ধর্ম-বর্ণ ও সামাজিক পরিচয়
গোপালকৃষ্ণ বাগচী
ধর্মের একটি সংক্ষিপ্ত সংজ্ঞা হলো, যা মানুষকে সত্যের পথে, কল্যাণের পথে ধরে রাখে এবং ইহকাল ও পরকালের কলাণ সাধন করে, তাই ধর্ম। এখানে ধর্ম নিয়ে বিস্তর লেখা আমার উদ্দেশ্য নয়, তা আশাও করি না। কিন্তু ধর্ম আমাদের জীবনের অংশ, তাই জীবন পরিচয়ের ইতিহাস বর্ণনায় ধর্মের বিষয়টি এসেই যায়। সংক্ষেপে কিছু লিখে প্রকাশ করা কঠিন বৈকি। তাতে যেমন অঙ্গহানি ঘটতে পারে, তেমনি তাতে গভীরতা ধরা দেয় না। তবু তার কিছু রেখে, কিছু বেছে সার কথা কিছু তুলে ধরার প্রচেষ্টা কেবল। অনুসন্ধিৎসু পাঠক নানা বই থেকে এর বিস্তারিত জানতে পারেন। ধর্ম বিষয়টি সংবেদনশীল বলে লেখার ক্ষেত্রে অতিরিক্ত সতর্কতা অবলম্বন করতে হয়।
অনেকে ধর্ম সম্পর্কে বিস্তর জানেন, কোনো অনুষ্ঠানে তার বিশদ আলোচনাও হয়। তবে ধর্মের ইতিহাস নিয়ে হয় না। অথচ প্রতিটি ধর্মেরই ইতিহাস আছে। বিস্ময়কর তা। কীভাবে বহু চড়াই উৎরাই পেরিয়ে একটি ধর্ম প্রতিষ্ঠিত হলো, কীভাবে একখানি ধর্মগ্রন্থ মানুষের হাতে এলোÑ ধর্মের চেয়ে এর ইতিহাসের দিকটি আমাকে দারুণভাবে অলোড়িত করে। এর একটা সুবিধে এই যে, বিশ্বাসটুকুকে অন্তত একবার পরখ করে নেওয়া যায়, বিবেকানন্দের মতো। হয়তো ‘বিশ্বাসে মিলায় বস্তু তর্কে বহুদূর’ গোছের কিছু হবে না তাতে। বর্তমানে যা ধর্ম হিসেবে চিহ্নিত আদিতে সেগুলো ছিল আচরণীয়-পালনীয় যা পরে ধর্মবিধি হিসেবে পরিচিতি পায়। এই ধর্মবিধির উদ্দেশ্য ছিল সমাজবদ্ধ মানুষের মধ্যে পারস্পরিক ব্যবহারবিধি প্রয়োগ করে সামাজিক শান্তি ও শৃঙ্খলা রক্ষা করা। এর শক্তি অসীম। রাজা প্রজাকে শাসন করে, কিন্তু ধর্ম সবাইকে শাসন করে। কৃষ পুরোহিত শক্তিমান রাজা, পালোয়ানকেও নিয়ন্ত্রণ করে। আজকে রাষ্ট্র ও তার আইনকানুন এবং জাতিসংঘ ও মানবাধিকার সংগঠনগুলো মানুষকে পথ চলতে সাহায্য করে। অতীতে এসবের অনুপস্থিতিতে ধর্মের অনুশাসনই মানুষকে পরিচালিত করেছে। ঠিক একইভাবে আজকের মহামনীষীরা সাধারণ মানুষের পাথেয় এবং যাদের অভাবে পুরোহিতরা এ দায়িত্বটি পালন করেছে অতীতে।
ধর্ম মানুষের কল্যাণের জন্য। কিন্তু বাস্তবে ধর্ম কখনও মানুষের চেয়ে মুখ্য হয়ে ওঠে। মানুষ হয়ে পড়ে অবহেলিত এবং মানুষের হাত ধরেই তা ঘটে থাকে। মানুষের সেবা উপেক্ষিত থেকে ঈশ্বরের প্রার্থনা গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠে। ধর্মের জন্য মানুষ যতটুকু ত্যাগ স্বীকার করে, অর্থ খরচ করে; মানুষের জন্য, সমাজের জন্য, শিক্ষার জন্য এখনও ততটুকু করে না। তাদের ধারণা, আনন্দোৎসবে, ধর্মীয় কাজে অঢেল খরচ করলে প্রচুর সুনাম হবে, পূণ্য হবে। অন্যদিকে মানুষের কল্যাণ! সে তো মহামনীষীদের কাজ, যেন তা তার মতো সাধারণের কাজ নয়।
আমরা আমাদের গোত্র, ধর্ম, বর্ণ আজ যেমন প্রত্যক্ষ করছি, এটাই চূড়ান্ত ছিল না। হাজার বছর আগে আমাদের পূর্বপুরুষ কোথায় ছিল, কোন গোত্রে ও ধর্মে ছিল কে জানে। কাজেই ধর্মীয় সম্প্রীতি সবসময়ই থাকার কথা। আল্লাহ, ভগবান, ঈশ্বর, গড, অহুর মাজদা (পার্সিধর্মে সৃষ্টিকর্তা) যেহেতু একজন, তিনিই মানুষগুলোকে নানা ধর্মের বেষ্টনির ভিতর সাজিয়ে রেখেছেন। আমরা শুধুই অযথা তর্ক করছি। যেটি আজ কারও ধর্ম, পাঁচশ বছর পূর্বে তার পূর্ব পুরুষেরা যে অন্য ধর্মের ছিল না, তা কে বলবে! কারণ আমরা তো জানি এ উপমহাদেশে ধর্মের বিবর্তন কতভাবে কতবার হয়েছে। শংকর জাতের উদ্ভব হয়েছে, আজকে আবার দেশান্তরও হচ্ছে। কাজেই হে মানবকূল, কোনো কিছুই চূড়ান্ত নয়, সবই চলমান।
বিশ্বায়নের যুগে অদূর ভবিষ্যতে পৃথিবীর নানা মতবাদ, ধ্যান-ধারণা, ইজম বাদ পড়ে যাবে। এটি বিজ্ঞানের উৎকর্ষতা, সহজ যোগাযোগ ব্যবস্থা, দেশান্তর ও ভাব বিনিময়ের অবারিত সুযোগের কারণে হবে। প্রাচীনকালের মতো অঞ্চলভেদে কোনোকিছু আর একতরফাভাবে গড়ে উঠবে না। ধর্মও এর বাইরে পড়বে না। বর্তমান তিনপুুরুষের ধর্মীয় চেতনাতেই তো কত তফাৎ ঘটে চলেছে, সুস্পষ্ট প্রভেদ সেখানে। বর্তমান প্রজন্ম ধর্মীয় বিষয়গুলোকে উৎসব-অনুষ্ঠান হিসেবেই বেশি দেখে, ধর্মের মাহাত্ম্যের গভীরতা নিয়ে তারা ভাবে না। এমনি করে ধর্মের বহু বিধিবিধান একদিন ইতিহাস হবে। শুধু ধর্মীয় পরিচয়টি হয়তো থাকবে বহুকাল ধরে। এটি বর্তমানের মানা না মানা বা বিস্ময়াবেগের কোনো বিষয় বা বিশ-ত্রিশ বছরের বিষয়ও নয়। বিষয়টি হবে শত শত বছর পরের বাস্তবতা। কারণ মানুষ না চাইলে কে আর তা ধারণ, বহন করবেন? মানুষ স্বর্গ-নরকের ধারণার পরিবর্তে শিক্ষা ও মানবিক মূল্যবোধ দ্বারা পরিচালিত হবে। রাষ্ট্রের আইনকানুন দ্বারা পরিচালিত হবে। অতীতে রাষ্ট্রের অস্তিত্বই যেখানে ছিল না, সেখানে তার আইনকানুনও আনার সুযোগ ছিল না, তখন ধর্মের অনুশাসনই ছিল একমাত্র উপায়।
প্রত্যেক ধর্মেই কতকগুলো বাহ্যিক আচার-আচরণ ও অনুষ্ঠানাদি থাকে যা অনেকটাই ঐতিহাসিক বা ভৌগলিক কারণজাত। যে স্থানে যে ধর্মের উৎপত্তি হয় সেই ধর্মের বিবরণ, নিয়মনীতি ও আচার-অনুষ্ঠানে সেই স্থানের মাটি, আবহাওয়া, গাছপালা-শস্য, ফল-ফুল, পশু-পাখি, প্রকৃতি-পরিবেশের বর্ণনা ও ব্যবহার থাকবে এটাই স্বাভাবিক। সেই অর্থে ভারতবর্ষে হিন্দুধর্ম ও বৌদ্ধধর্মের সঙ্গে এখানকার বাস্তব জীবনের পরিবেশগত মিল অনেক বেশি, কারণ তা এখানকার মাটি থেকে উৎসরিত। অন্যান্য ধর্মের বেলায়ও সেই একই কথা প্রযোজ্য। যে যে পবিত্র ভূমি থেকে সেই সকল ধর্মের উৎপত্তি ও বিকাশ ঘটেছে সেখানকার বাস্তব পরিবেশ পরিস্থিতির সঙ্গে তার মিল রেখে হয়েছে। সংক্ষেপে বলা যায়, যে প্রেক্ষাপটে যে ধর্ম উৎসরিত হয়েছে তার স্বাক্ষর তাতে বিদ্যমান থাকবে। ভারতবর্ষ কৃষি প্রধান দেশ; তার সমাজ, জীবনাচরণও তাই। ধর্মেও তার প্রতিফলন ঘটেছে পরতে পরতে। কৃষি সম্পদ, গো-সম্পদ, শস্য সম্পদ এর নানাভাবে পূজা-পার্বণ, আরাধনা, ব্রত, বিশ্বাস রয়েছে তাতে। ধান, দূর্বা, তিল, সরিষা, ফুল-ফলসহ নানা দেশজ উদ্ভিদ ও জিনিসপত্রের ব্যবহার আছে সর্ব মাঙ্গলিক অনুষ্ঠানাদিতে। মোট কথা, এদেশের ধর্ম-কর্ম, সভ্যতা-সংস্কৃতি, শিল্প-সাহিত্য সবই কৃষিকেন্দ্রিক। অথর্ববেদ তো আদি ভেষজ চিকিৎসা গ্রন্থ। আবার আরব পরিবেশে উদ্ভূদ হয়েছে ইসলাম ধর্ম। ইসলাম ধর্মে সেখানকার কথা, পরিবেশ, বাস্তবতা বিধৃত আছে সযতেœ। বাঙালি সংস্কৃতি ও বাঙালিপনা হিন্দু ও বৌদ্ধধর্মে বেশি মিল পাওয়া যায়। পক্ষান্তরে ইসলাম ধর্মে রয়েছে আরব সংস্কৃতির মিল ও ইউরোপে খ্রিষ্ট ধর্মের।
লেখক: কথা সাহিত্যিক ও প্রকৌশলী