেশিরভাগকে রোগীর কাছাকাছি যেতেই হচ্ছে। এতে করে বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত হবার ঝুঁকি সৃষ্টি হচ্ছে। পেশাগত দায়িত্ব পালন করতে গেলে এটা থেকে মুক্ত থাকার উপায় নেই বললেই চলে। এসব হাসপাতালে যক্ষ্মা, কুষ্ঠ, এইডস, বসন্ত ও শ্বাসতন্ত্রের রোগসহ বিভিন্ন ছোঁয়াচে ও জটিল রোগের চিকিৎসা প্রদান করা হয়।
জাতীয় বক্ষব্যাধি ইনস্টিটিউট ও হাসপাতাল, শ্যামলীর যক্ষ্মা হাসপাতাল মিলিয়ে দুজন নার্স ও তিনজন কর্মচারী পাওয়া গেছে, যারা ওষুধ প্রতিরোধী যক্ষ্মায় (এমডিআর টিবি) আক্রান্ত। তাদের একজন নাম না প্রকাশের শর্তে এ প্রতিবেদককে বলেন, ওষুধ না হয় ফ্রি পেলাম। কিন্তু রোগটা তো আমার মধ্যে বাসা বেঁধে ক্ষতিসাধন করল, আমার পরিবারের ঝুঁকিও বৃদ্ধি পেল, এ রোগের প্রভাবে আমি মারাও যেতে পারি। এসব কিছু বিবেচনায় ২৫০ টাকা ঝুঁকিভাতা হাস্যকর।
আন্তর্জাতিক উদরাময় গবেষণা কেন্দ্র, বাংলাদেশ (আইসিডিডিআর,বি)’র একটি গবেষণায়ও দেখা গেছে, সংক্রামক রোগে আক্রান্তদের সেবা দিতে গিয়ে স্বাস্থ্যকর্মীরাই রোগাক্রান্ত হন। গবেষণার তথ্য-উপাত্ত অনুসারে, হাসপাতালগুলোতে চিকিৎসাকর্মীদের জন্য নেই পর্যাপ্ত নিরাপত্তামূলক ব্যবস্থা। আইসিডিডিআর,বি সূত্র জানায়, গবেষণায় অন্তর্ভুক্ত বিভিন্ন শ্রেণির ৪৪৯ স্বাস্থ্যকর্মীর দুই ধাপের টিএসটি (টিউবারকুলিন স্কিন টেস্ট) পরীক্ষা করা হয়েছিল। তাদের মধ্যে ৭৮ জন রাজশাহী, ৮১ জন খুলনা, ৬১ জন চট্টগ্রাম এবং ২২৯ জন ঢাকায় কাজ করেন। অংশগ্রহণকারীদের মধ্যে বেশি ছিলেন নার্স (৪৫ শতাংশ)। পরীক্ষায় এসব স্বাস্থ্যকর্মীর মধ্যে মোট ৫৪ শতাংশের দেহে লুক্কায়িত যক্ষ্মা রোগের সংক্রমণ পাওয়া গেছে। চট্টগ্রামের স্বাস্থ্যকর্মীদের মধ্যে লুক্কায়িত যক্ষ্মা রোগ সংক্রমণের হার ছিল সবচেয়ে বেশি (৬৭ শতাংশ) এবং খুলনায় এই হার ছিল সবচেয়ে কম (৪০ শতাংশ)। লুক্কায়িত যক্ষ্মা রোগে আক্রান্ত ৮৫ শতাংশ স্বাস্থ্যকর্মী গবেষণা টিমের সদস্যদের জানিয়েছেন, আগে বাড়িতে তারা ফুসফুসের যক্ষ্মায় আক্রান্ত কোনো রোগীর সংস্পর্শে আসেননি। ফলে গবেষকরা নিশ্চিত হন, কর্মস্থলে দায়িত্ব পালনকালে যক্ষ্মা রোগীদের সংস্পর্শে থাকার মাধ্যমে তাদের মধ্যে এ রোগের সংক্রমণ ঘটেছে।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, ঝুঁকিভাতা নির্ধারণ করা হয়েছিল পাকিস্তান আমলে। এ টাকা তখনকার বেতনের সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ ছিল। তখন থেকে বর্তমান পর্যন্ত ধাপে ধাপে বেতন স্কেল পরিবর্তন হয়েছে। কিন্তু সঙ্গতি রেখে ঝুঁকিভাতা বৃদ্ধি করেনি সরকার। ভাতা বৃদ্ধিতে সরকারের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে গত আগস্টে জাতীয় বক্ষব্যাধি ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালের পরিচালককে প্রধান করে গঠিত চার সদস্যের একটি কমিটি গঠন করা হয়েছিল। যার সভাপতি ছিলেন- বক্ষব্যাধি ইনস্টিটিউটের সাবেক পরিচালক অধ্যাপক ডা. আলী হোসেন। এ কমিটির নেতৃত্বে দেশের বিভিন্ন বক্ষব্যাধি ও সংক্রামক ব্যাধি চিকিৎসা কেন্দ্রের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের নিয়ে বৈঠক হয়েছিল। সবার সম্মতিক্রমে এই কমিটি বক্ষব্যাধি ও সংক্রামক ব্যাধি চিকিৎসা কেন্দ্রে কর্মরতদের মূল বেতনের ৩০ শতাংশ ঝুঁকিভাতা হিসেবে নির্ধারণের প্রস্তাব পাঠায় স্বাস্থ্য অধিদফতরে। বৈঠকে যুক্তি দেখানো হয়েছিল- পুলিশ, র্যাব, বিজিবিসহ সরকারের বিভিন্ন সংস্থা বাড়তি ঝুঁকি নিয়ে বিভিন্ন ক্ষেত্রে কাজ করে মূল বেতনের ৩০ শতাংশ ঝুঁকিভাতা পাচ্ছেন, তারা পেলে সংক্রামক রোগ চিকিৎসার সঙ্গে যুক্তরা কেন পাবেন না।
জাতীয় বক্ষব্যাধি ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালের পরিচালক অধ্যাপক ডা. শাহেদুর রহমান খান বৃহস্পতিবার বিকালে এ প্রতিবেদককে বলেন, বর্তমান ঝুঁকিভাতা বেমানান। বর্তমান বেতন স্কেলের সঙ্গে এটা অসঙ্গতিপূর্ণ।
একই প্রতিষ্ঠানে সহযোগী অধ্যাপক ডা. বশীর আহমেদ বৃহস্পতিবার বিকালে এ প্রতিবেদককে বলেন, আমি চাকরিতে প্রবেশের পরই এই ভাতা ২৫০ টাকা দেখেছি, এখনও দেখছি। দেশ স্বাধীন হবার পর বিভিন্ন সরকারের আমলে আমাদের বেতন স্কেল পরিবর্তন হয়েছে, বিভিন্ন ভাতাদিও বৃদ্ধি পেয়েছে। কিন্তু এই ঝুঁকিভাতা বৃদ্ধি পায়নি। এটা বৃদ্ধি করা খুবই যৌক্তিক। হয়তো কেউ কখনও আমাদের মতো লিখিত দাবি করেনি বা সরকার জানে না বলে এটা বৃদ্ধি পায়নি। আমরা স্বাস্থ্য অধিদফতরে লিখিত দাবি পাঠিয়েছি। আমাদের ইনস্টিটিউটে কর্মরত প্রায় ৭০০ চিকিৎসক-নার্স-কর্মকর্তা-কর্মচারীর জন্য বছরে প্রয়োজন প্রায় দুই কোটি ৬০ লাখ টাকা। এটা অধিদফতরে পাঠানো হয়েছে। আমাদের অনুরোধ থাকবে এটা বৃদ্ধির বিষয়টি যেন স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় গুরুত্বসহ বিবেচনা করে।
স্বাস্থ্য অধিদফতরের পরিচালক (হাসপাতাল) অধ্যাপক ডা. সামিউল ইসলাম সাদি এ প্রতিবেদককে বলেন, ঝুঁকিভাতা পুন:নির্ধারণে একটি কমিটি করা হয়েছিল। তারা আমাদের কাছে দাবি জানিয়েছে। এখন সেটা যাচাই-বাছাই করা হচ্ছে। এরপর এটি চূড়ান্ত অনুমোদনের জন্য স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হবে।